একটা পুরোনো বাংলা রূপকথা আছে- রাক্ষসটা বলত, ‘আমি দূরে যাচ্ছি’, তারপর এক লাফে ফিরে এসে দাঁড়াত দরজার সামনে। আর যখন বলত, ‘আমি কাছেই থাকব’, তখন সে এমনভাবে গা ঢাকা দিত যেন হাওয়ার সঙ্গে হাওয়াও খুঁজে না পায়। সেই রাক্ষসের আধুনিক সংস্করণ হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। মুখে বলছিলেন- ইরানের সঙ্গে আলোচনা চলছে, পারমাণবিক বোমা নয়, শান্তির পথে হাঁটছি। আর আড়ালে ইসরায়েলকে বলে দিয়েছেন, ‘তোমরা প্রস্তুত থেকো, দরজা খুললেই ঢুকে পড়ো।’ আলাপ শেষ হওয়ার আগেই ইসরায়েল মঞ্চে ঢুকে নাটকের শুরুটা করে দিল। তাই ট্রাম্প যখন বলেন ‘আমি অপেক্ষা করব’, তখন দুনিয়ার সবাই জানে- এটা আসলে একটা ‘টাইম বোমা’র কাউন্টডাউন মাত্র।
এক সপ্তাহও পেরোল না, এর মধ্যেই ট্রাম্পের ঘোষিত দুই সপ্তাহের অপেক্ষার নিষ্ঠুর অবসান ঘটল। আবারো প্রমাণিত হলো- ট্রাম্প মুখে যা বলেন, কাজে করেন ঠিক তার উল্টো। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। ১৫ দিনের সময়সীমা ঘোষণা করলেও ছয় দিনেই ইরানে হামলা চালাল যুক্তরাষ্ট্র। অনেকেই অনুমান করেছিলেন- ট্রাম্প ইরানে হামলা করবেনই। সেটা তখন হোক বা এখন, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির খুব বেশি বদল হতো না। ইরান আগেই জানিয়ে দিয়েছিল, তারা নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করবে না।
ইরানের সামনে বাস্তবিক অর্থে ভালো কোনো বিকল্পও ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রকে ঠেকানোর মতো যুদ্ধসরঞ্জাম তাদের নেই। আবার ট্রাম্পের ‘সমর্পণ’ দাবি মেনে নিলেও তা হতো আরও অপমানজনক। অন্যদিকে, ট্রাম্পেরও পিছু হটার সুযোগ ছিল না হয়তো। ট্রাম্পের প্রিয় দেশ ইসরায়েল- সেখানেই তার দুই মেয়ের শ্বশুরবাড়ি। আর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার বহুদিনের বন্ধু। ইরান সমানতালে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি অংশ না নিলে ইসরায়েলের পক্ষে ইরানের পরমাণু কার্যক্রম প্রতিহত করা সম্ভব হতো না।
এজন্য ট্রাম্প বি-২ বোমারু বিমান ব্যবহার করে শক্তিশালী ক্লাস্টার বোমা ফেলে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন- ফোরদো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহান। বিশেষভাবে, ফোরদোর মাটির নিচের কেন্দ্রে অন্তত ছয়টি ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে। তবে ফোরদোকে যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি ধ্বংস করতে পেরেছে কিনা যথেষ্ট সংশয় রয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) বলেছে, এই হামলার পর আশপাশের এলাকায় তেজষ্ক্রিয়তার মাত্রা বাড়ার কোনো প্রমাণ মেলেনি। এটি নিঃসন্দেহে স্বস্তির খবর। তবে এখান থেকে আরও কিছু অনুমানও করা যায়। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের হামলার ঠিক আগে ইরানের ফোরদো কেন্দ্র ঘিরে কিছু তৎপরতা দেখা গিয়েছিল, যা উপগ্রহচিত্রেও ধরা পড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, হামলার আগেই ইরান তাদের ইউরেনিয়াম এবং দুষ্প্রাপ্য যন্ত্রাংশ সরিয়ে ফেলেছে।
ওয়াশিংটন পোস্টের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র ব্যাক চ্যানেলের মাধ্যমে ইরানকে আগেই জানিয়ে দেয় যে হামলা হবে শুধু ওই তিনটি স্থাপনায় এবং এরপর যুক্তরাষ্ট্র থেমে যাবে- যদি না ইরান কোনো মার্কিন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায়। ইরানের পাল্টা প্রতিশোধের লক্ষ্যবস্তু মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক, সৌদি আরব, ওমান ও কাতারের ঘাঁটি। এসব ঘাঁটিতে হামলা করে ইরান কিছুটা ক্ষতি করতে পারলেও, তা যুদ্ধকে আরও ঘনীভূত করে তুলবে এবং ইরানের জন্য লাভজনক হবে না।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি রোববার রাশিয়া গেছেন এবং সোমবার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তবে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পুতিন নিজেই ট্রাম্পের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায়, রাশিয়ার পক্ষ থেকে বিশেষ সহায়তা আসবে- এমন আশা করাটা বাস্তবসম্মত নয়। ইরান রাশিয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘সম্মানসূচক’ আলোচনায় বসতে পারে- এটি আপাত উত্তরণের একটি পথ হতে পারে।
সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, ইরানের পার্লামেন্ট হরমুজ প্রণালী বন্ধের পক্ষে ভোট দিয়েছে। এখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ। রয়টার্সের খবর বলছে, যুক্তরাষ্ট্র এই পদক্ষেপ থেকে ইরানকে বিরত রাখতে চীনকে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
বিশ্বের ২০ শতাংশ জ্বালানি তেল এই হরমুজ প্রণালী দিয়ে রপ্তানি হয়, ফলে এটিতে সামান্য বিশৃঙ্খলাও বিশ্ব অর্থনীতিতে বিরাট প্রভাব ফেলতে পারে। যদিও ইরানের অর্থনীতিতেও এর একটা প্রভাব পড়বে, তবে এটি যুক্তরাষ্ট্রকে আলোচনায় টানার কৌশল হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এনবিসিকে বলেন, ‘ইরানের সঙ্গে আমাদের কোনো যুদ্ধ নেই, আমাদের যুদ্ধ ইরানের পরমাণু অস্ত্রের বিরুদ্ধে।’
ইরানের সব শেষ হয়ে যায়নি। তাদের উচিত প্রতিরক্ষা শক্তিকে আরও সবল করা। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রাখলে কিছুটা চাপমুক্ত থাকতে পারবে তারা। ট্রাম্পের নিজ দল রিপাবলিকান পার্টির নেতারা তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। ডেমোক্র্যাটরা কংগ্রেসের অনুমোদন না নিয়ে যুদ্ধের সিদ্ধান্তে সামান্য আপত্তি তুললেও, তারা যে খুব একটা অখুশি তা-ও নয়।
যুদ্ধ শুরুর আগে করা ইকোনমিস্ট-ইউগভ জরিপে দেখা যায়, ৫০ শতাংশ আমেরিকান মনে করেন ইরান যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু, ২৫ শতাংশ মনে করেন বন্ধুসুলভ নয়, মাত্র ৫ শতাংশ ইরানকে বন্ধু মনে করেন। তবে মাত্র ১৬ শতাংশ মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রকে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে জড়ানো উচিত, বিপক্ষে ৬১ শতাংশ। ইকোনমিস্ট-ইউগভ জরিপ মূলত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি নিয়মিত যৌথ জরিপ। প্রতি সপ্তাহে আমেরিকান নাগরিকদের রাজনৈতিক অবস্থান, প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তা, আন্তর্জাতিক বিষয়ে মতামতসহ নানা বিষয়ের তথ্য সংগ্রহ করে তারা। জরিপের ফলাফলে বোঝা যায়, এই যুদ্ধে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা বাড়বে- এমনটা বলার সুযোগ নেই।
মজার বিষয় হলো, ইরানে বোমা ফেলার ১২ ঘণ্টা আগে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা দেয়, তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করবে। ট্রাম্প নিজেও দাবি করেন, ভারত-পাকিস্তান সংঘাত নিরসনে সহায়তা করার জন্য তিনি এই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। মাত্র কয়েকদিন আগে ট্রাম্পের সঙ্গে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের সাক্ষাৎ ও মধ্যাহ্নভোজ হয়েছে হোয়াইট হাউসে। অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান যেখানে সাক্ষাৎ চেয়ে ব্যর্থ হয়েছেন, সেখানে পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের জন্য এমন আতিথেয়তা ব্যতিক্রমী সম্মান। রুদ্ধদ্বার বৈঠকে যে কড়া বার্তা দেওয়া হয়েছে- তা অনুমান করা কঠিন নয়।