ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

শিপব্রেকিং শিল্পে ব্যবসায়ীদের প্রথম পছন্দ বাংলাদেশ

শিপব্রেকিং শিল্পে ব্যবসায়ীদের  প্রথম পছন্দ বাংলাদেশ

শিপব্রেকিং বা জাহাজ ভাঙা শিল্পে দুই শীর্ষস্থানীয় দেশ বাংলাদেশ ও ভারত। কিন্তু পাকিস্তান ও তুরস্কের মতো দেশগুলোও ছোট পরিসরে এই খাতে কাজ শুরু করে বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে। আর এতে চাপে পড়েছে বাংলাদেশ ও ভারত। তুরস্ক ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলো ক্রমশ পরিত্যক্ত জাহাজগুলোর শেষ গন্তব্য হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। তবে বাংলাদেশে জাহাজ ভাঙার কাজ তুলনামূলক কমলেও দেশ এখনো শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। জাহাজ ভাঙা শিল্পের পর্যবেক্ষক এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ভারতে ভাঙার জন্য যে পরিমাণ জাহাজ আনা হয়েছিল, তার সংখ্যা ২০২৩ সালের তুলনায় অনেক কম। একই পরিস্থিতি বাংলাদেশেও। বিপরীতে, তুরস্ক ও পাকিস্তানে জাহাজ ভাঙার সংখ্যা বেড়েছে। শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে ভারতে ১৬৬টি জাহাজ ভাঙা হয়েছিল। ২০২৪ সালে তা কমে ১২৪-এ দাঁড়ায়। একই ভাবে, বাংলাদেশে ২০২৩ সালে ১৭৩টি জাহাজ ভাঙা হলেও ২০২৪ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৩২টিতে। অন্যদিকে, তুরস্কে ২০২৩ সালে ৫০টি জাহাজ ভাঙা হলেও ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৪ টিতে। পাকিস্তানের সংখ্যাও বেড়েছে, ২০২৩ সালে দেশটি মাত্র ১৫টি জাহাজ ভাঙলেও ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪টিতে।

তবে এই শিল্পের অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো বলছে, ভারত ও বাংলাদেশ মূলত বড় আকারের জাহাজ ভাঙার কাজে বিশেষ দক্ষ। আর অন্যান্য দেশগুলো অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। পুরোনো জাহাজ কিনে ভাঙার কাজ করা গ্লোবাল মার্কেটিং সিস্টেমসের ভারত ও বাংলাদেশের প্রতিনিধি কিরণ থোরাট বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের বড় আকারের জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের ক্ষমতা রয়েছে, যা তুরস্কের নেই। লাইট ডিসপ্লেসমেন্ট টনেজ (জাহাজ ভাঙার পর যে ওজন দাঁড়ায়) অনুযায়ী বাংলাদেশ প্রথম স্থানে রয়েছে, এর পর ভারত ও তুরস্কের অবস্থান।’ কিরণ থোরাট আরো বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশ তুরস্কের কাছে বাজার হারাচ্ছে না। শিপ রিসাইক্লিং ব্যবসায় মূলত লাইট ডিসপ্লেসমেন্ট টনেজ বিবেচনা করা হয়। কারণ, এটি জাহাজ ভাঙার প্রকৃত পরিমাণ নির্দেশ করে। তুরস্কে পুনঃ প্রক্রিয়াকৃত জাহাজের সংখ্যা বেশি হলেও এগুলো বেশির ভাগই ছোট এবং কম ওজনের জাহাজ।’ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে থোরাট বলেন, ‘বর্তমানে নয়, তবে দীর্ঘ মেয়াদে এটি ভারতে আরো বেশি জাহাজ আসার সুযোগ তৈরি করতে পারে।’ শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী ভাঙা মোট লাইট ডিসপ্লেসমেন্ট টনেজের প্রায় ৮০ শতাংশই বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের (নগণ্য সংখ্যক) উপকূলে ভাঙা হয়েছে। ২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী ৪০৯টি জাহাজ ভাঙা হয়েছে, যার মধ্যে ২৫৫টি দক্ষিণ এশিয়ার ইয়ার্ডে গিয়েছে। শিপব্রেকিং শিল্পে এখনো ব্যবসায়ীদের প্রথম পছন্দ বাংলাদেশ এবং ভারত দ্বিতীয় অবস্থানে। ২০২৪ সালে ‘ডাম্পারস লিস্ট’ অর্থাৎ জাহাজ বাতিলের তালিকায় থাকা শীর্ষ দেশ চীন। দেশটি দক্ষিণ এশিয়ার শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে, বিশেষ করে বাংলাদেশে, প্রায় ৫০টি জাহাজ বিক্রি করেছে। এটি এমন এক সময়ে ঘটছে যখন চীন তার নিজস্ব ড্রাই ডক সুবিধা থাকার পরও বর্জ্য আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি রেখেছে। উল্লেখ্য, চীনে ‘বিচিং’ প্রক্রিয়া অর্থাৎ, পুরোনো জাহাজ সমুদ্র উপকূলে ফেলে রাখা নিষিদ্ধ।

এদিকে, ভারতের গুজরাটের আলাঙ্গে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জাহাজ ভাঙার ইয়ার্ডের পরিস্থিতি খুব একটা ভালো নয়। চলতি মাসের শুরুতে সেখানে ৪৯ হাজার মেট্রিক টনের একটি বিশাল ফ্লোটিং প্রোডাকশন স্টোরেজ অ্যান্ড অফশোর ভেসেল ‘টাকুন্টাহ’ আনা হয়েছে। এটি স্বস্তির বার্তা নিয়ে এলেও, আলাঙ্গের দীর্ঘদিনের শিপব্রেকিং ব্যবসায়ী মুকেশ প্যাটেলের কপালে চিন্তার ভাঁজ। মুকেশ বলেন, ‘এটি আলাঙ্গে আসা সবচেয়ে বড় ফ্লোটিং প্রোডাকশন স্টোরেজ অ্যান্ড অফশোর ভেসেল। এটি আমাদের জন্য স্বস্তিদায়ক। আমরা যখন আমাদের মোট সক্ষমতার ৫০ শতাংশেরও কম ব্যবহার করছি, ঠিক এমন এক সময়ে এই ভেসেলটি এসেছে। তবে সামগ্রিকভাবে আলাঙ্গের অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে।’ ১৯৯২ সাল থেকে শিপব্রেকিং ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত প্যাটেল জানান, ২০১২ সালে সর্বোচ্চ ৪১৫টি জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ করা হয়েছিল। তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশে সংকট তৈরি হলেও, ভারতীয় শিপব্রেকাররা এর সুবিধা নিতে পারেনি। খারাপ সরকারি নীতিই আলাঙ্গের বর্তমান সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ। আগে আমাদের প্লটে একসঙ্গে ৮-১০টি জাহাজ থাকত, এখন সেই সংখ্যা কমে মাত্র ৩-৪ টিতে নেমে এসেছে। আমরা কৃতজ্ঞ যে এখনো ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারছি, অন্যথায় অনেক শিপব্রেকারই ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন।’

প্রসঙ্গত, প্যাটেল ২০২০ সালে ভারতের পুরোনো বিমানবাহী রণতরি ‘বিরাট’ ভাঙার কাজ করেছেন। দিনকে দিন আলাঙ্গের ব্যবসা কমছে। ভারতের চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে, অর্থাৎ ২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র ৮২টি জাহাজ ভাঙার জন্য এসেছে। গুজরাট মেরিটাইম বোর্ডের (জিএমবি) তথ্য অনুসারে, এই সংখ্যা আগের বছরের একই সময়ে আসা ৯৭টি জাহাজের তুলনায় ১৫ শতাংশ কম। ২০১১-১২ অর্থবছরে আলাঙ্গের জাহাজভাঙা শিল্প সর্বোচ্চ জাহাজ ভাঙার রেকর্ড গড়েছিল। সেই সময়ে ৪১৫টি জাহাজ, যার মোট ওজন ছিল সাড়ে ৩৮ লাখ টন ভাঙার জন্য এসেছিল। এর পর থেকেই শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের কর্মদক্ষতা ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। গত কয়েক বছরে পর্যাপ্ত জাহাজ আকর্ষণ করতে না পারায় শিপ-ব্রেকার হরেশ পারমার তিন বছর আগে তার শিপব্রেকিং ইয়ার্ড বন্ধ করে দেন। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে তিনি ব্যবসা পুনরায় চালু করার চেষ্টা করেও কিন্তু ব্যর্থ হন। তিনি বলেন, ‘আমি জানুয়ারিতে আমার ইয়ার্ড চালু করার জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের উপকূলে নোঙর করা একটি জাহাজ কেনার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সেটি বেশি মূল্যে পাকিস্তানে চলে যায়।’ পারমার আরো বলেন, ‘আলাঙ্গে শিপব্রেকিং কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। এখানে থাকা ১৫৩টি শিপব্রেকিং প্লটের মধ্যে মাত্র ২০-২৫টি প্লটে জাহাজ ভাঙার কাজ চলছে। বাকিগুলো খালি পড়ে আছে।

এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের শিপ-ব্রেকাররা আমাদের তুলনায় পুরোনো জাহাজ বেশি দামে কিনতে পারছেন। আমাদের সরকারি নীতির কারণে, ভাঙা জাহাজ থেকে পাওয়া স্টিল দিয়ে সরাসরি টিএমটি বার তৈরি করা যায় না। প্রথমে তা গলিয়ে বিলেট তৈরি করতে হয়, তার পর তা থেকে টিএমটি বার বানাতে হয়। এতে প্রতি টনে আমাদের উৎপাদন খরচ ৫০০০-৬০০০ রুপি বেশি পড়ে। তুলনামূলকভাবে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে ভাঙা জাহাজের স্টিল থেকে সরাসরি টিএমটি বার তৈরি করার অনুমতি আছে, ফলে তারা বেশি দামে পুরোনো জাহাজ কিনতে সক্ষম হচ্ছে।’

পারমার আরো বলেন, ‘দ্বিতীয়ত, লোহিত সাগর অঞ্চলে ইসরায়েল-সংক্রান্ত উত্তেজনার কারণে পণ্য পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে। ফলে শিপিং কোম্পানিগুলো পুরোনো জাহাজগুলো ভাঙার জন্য পাঠানোর পরিবর্তে সেগুলো দিয়েই পণ্য পরিবহন চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে বাজারে পুরোনো জাহাজের সরবরাহ কমে গেছে।’

আলাঙ্গের শিপব্রেকাররা আরো জানিয়েছেন, বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সংকটের সুযোগ ভারত নিতে পারেনি। তারা বলেন, ‘স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশ সংকটের কারণে ভারত লাভবান হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে, আরো বেশি পুরোনো জাহাজ আমাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশেই চলে যাচ্ছে।’ বাল্টিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম কাউন্সিলের (বিআইএমসিও) সভাপতি নিকোলাস শুজ সম্প্রতি দ্য হিন্দু বিজনেসলাইনকে জানিয়েছেন, হংকং ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য সেফ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টালি সাউন্ড রিসাইক্লিং অব শিপস কার্যকর হতে যাচ্ছে এবং সব রিসাইক্লিং ইয়ার্ডকে এর শর্ত মেনে চলতে হবে। এই পরিবর্তন বৈশ্বিক শিপ রিসাইক্লিং শিল্পের ভবিষ্যৎ বদলে দেবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত