ঢাকা বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মেধার পলায়ন : বাংলাদেশের জাতীয় সংকট ও করণীয়

মো: শামীম মিয়া
মেধার পলায়ন : বাংলাদেশের জাতীয় সংকট ও করণীয়

বাংলাদেশ আজ এক অভূতপূর্ব উন্নয়নের পথে। অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক নানা চ্যালেঞ্জকে পেছনে ফেলে আমাদের দেশ দ্রুত এগিয়ে চলছে। অবকাঠামো উন্নয়ন, ডিজিটালাইজেশন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি- সবক্ষেত্রে অর্জন চোখে পড়ার মতো। তবে এই অগ্রগতির পেছনে রয়েছে দেশের প্রাণশক্তি, তরুণ প্রজন্মের মেধা ও উদ্ভাবনী সক্ষমতা। কিন্তু খুবই দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এই মেধা আজ দেশের বাইরে পালাচ্ছে। ‘মেধা পাচার’ বা ব্রেইন ড্রেইন আমাদের জন্য শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়, বরং এক ভয়ংকর জাতীয় সংকট।

বিশ্ববিদ্যালয় সমাপনী, উচ্চশিক্ষা কিংবা গবেষণার জন্য প্রতিবছর লক্ষাধিক তরুণ দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশে যাচ্ছে। ইউনেস্কোর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর ৫২ হাজারের অধিক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য দেশ ছেড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা এই তালিকার শীর্ষে। ২০০৮ সালে যখন মাত্র ১৬ হাজারের মতো শিক্ষার্থী বিদেশে গিয়েছিল, আজ সে সংখ্যা প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু শিক্ষাই নয়, উচ্চপদস্থ পেশাজীবী, বিজ্ঞানী ও গবেষকরা অনেক সময় বিদেশে স্থায়ীভাবে গিয়ে বসবাস করছেন। এসব মেধাবীর অনেকেই দেশে ফেরার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন, যা দেশের সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী শক্তির জন্য বড় ধরনের ক্ষতি।

মেধা পলায়নের কারণ : গঠনমূলক সংকট ১. গুণগত শিক্ষার অভাব ও গবেষণার সুযোগ কম :

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখনও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরীক্ষাভিত্তিক এবং রুটিনভিত্তিক। সৃজনশীলতা, গবেষণা ও উদ্ভাবনী চিন্তার বিকাশের সুযোগ কম। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক গবেষণাগার, আর্থিক সম্পদ ও আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষকশক্তি সীমিত। ফলে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য মেধাবীরা বিদেশের উন্নত পরিবেশের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছেন।

২. অস্থিতিশীল শিক্ষাঙ্গন ও রাজনৈতিক প্রভাব : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক দখলদারিত্ব, ছাত্ররাজনীতি থেকে শুরু করে সংঘাত, চাঁদাবাজি ও অনিয়ম মেধাবীদের নিরাপত্তা ও মনোযোগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। দলীয় কোন্দল শিক্ষার পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলেছে।

৩. অপ্রতুল কর্মসংস্থান ও বেতন বৈষম্য : বাংলাদেশে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য চাকরির সুযোগ সীমিত। কর্মক্ষেত্রে যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়ন হয় না। বেতন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও বিদেশের তুলনায় অনেক কম। ফলে যোগ্য যুবকরা বিদেশে স্থায়ী হওয়ার প্রলোভনে পড়ে।

৪. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের সীমাবদ্ধতা : অনেক সময় মেধাবীরা পরিবেশগত চাপ, সামাজিক অগ্রগতি ও স্বাধীন চিন্তার অভাবেও দেশ ত্যাগ করেন।

মেধা পাচারের ফলে বাংলাদেশের গবেষণা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি ও শিল্প খাতে অভাব তৈরি হচ্ছে। দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি জাতীয় উন্নয়নকে ব্যাহত করছে। যদিও প্রবাসী কর্মীদের রেমিট্যান্স অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক; কিন্তু তা দীর্ঘমেয়াদে মেধাশূন্যতা প্রতিস্থাপন করতে পারে না।

করণীয় এবং ভবিষ্যতের জন্য দিকনির্দেশনা : সরকারকে উচ্চশিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত অর্থায়ন, আধুনিক ল্যাব ও প্রশিক্ষণব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও জরুরি। শিক্ষাঙ্গনে স্বায়ত্তশাসন ও রাজনৈতিক প্রভাব মুক্তির জন্য পদক্ষেপ। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা, ছাত্ররাজনীতির অপব্যবহার রোধ করা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

কর্মসংস্থান ও বেতন কাঠামো উন্নয়ন দক্ষ যুবকদের জন্য যোগ্যতাভিত্তিক চাকরির সুযোগ বাড়াতে হবে। বেতন ও অন্যান্য সুবিধা উন্নত করে কর্মক্ষেত্রে উৎসাহিত করতে হবে। ‘রিভার্স ব্রেইন ড্রেইন’ উদ্যোগ গ্রহণ বিদেশে থাকা মেধাবীদের দেশে ফিরে আসার জন্য প্রণোদনা, কর সুবিধা ও গবেষণার সুযোগ তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি তাদের কাজের মান উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় সহায়তা দিতে হবে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হলে দেশের মেধাকে সঠিক মূল্যায়ন ও সুযোগ দেওয়া আবশ্যক। মেধার এ পলায়ন বন্ধ করা না গেলে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হবে। এককথায় বলতে গেলে, দেশের মেধাবী তরুণই দেশের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। তাদের পাশে দাঁড়ানো এবং দেশের প্রতি ফেরানোর পরিবেশ তৈরিই হবে জাতীয় অগ্রগতির মূল চাবিকাঠি। আমাদের দায়িত্ব এখনই মেধাকে মর্যাদা দিয়ে দেশকে মেধাবী প্রজন্মের দেশ হিসেবে গড়ে তোলা, যাতে আগামীকাল হয় উন্নত, সমৃদ্ধ ও প্রতিযোগিতামূলক। দেশের মেধা যদি বিদেশে হারিয়ে যায়, তাহলে দেশের স্বপ্ন আর কত দূরে?

লেখক : শিক্ষার্থী ফুলছড়ি সরকারী কলেজ, জুমারবাড়ী, সাঘাটা, গাইবান্ধা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত