মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক এবং মাহমুদউল্লাহ- এই ‘পঞ্চপান্ডব’ যুগে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে হয়ে উঠেছিল এক সমীহ জাগানিয়া দল। তখন ওয়ানডে সংস্করণে টাইগারদের সমীহ করত ক্রিকেটের পরাশক্তিরাও। একে একে তারা চলে গেছেন অবসরে। দলও হারিয়ে ফেলেছেন শক্তি, সামর্থ আর লড়াই করার মানসিকতা। ফলে নিজেদের একসময়ের সফলতম সংস্করণ ওয়ানডে ক্রিকেটে গত কয়েক বছর ধরে রীতিমত ধুকছে বাংলাদেশ। একের পর এক হতাশাজনক পারফরম্যান্সে বড় ধাক্কা লেগেছে আইসিসি র্যাংকিংয়েও। কঠিন সময়ে লাল সবুজের ওয়ানডে দলে নেতৃত্ব বদল হয়েছে। ওয়ানডে দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পেয়েছেন মেহেদী হাসান মিরাজ। দায়িত্ব পেয়ে গতকাল শুক্রবার প্রথমবার সংবাদ সম্মেলনে আসেন এই অলরাউন্ডার। সেখানে তিনি কীভাবে কাজ করবেন, নেতৃত্বে কীভাবে নিজেকে মানিয়ে নিতে চান, তরুণদের কিভাবে কাজে লাগাবেন, কোন অভিজ্ঞতা তাকে পথ দেখাবে সেটা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে কথা বলেন নতুন এই অধিনায়ক। দলকে ভালো একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন মিরাজ। আগামী মাসে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ দিয়ে শুরু হবে মিরাজের এক বছরের যাত্রা। সব ঠিক থাকলে এই মেয়াদে তার নেতৃত্বে ২১টি ওয়ানডে খেলবে বাংলাদেশ। এরপর মেয়াদ বাড়লে হয়তো ২০২৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপ পর্যন্ত দায়িত্বে থাকতে পারেন ২৭ বছর বয়সী অলরাউন্ডার। তবে আপাতত এক বছরে চোখ রাখছেন মিরাজ। ওয়ানডেতে সাম্প্রতিক সময়ে একের পর বাজে সিরিজ ও টুর্নামেন্ট কাটিয়েছে বাংলাদেশ। ২০২৩ বিশ্বকাপে মাত্র দুই ম্যাচ জিতেছে তারা। চলতি বছরের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে জয় নেই একটিও। দ্বিপাক্ষিক লড়াইয়েও মেলে শুধুই হতাশা। সব মিলিয়ে ২০২৩ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ৪৩ ম্যাচে বাংলাদেশের জয় মাত্র ১৪টি। সবশেষ অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তর নেতৃত্বে ১৩ ম্যাচে তারা জিততে পারে স্রেফ চারটিতে।
মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে তার কাছে জানতে চাওয়া হলো, অধিনায়কত্বের মেয়াদ ২০২৭ বিশ্বকাপ পর্যন্ত পেলে ভালো হতো কিনা? ক্রিকেট বোর্ডের কোর্টে বল ঠেলে দিয়ে অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার বললেন, বাজে সময় কাটিয়ে উঠতে এক বছরের মধ্যে প্রয়োজনীয় সব কিছু করার বিশ্বাস আছে তার। ‘লম্বা সময় (দায়িত্বে) পেলে ভিশন ভালো থাকে। সামনে ওয়ানডে বিশ্বকাপ আছে। যেহেতু দল হিসেবে আমরা এখন একটু সংগ্রাম করছি, তাই বোর্ড হয়তো ভেবেছে এক বছরে একটা জায়গায় দাঁড় করাই দলকে। এরপর হয়তো পরবর্তী ধাপ দেখবে কন্টিনিউ করবে না কী করবে। এখন সময় এসেছে ওয়ানডে দলকে একটা জায়গায় দাঁড় করানোর। আমাদের দুজন সিনিয়র ক্রিকেটার (মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ) অবসর নিয়েছেন। যারা সুযোগ পাবে তাদেরকে এই জিনিসগুলো বা কারা সুযোগ পাবে, আমার মনে হয় এক বছরের মধ্যে সেট করা যাবে।’
জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব অবশ্য আগেও করেছেন মিরাজ। গত বছর শান্তর চোটে প্রথমে আফগানিস্তানের বিপক্ষে শেষ ওয়ানডে, পরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে তিন ওয়ানডে ও দুই টেস্টে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। ওয়ানডেতে জয়ের মুখ দেখেননি ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক। তবে টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে স্মরণীয় সাফল্য পান তিনি। তবে ব্যর্থতাময় ওই চার ওয়ানডে থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েই বাংলাদেশকে সুন্দর জায়গায় দাঁড় করানোর আশা মিরাজের। ‘একটা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমার অধিনায়কত্ব অভিষেক হয়েছিল। শান্ত অধিনায়ক ছিল। ও চোটে পড়েছিল দেখেই ওয়েস্ট ইন্ডিজে আমাকে দেয়া হয়েছিল। ওইরকম পরিস্থিতিতে একটু কঠিন। কারণ হঠাৎ অধিনায়কত্ব করেছি। আর সেট-আপ ও পরিকল্পনা পুরো শান্তরই ছিল। আমার শুধু মাঠ চালাতে হয়েছে। অবশ্যই ওই চার ম্যাচে আমার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। লম্বা সময়ের জন্য পেলে একটু ভালো হয়। কারণ দলকে বুস্ট আপ করা যায় কীভাবে করলে ভালো হবে। এখন যেহেতু এক বছরের জন্য পেয়েছি, চেষ্টা করব দলকে সুন্দর একটা জায়গায় দাঁড় করাতে।’
মুশফিকুর রহিমের অধিনায়কত্বে টেস্ট, মাশরাফি বিন মুর্তজার নেতৃত্বে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক মেহেদী হাসান মিরাজের। সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মাহমুদউল্লাহর নেতৃত্বেও খেলেন স্পিনিং অলরাউন্ডার। এবার নিজে দায়িত্ব পেয়ে অগ্রজ সতীর্থদের থেকে পাওয়া শিক্ষা কাজে লাগানোর কথা বললেন মিরাজ। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যেকোনো ভালো পারফরম্যান্সের পর সংবাদ সম্মেলন বা সাক্ষাৎকারে প্রায়ই সিনিয়র ক্রিকেটারদের অবদান তুলে ধরেন মিরাজ। তাদের থেকে পাওয়া পরামর্শ মাঠে কাজে লাগিয়ে সফল হওয়ার কথা প্রায়ই বলেন ২৭ বছর বয়সী অলরাউন্ডার।
মাশরাফি বিন মর্তুজার নেতৃত্বে অভিষেক হয়েছিল মিরাজের। এরপর খেলেছেন সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবালের অধীনেও। পাশাপাশি মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদদের মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের নেতৃত্বগুণও দেখেছেন সামনে থেকে। দেশের সেরা পাঁচ ক্রিকেটারের সঙ্গেই ড্রেসিংরুম ভাগাভাগি করেছেন। তাদের কাছ থেকে অনেক কিছুই নিতে পেরেছেন। মিরাজ যখন ওয়ানডে অভিযান শুরু করেন তখন বাংলাদেশ এই ফরম্যাটে দারুণ দল। অথচ এখন নিজেদের সেরা ফরম্যাটেই খাবি খাচ্ছে দল।
এমন সময়ে জাতীয় দলের ওয়ানডে নেতৃত্ব পেয়েছেন মিরাজ। মাত্র এক বছরের জন্য হলেও এই চ্যালেঞ্জটা বিশাল। সফল হলে বাহবা নয়তো কালিমা। মিরাজ অবশ্য ঠিক করেছেন পড়তি ফর্ম দূর করবেন। সুদিন ফেরাবেন। আর তাই অভিজ্ঞদের থেকে নেওয়া শিক্ষা কাজে লাগাবেন। প্রায় সাড়ে ৮ বছরের ক্যারিয়ারে প্রথমবার পূর্ণাঙ্গ মেয়াদে ওয়ানডে অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে মিরাজ বললেন, সাবেক অধিনায়কদের পাওয়া শিক্ষা নিজের নতুন পরিচয়ে কাজে লাগাতে চান তিনি। ‘মাশরাফি ভাইয়ের অধিনায়কত্বে আমার (ওয়ানডে) অভিষেক হয়েছে। অনেক অধিনায়ককে পেয়েছি আমি। এটা আমার জন্য ভালো লাগার বিষয়। তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। যেটা আমি হয়তো আমার এই অধিনায়কত্বে কাজে লাগাতে পারব।’
সময়ের পালাক্রমে তিনি এখন দলের অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের একজন। এর সঙ্গে পেয়েছেন ওয়ানডে দলের অধিনায়কত্ব। তাই দলের তরুণ ক্রিকেটারদের অনুপ্রাণিত করা কিংবা যেকোনো প্রয়োজনে পরামর্শ দেওয়ার কাজও করতে হবে। সেই দায়িত্ব পালনে ড্রেসিং রুমের মধ্যে সবাইকে আগলে রেখে এগিয়ে যেতে চান মিরাজ। ‘এখন আমাদের অবশ্যই দায়িত্ব নেওয়ার সময় এসেছে। আমরা যথেষ্ট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্রিকেট খেলেছি, প্রায় ৮-৯ বছর ধরে খেলছি। যারা জুনিয়র আছে তাদের অবশ্যই পারফর্ম করতে হবে, ওই পরামর্শগুলো দেবো। আমরা যখন প্রথম দলে ঢুকেছি, বড় ভাইরা আমাদের যেভাবে সাহায্য করেছে, চেষ্টা করব সেভাবে (জুনিয়রদের) সাহায্য করার, ড্রেসিংরুমটা ওভাবে রাখার। যেন যে-ই ড্রেসিংরুমে থাক না কেন, সে যেন অনুভব করে যে, আমি একা নই, আমার সঙ্গে সবাই আছে।’ তিন সংস্করণ মিলিয়ে এখন পর্যন্ত সাকিবের অধিনায়কত্বে সবচেয়ে বেশি ৪১ ম্যাচ খেলেছেন মিরাজ। এছাড়া ৩৮ ম্যাচে তার অধিনায়ক ছিলেন মাশরাফি আর ৩৫টিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন তামিম। নানান সময়ে খুব কাছ থেকে তাদের বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতি সামাল দিতে দেখেছেন মিরাজ। সেই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে যে কোনো শক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আশা অভিজ্ঞ স্পিনিং অলরাউন্ডারের। ‘তাদের (সিনিয়র ক্রিকেটার) থেকে অনেক কিছু শিখেছি।
যেটা আমার ক্যারিয়ারে অনেক কাজে লেগেছে। বিশেষ করে তারা কীভাবে অধিনায়কত্ব করেছেন, এই জিনিসগুলো আমার ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। তারা যেভাবে কঠিন সিদ্ধান্তগুলো নিতেন, সেগুলো অনুসরণ করেছি। অনেক সময় কঠিন পরিস্থিতিতে শক্ত সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় পক্ষে আসবে, অনেক সময় আসবে না। আপনি সিদ্ধান্তগুলো কীভাবে নিচ্ছেন, সেটি গুরুত্বপূর্ণ।’