প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৫ জুন, ২০২৫
২০০ বছর আগে ইরানের রাজধানী তেহরানের গোড়াপত্তন হয়। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এ শহরের পরিধি ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট। তাতে পাশ্চাত্যের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যও বিদ্যমান ছিল। এককালে তেহরানের পরিবেশ ও ভাবধারা ছিল প্রাচ্যের একটি মফম্বল শহরের মতো। এখন এ শহরে বাস করছে শুধু মেট্রোপলিটন এলাকায় ৭০ লাখ মানুষ। এর বাইরে অর্থাৎ পুরো তেহরানজুড়ে মানুষ বাস করছে এক কোটি ২০ লাখ। বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম এক শহরে পরিণত হয়েছে তেহরান। তাই তেহরানকে নিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা পাল্টে যাচ্ছে দ্রুত। বলা যায়, তেহরান এক বিশ্ব সাংস্কৃতিক নগরী। প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো বিষয়ে আন্তর্জাতিক ইভেন্ট শুরু হচ্ছে; না হয় শেষ হচ্ছে। বিভিন্ন দেশ থেকে শত শত প্রতিনিধি এ উপলক্ষে আসা যাওয়া করছেন এ মহানগরীতে।
উন্নয়ন প্রকল্পে বাড়তি নজর : তেহরানকে বায়ুদূষণমুক্ত করতে এরই মধ্যে চালু হয়েছে ইলেকট্রিক কার, মোটর সাইকেল। পাতাল রেলের টিকিট কিনতে যাত্রীরা যাতে ভিড় এড়াতে পারেন, সেজন্য টিকিট ভেনডিং মেশিন বসেছে। সবুজায়ন প্রকল্পে বাড়তি নজর দেওয়া হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন শহুরে উন্নয়ন পরিকল্পনার তিন ধাপে অবকাঠামোগত ডিজাইন, উন্নয়ন ও ভূমি ব্যবহারে আইন করে উন্নয়ন নীতিকে এমন করা হয়েছে, যাতে শতাব্দীর পর শতাব্দী তেহরান শহর আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক হয়ে ওঠে। এমনিতে তেহরান শহরের এক আবেদন আছে গ্লোবাল কনস্ট্রাকশন মার্কেট হিসেবে। নতুন অসংখ্য পাঁচ তারকা হোটেল নির্মিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তেহরানে ছুটে আসছে বিশাল ধরনের বিনিয়োগ সুযোগ গ্রহণ করতে। তাদের আকৃষ্ট করতে প্রযুক্তি ও পুঁজির বিশাল মিশেলে এক সহায়ক বিনিয়োগ আবহ তেহরান নগরীকে দিনরাত সচল রাখছে। তেহরানভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনায় বিশেষজ্ঞ প্রশিক্ষণ চলছে প্রতিনিয়ত। সর্বশেষ প্রযুক্তিকে করায়ত্ত করতে তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে তেহরানের বাসিন্দাদের আগ্রহ লক্ষ্য করার মতো।
ছোট্ট গ্রাম থেকে বিখ্যাত নগরী : ইতিহাসবিদরা ইরানের বর্তমান রাজধানীকে নবম শতাব্দীর একটি ছোট গ্রাম বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু গ্রামটি কালক্রমে তার পার্শ্ববর্তী আলবোর্জ পাহাড়ের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকণ্ঠের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর শাহরে রেই-এর সঙ্গে একীভূত হয়ে পড়ে। মোঙ্গল শাসকদের ব্যাপক ভাঙাগড়ার মধ্যে তেহরান ক্রমেই সমৃদ্ধ হতে থাকে। তাদের হত্যাযজ্ঞ থেকে যেসব লোক বেঁচে যেতে সক্ষম হয়, তারা তেহরানে চলে আসে। প্রকারান্তরে বহু বছর ধরেই তেহরান একটি প্রাদেশিক শহর হিসেবে পরিচিতি পেয়ে আসছিল। বিশ্বের সর্বাধিক বিখ্যাত শহরগুলো সম্পর্কে লেখা ইয়াকুত হামারির সুপরিচিত গ্রন্থ ‘মুজামুল বুলদান’-এ ইরানের রাজধানী সম্পর্কে বেশ কিছু মজার কথা লেখা আছে। বলা হয়েছে, তেহরান ছিল একটি বৃহৎ গ্রাম; যার কাঠামো নির্মিত হয়েছে ভূগর্ভে। বাসিন্দারা অনুমতি না দিলে কেউ ওই গ্রামে প্রবেশ করতে পারত না।
যেভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করল : শাসক শাহ ইসমাইলের পুত্র শাহ তাহমাসব সাফাবি যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। তিনি প্রায়ই সাফাবি রাজবংশের শাসকদের প্রথম রাজধানী কাজভিন বেড়াতে যেতেন। এ ছাড়া তার প্রপিতামহ সাইয়িদ হামজার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রেই শহরের শাহ আবদুল আজিমের মাজারে যেতেন। ফেরার পথে তিনি তেহরান হয়ে আসতেন। সেখানে শিকার করতেন। ধীর ধীরে তিনি সে স্থানটির বিশেষ অনুরাগী হয়ে ওঠেন। ওই শহরের চারদিকে দুর্গ প্রাচীরের মতো বেষ্টনী গড়ে তোলেন। দুর্গ প্রাচীরটির পরিধি ছিল ১৫ হাজার ফুট। বাদশার ধর্মবিশ্বাস ছিল প্রবল। তিনি পবিত্র কোরআনের সুরাসংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নগরীর চারদিকে ১১৪টি টাওয়ার নির্মাণের আদেশ দেন। নির্মিত প্রতিটি টাওয়ারে পবিত্র কোরআনের এক-একটি সুরা লেখা হয়। যাতে ওই শহর এবং শহরের বাসিন্দারা দৈব-দুর্বিপাক থেকে রক্ষা পায়। এ ছাড়া নির্মাণ করা হয় দুটি তোরণ। দুর্গ প্রাচীরের অভ্যন্তরে দুটি জায়গা থেকে মাটি সরিয়ে দুটি গহ্বর সৃষ্টি করা হয়। গহ্বর দুটির একটির নাম দেওয়া হয় ‘চালে ময়দান’ (স্কোয়ার গহ্বর) এবং অপরটির নাম দেওয়া হয় ‘চালে হেসার’ (দুর্গ গহ্বর)। আজকের দিনে ওই গহ্বর দুটি ভরাট হয়ে গেলেও ওই জায়গাগুলোর নাম আগের মতোই রয়ে গেছে।
তেহরানকে যখন রাজধানী ঘোষণা : কাজার শাসনামলের বিশিষ্ট লেখক ও রাজনীতিবিদ আবদুল্লাহ মোস্তাফি তার ‘দি স্টোরি অব মাই লাইফ’ গ্রন্থে লিখেছেন, তাহমাসব প্রাচীর ধ্বংস এবং শহরটি বেড়ে ওঠার পর কাজার শাহিবংশের প্রতিষ্ঠাতা আগা মুহাম্মদ খান নগরীর চারদিকে একটি নতুন দেয়াল নির্মাণ করেন। তিনি তার অভিষেকের দিন ১৭৮৩ সালের ২১ মার্চ তেহরানকে রাজধানী ঘোষণা করেন। তখন তেহরানের লোক সংখ্যা ছিল মাত্র দশ থেকে বিশ হাজার। ১৯২৫ সালে রেজা শাহ ক্ষমতায় আরোহণ করে তেহরানকেই রাজধানী হিসেবে বহাল রাখেন। শহরটিকে আধুনিকায়নের প্রচেষ্টা চালান। ১৯৪৫ সাল থেকে তেহরান শহর উত্তরদিকে সম্প্রসারিত হতে থাকে। আলবোর্জ পাহাড়ের পাদদেশে তেহরান ও শেমিরানের মধ্যবর্তী এলাকায় নতুন নতুন উপশহর সৃষ্টি হতে থাকে। পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে উপশহর ও বড় বড় ভবন গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে তেহরান একটি বিভিন্নমুখী আধুনিক মেট্রোপলিটন শহর হিসেবে বেড়ে উঠতে থাকে। দক্ষিণে মরুভূমি ও পতিত জমি অঞ্চলে আবহাওয়া অতি উষ্ণ থাকায় নগরায়ন বৃদ্ধি পায়নি। তবে ছোট ছোট শিল্প গড়ে উঠেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। বিশেষ করে, দ্রুত নগরায়ণের প্রয়োজনীয় ইট ও অন্যান্য সামগ্রীর কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ অঞ্চলে ব্যাপক শিল্প চুল্লির জন্য বায়ূ দূষিত হয়ে পড়ে। সেখানে স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবনযাত্রা খানিকটা অসুবিধাজনক। এ অবস্থার মধ্যে প্রাদেশিক শহর ও অন্যান্য মফস্বল এলাকা থেকে হাজার হাজার লোক নির্মাণ কাজে অংশ নিতে এবং অন্যান্য আকর্ষণীয় ব্যবসা ও শিল্প খাতে আকৃষ্ট হয়ে তেহরান শহরের দিকে বসতি গড়তে থাকে। তেহরানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইরানের বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও অন্য দেশ থেকেও ছাত্ররা পড়তে আসে। এখানে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য হাজার হাজার ছাত্র আসে মফস্বল এলাকা থেকে। বিত্তশালী পরিবারগুলো আরও ভালো ব্যবসা-বাণিজ্য এবং তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুবিধার্থে তেহরানে এসে বসবাস করতে শুরু করে।
দ্রুত বর্ধমান রাজধানী শহরে পরিণত : বিগত চার দশকে তেহরান বিশ্বের একটি দ্রুত বর্ধমান রাজধানী শহরে পরিণত হয়েছে। গগণচুম্বী অট্টালিকা, প্রশস্ত জনপথ, বড় বড় হোটেল-রেস্তোরাঁ, দোকানপাট, বাড়িঘর এবং সেগুলোর সঙ্গে ঘোরানো-পেঁচানো উঁচু নিচু পাহাড়ি ঢাল বেয়ে রাস্তায় ধাবমান যানবাহন। ত্রিশ বছর আগে এ শহরের আকৃতি যা ছিল, তার তুলনায় বর্তমান আকার পাঁচগুণ। সন্ধ্যার পর যে কেউ তেহরানের মিলাদ টাওয়ারে উঠলে পুরো তেহরানের নজরকাড়া সৌন্দর্য তার চোখ এড়াতে পারে না। ৩৬০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে এ টাওয়ারটি নির্মাণ হওয়ার পর পর্যটকদের বেশ নজর কেড়েছে। আজাদি স্কয়ার, তাবিয়াত ব্রিজের মতো স্থানে নগরবাসীরা অবসর সময় কাটাতে ভালোবাসেন। জাপানের রাজধানী টোকিওর পর এখন তেহরানই বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল শহর। এখানে রয়েছে বিপুল সংখ্যক মোটরগাড়ি আর বিপুল সংখ্যক কল-কারখানা। পরিস্থিতি এমন যে, যানবাহন চলাচলের ভিড় এড়ানোর জন্য সরকারকে একটি নয়া ট্রাফিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হয়েছে। এ পরিকল্পনা মোতাবেক দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী বাসসমূহের টার্মিনালগুলো নগরীর কেন্দ্রীয় এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত ট্রাফিক জোনগুলোতে সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে দুপুর দুটো পর্যন্ত বেসরকারি যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ১৯৯১ সালের মার্চ মাসের মধ্যে আগের ১৫ হাজার হেক্টরের স্থলে ২৫ হাজার হেক্টর জমিকে রাজধানী শহরের গ্রীন-বেল্ট হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে।
ফুল ও প্রগতির শহর তেহরান : তেহরানকে বলা হয় ফুলের শহর। পাহাড়ঘেরা তেহরানের প্রকৃতি অনেকটা মরুময়। অথচ রাস্তার দু’পাশে নানা ধরনের গাছগাছালি, ফুল, লতাণ্ডগুল্মের বিপুল সমারোহ। মুক্তোর দানার মতো ছড়িয়ে পড়ে গোলাপের হাসি। যেখানে-সেখানে হাত বাড়ালেই গোলাপ। তেহরান সিটি করপোরেশন থেকে রাস্তার আইল্যান্ডে ঝুলিয়ে দেওয়া ফুলের ঝাঁপি। বিয়ে, জন্মদিন থেকে শুরু করে নানা উৎসব-অনুষ্ঠানে ইরানিরা ফুল ব্যবহার করে। মোড়ে মোড়ে ফুলের দোকান। বিশেষ করে, অর্থনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী ইরান গড়ে তুলতে তেহরান নগরীর রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। দীর্ঘদিন দেশটির ওপর অবরোধ আরোপ থাকায় তা প্রত্যাহারের পর নতুন করে যেন তেহরান জেগে উঠেছে বিদেশি বিনিয়োগ ও পর্যটকদের পদচারণায়। শত শত বিমান কেনার চুক্তি হয়েছে। এসব বিমান অবতরণে একাধিক বিমান বন্দরের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ চলছে। ইউরোপ থেকে মধ্যএশিয়ার দেশগুলো ঘুরে পাঁচ তারকা মানের পর্যটন রেল এরই মধ্যে তেহরানে বেশ কয়েকবার যাত্রা বিরতি করেছে। পার্ক, বাগবাগিচা, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, দেশি-বিদেশি খাবার, ফুল-ফল ও সবজি ছাড়াও দুগ্ধজাত পণ্য যেমন সুস্থ জীবনের নিশ্চয়তা দেয়, তেমনি মনোমুগ্ধকর স্থাপত্যরীতি, নিয়াভারান, গুলিস্তান ও সাদাবাদের মতো ঐতিহাসিক স্থান ও ঐতিহ্যের অফুরন্ত ভাণ্ডার সবসময় বিমোহিত করে রাখে তেহরানবাসীকে।
অনন্যতায় তেহরান ও তার বাসিন্দারা : তেহরানের বাসিন্দাদের ৯৯ ভাগ ফারসি ভাষায় কথা বলেন। কিন্তু নগরীতে আজারবাইজানি, আর্মেনিয়ান, লোর ও কুর্দরা ফারসি ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ব্যবহার করেন। তেহরানের বাসিন্দাদের মধ্যে সরকারি খাতের ৩০ ভাগ কর্মজীবি রয়েছেন। ৪৫ ভাগ শিল্প এ শহরে গড়ে উঠেছে। তেহরান স্টক এক্সচেঞ্জে এখন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ বাড়ছে। ঐতিহাসিক, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক জাদুঘরগুলো অনুসন্ধিৎসু মানুষের পদচারণায় সরব। ন্যাশনাল মিউজিয়াম, মালেক মিউজিয়াম, ফেরদৌস গার্ডেন, গ্লাসওয়ার, সিরামিক মিউজিয়াম, মিউজিয়াম অব দি কাজার প্রিজন, কার্পেট মিউজিয়াম, মিউজিয়াম অব দি গ¬াস পেইন্টিং ও কনটেমপোরারি আর্ট যেন নগরীর বাসিন্দাদের অতীত ও বর্তমান সময়ের মিলনকেন্দ্র। ভ্যানগগ, পাবলো পিকাসো, অ্যান্ডি ওয়ারলের মতো বিখ্যাত শিল্পীদের শিল্পকর্ম সেখানে দর্শকদের মনোরঞ্জন করে। তেহরানের আরেক পরিচয়; কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে নামিদামি মণিমুক্তার সংগ্রহশালা হিসেবে। হিরা, চুনি, পান্নার বিশাল সংগ্রহশালা কেবল নয়, সেন্ট্রাল ব্যাংক অব ইরান রাজকীয় মণিমুক্তার সংগ্রহ দর্শণার্থীদের সামনে উপস্থাপন করে। তেহরানের আন্তর্জাতিক বইমেলা কিংবা চলচ্চিত্র উৎসবের জন্য তাবৎ বিশ্বের অনেকেই অপেক্ষায় থাকেন। এমনকি দেয়ালে বিশেষ ধরনের চিত্র অংকন যা ‘গ্রাফিতি’ হিসেবে পরিচিত, তা পশ্চিমা বিশ্বের মতোই তেহরানে সমান জনপ্রিয়।
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যমকর্মী