ভারত-পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কঠোর সমালোচনা করছে ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপির সমর্থকরা। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) গত শুক্রবার নিজেদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সের (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্টে লিখেছে, ‘যাচনা ন্যাহি, আব রণ হোগ্যা’। এর আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায়, ‘অনুরোধ নয়, এবার যুদ্ধ হবে’। এই পঙ্?ক্তির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিমানবাহিনীর জাম্পস্যুট পরা একটি ছবিও যুক্ত করা হয়েছে।
গুয়াহাটিভিত্তিক ব্যবসায়ী ও বিজেপির সদস্য মুন তালুকদার বলেন, ‘হঠাৎ যুদ্ধবিরতি ভারতের ভূখণ্ডে জঙ্গি পাঠানো থেকে পাকিস্তানকে থামাতে পারবে না।’ মুন একসময় অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের নেতা ছিলেন। ৩০ বছর বয়সি মুন বলেন, ‘ভারতের উচিত ছিল পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর দখল করে নেওয়া। যতক্ষণ না আমরা সেই কাশ্মীর দখল করছি, ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ চলতেই থাকবে। যদি যুদ্ধবিরতি না হতো এবং পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর দখল করা যেত, তাহলে ভারত প্রমাণ করতে পারত যে, আমরা দুর্বল দেশ নই। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো আমরাও বিশ্বশক্তিগুলোর সমতুল্য।’ যুদ্ধবিরতির পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র জড়িত ছিল। যুদ্ধবিরতির ঘোষণাই দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই বিষয়টি বিজেপির সমর্থকদের প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ করেছে।
সাংবাদিক থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া স্বপন দাশগুপ্ত এক্সে লিখেছেন, ‘এই যুদ্ধবিরতি/‘সমঝোতা’ ভারতে ভালোভাবে গ্রহণ করা হয়নি। কারণ-ট্রাম্প হঠাৎ করেই এই ঘোষণা দিয়েছেন। মনে হলো যেন, তিনি ধুম করে কোনো জায়গা থেকে আবির্ভূত হয়ে নিজের রায় জানিয়ে দিলেন।’ স্বপন বিজেপির জাতীয় কার্যনির্বাহী সদস্য। যুদ্ধবিরতিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের ভূমিকার প্রশংসা করেছে পাকিস্তান। কিন্তু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান বন্ধে এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার কথা স্বীকার করেনি ভারত।তা সত্ত্বেও ট্রাম্প আরেক ধাপ এগিয়ে গেছেন। গত রোববার ট্রাম্প ঘোষণা দেন, ‘আমার পরবর্তী কাজ হলো ভারত ও পাকিস্তানকে সঙ্গে নিয়ে কাশ্মীর বিষয়ে একটি ‘সমাধান’ বের করার চেষ্টা করা।’ ট্রাম্পের এই মন্তব্য অনেক ভারতীয়কে ক্ষুব্ধ করেছে। তারা মনে করে, ওয়াশিংটন এই অঞ্চলে হস্তক্ষেপ ক্রমে বাড়াচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন।
রিপাবলিক মিডিয়া নেটওয়ার্কের প্রধান সম্পাদক অর্ণব গোস্বামী ট্রাম্পের ‘অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ’ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। রাগান্বিত কণ্ঠে এক প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘তার (ট্রাম্পের) মাঠের বাস্তবতা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। এখানে কী ঘটছে, সে বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। অর্ণব গোস্বামী আরও বলেন, ‘আমি মনে করি, এটা (কাশ্মীর বিষয়) তার আয়ত্তের বাইরে। এটা ট্রাম্পের স্বভাবসুলভ অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ। আমি এটা মানি না। আমরা এটা মিটমাট করব।’ মোদি সরকার আগের আগ্রাসী অবস্থান থেকে সরে এসেছে বলে যারা মনে করছেন, তাদের অনেকে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রির ওপরও ক্ষোভ ঝাড়তে ভুল করেননি। তিনি ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে এক সপ্তাহ ধরে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলন করে আসছিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা মিশ্রির পুরোনো পারিবারিক ছবি এবং তার মেয়ের পেশাগত জীবনের বিবরণ ছড়িয়ে দেন। তার মেয়ের সম্ভাব্য রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিদ্রূপ (ট্রলিং) ও কটাক্ষ শুরু করেন। এসব আচরণ একটা সময় খুব ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। একপর্যায়ে মিশ্রি তার এক্স প্রোফাইলের গোপনীয়তা সেটিংস পরিবর্তন করতে বাধ্য হন।
৩১ বছর বয়সি সায়ন লাহিড়ী বিজেপির বিরুদ্ধে ‘যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কাছে মাথা নোয়ানোর’ অভিযোগ এনেছেন। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানকে বিশ্বমানচিত্র থেকে মুছে ফেলাই ছিল দেশপ্রেমী সনাতনী হিন্দুদের দাবি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এখনও পেহেলগাম হত্যাযজ্ঞের দায়ীদের খুঁজে বের করতে পারিনি।’
নরেন্দ্র মোদি স্বীকৃত ‘সন্ত্রাসী’: ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপির সমর্থকদের সমালোচনা ও যুদ্ধবিরতির পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্বীকৃত ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে পাকিস্তান। গত সোমবার জিও নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফ বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্বীকৃত ‘সন্ত্রাসী’। বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ ছড়ানোর জন্যও ভারতকে দায়ী করেন। তিনি বলেছেন, তারা (ভারত) সন্ত্রাসবাদকে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে গেছে। কানাডার মতো দেশেও ভারত সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। তিনি বলেন, ভারত কেবল দেশে নয়, বিদেশেও সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়েছে... তারা কানাডায় গিয়েও শিখ সম্প্রদায়ের নেতাদের টার্গেট করেছে। সম্প্রতি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কয়েকদিনের সামরিক উত্তেজনার দেওয়া এই সাক্ষাৎকারে খাজা আসিফ দাবি করেছেন, এই সংকটে পাকিস্তান কূটনৈতিক, সামরিক ও মনস্তাত্ত্বিক সব দিক থেকেই সাফল্য পেয়েছে।
পানি সমস্যার সমাধান: পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বলেছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আসন্ন আলোচনায় ‘পানি সমস্যা’ সমাধান না হলে দুই দেশের মধ্যকার যুদ্ধবিরতি হুমকির মুখে পড়তে পাড়ে। সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। পানি সমস্যার সমাধানে ব্যর্থতা ‘একটি যুদ্ধ ঘোষণা করার সমান’ হবে। ইসহাক দার আরও বলেন, ভারতের বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের কোনো ইচ্ছা নেই পাকিস্তানের। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ৭ মে ভারতের বিনা উসকানিতে চালানো সীমান্ত আক্রমণের জবাবে ইসলামাবাদ কেবল আত্মরক্ষার্থেই পাল্টা হামলা চালিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার প্রশংসা করে দার বলেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পাকিস্তানের সন্ত্রাসবিরোধী প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেন। ট্রাম্পের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাশ্মীর সংকট সমাধান সংক্রান্ত মন্তব্যেরও উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যদি তারা আমাদের প্রচেষ্টায় বিশ্বাস না করত তাহলে তারা যেভাবে সহযোগিতা করেছেন তা করতেন না।’