১৯৯৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মিনি বিশ্বকাপ খ্যাত উইলস ইন্টারন্যাশনাল কাপ ক্রিকেটের প্রথম আসরের শিরোপা জিতেছিল হান্সি ক্রনিয়ের দক্ষিণ আফ্রিকা। বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট হলেও সেটি তো আর বিশ্বকাপ ছিল না, যে টুর্নামেন্টের বর্তমান নাম আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। এরপর বৈশ্বিক ক্রিকেট টুর্নামেন্টে ১৪টি নকআউট ম্যাচে হারের স্বাদ পেয়েছে প্রোটিয়ারা। এর মাঝে ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে হেরে তাদের ললাটে জুড়ে গিয়েছে ‘চোকার্স’ তকমা। একের পর এক বিশ্বকাপ ব্যর্থতায় সেই তকমার আঠা আরও গাঢ় হয়েছে। বড় ম্যাচের চাপ নিতে পারেননি অ্যালান ডোনাল্ড, শন পোলক, জ্যাক ক্যালিসরা। একের পর এক সেমিফাইনালে হেঁটেছে মাথা নিচু করে, যারা ৯বার আইসিসির বড় মঞ্চে হতাশার গল্প লিখেছে। ২০২৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল হারার পর আরও একবার কান্নায় ভেসেছিলেন তারা।
অবশেষে ‘চোকার্স’ অপবাদ ঘোচালেন টেম্বা বাভুমারা। গতকাল শনিবার সবচেয়ে বেশি ট্রফিজয়ী অস্ট্রেলিয়ার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিল ‘ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের’ মুকুট। দিনের তৃতীয় ওভারে টেম্বা বাভুমার বিদায়। পরে ট্রিস্টান স্টাবসের আউটে লড়াইয়ে উত্তেজনা ফিরল কিছুটা। তবে নাটকীয় বা অসাধারণ কিছু করে দেখাতে পারল না অস্ট্রেলিয়া। এইডেন মার্করামের বীরোচিত ইনিংসে আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের মুকুট জিতল দক্ষিণ আফ্রিকা। একই সঙ্গে কাটল তাদের প্রায় ২৭ বছরের আইসিসি ট্রফি-খরা।
ক্রিকেট-তীর্থ লর্ডসে ২০২৩-২৫ চক্রের ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার জয় ৫ উইকেটে। ২৮২ রানের লক্ষ্য চতুর্থ দিনের প্রথম সেশনে ছুঁয়ে ফেলে বাভুমার দল। সেই ১৯৯৮ সালে আইসিসি নকআউট বিশ্বকাপের (এখনকার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি) প্রথম আসরে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর এই প্রথম কোনো বৈশ্বিক ট্রফি জিততে পারল দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দল। প্রোটিয়াদের স্মরণীয় এই সাফল্যের নায়ক মার্করাম। প্রথম ইনিংসে শূন্য রানে ফেরার পর, লক্ষ্য তাড়ায় ১৪ চারে ২০৭ বলে ১৩৬ রানের ইনিংস খেলে জয় থেকে স্রেফ ৬ রান দূরে থাকতে বিদায় নেন এই ওপেনার।
বড় অবদান রাখেন অধিনায়ক বাভুমাও। তৃতীয় দিন ব্যাটিংয়ের সময় হ্যামস্ট্রিংয়ে টান লাগে তার। হাঁটছিলেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। তার পরও চালিয়ে যান ব্যাটিং। ১৩৪ বলে ৫ চারে ৬৬ রানের দায়িত্বশীল ইনিংস খেলেন তিনি। তৃতীয় উইকেটে মার্করাম ও বাভুমার ২৫০ বল স্থায়ী ১৪৭ রানের দুর্দান্ত জুটিই মূলত গড়ে দেয় ম্যাচের ভাগ্য।
তৃতীয় দিনেই কাজ অনেকটা এগিয়ে রাখে দক্ষিণ আফ্রিকা। চতুর্থ দিন শনিবার জয়ের জন্য ৮ উইকেট হাতে নিয়ে প্রয়োজন ছিল ৬৯ রান। অনায়াসে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে যায় তারা। দিনের শুরুটা যদিও তাদের জন্য সুখকর ছিল না। আগের দিনের সঙ্গে আর এক রান যোগ করেই মিচেল স্টার্কের চমৎকার ডেলিভারিতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন বাভুমা। আগের দিন ১০২ রানে অপরাজিত থাকা মার্করাম দলকে এগিয়ে নেন স্টাবসের সঙ্গে জুটি বেঁধে। স্টার্কের বলে স্টাবস বোল্ড হয়ে ফেরেন যখন, তখনও জয় থেকে ৪১ রান দূরে দক্ষিণ আফ্রিকা। অস্ট্রেলিয়া হয়তো আশায় বুক বাঁধছিল নতুন করে। তবে তাদের কোনো সুযোগ দেননি মার্করাম। ডেভিড বেডিংহ্যামকে সঙ্গে নিয়ে দলকে জয়ের দুয়ারে নিয়ে যান তিনি। বাকিটা সারেন বেডিংহ্যাম ও কাইল ভেরেইনা।
স্কোর সমান হওয়ার পর আরেকটি উইকেট যদিও পেতে পারত অস্ট্রেলিয়া। স্টার্কের বলে ভেরেইনার কট বিহাইন্ডের আবেদনে সাড়া দেননি আম্পায়ার, অস্ট্রেলিয়ার বাকি ছিল না কোনো রিভিউ। রিপ্লেতে বলে ব্যাটের স্পর্শের প্রমাণ মেলে। এক বল পরই কাভারে ঠেলে কাঙ্ক্ষিত রানটি নেন ভেরেইনা। লর্ডসের ব্যালকনিতে উল্লাসে মেতে ওঠেন অন্য ক্রিকেটার ও কোচিং স্টাফের সদস্যরা। অনেকে ছুটে যান মাঠে। চলতে থাকে দীর্ঘ খরা কাটানোর উল্লাস। এই ফাইনালে পরিষ্কার ফেভারিট হয়ে নেমেছিল গত চক্রের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া। তবে কাগিসো রাবাদা ও মার্কো ইয়ানসেনের দুর্দান্ত বোলিংয়ে শুরুটা ভালো করে দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রথম দিন ৬৭ রানে ৪ উইকেট হারানো অস্ট্রেলিয়া স্টিভেন স্মিথ ও বাউ ওয়েবস্টারের ফিফটিতে যেতে পারে ২১২ পর্যন্ত।
জবাবে ১২ রানে শেষ ৫ উইকেট হারিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা গুটিয়ে যায় ১৩৮ রানে। প্রথম ইনিংসে ৭৪ রানের মূল্যবান লিড পায় অস্ট্রেলিয়া। দ্বিতীয় ইনিংসে আবার রাবাদার দারুণ বোলিংয়ে একপর্যায়ে অস্ট্রেলিয়ার স্কোর হয়ে যায় ৭ উইকেটে ৭৩। ৯ নম্বরে নেমে স্টার্কের অপরাজিত ৫৮ রানের সুবাদে শেষ পর্যন্ত ২০৭ রান করে তিনশ’র কাছাকাছি লক্ষ্য দিতে পারে তারা। প্রথম দুই দিনে ১৪টি করে উইকেট পতনের পর পিচ ব্যাটিং সহায়ক হয়ে ওঠে অনেকটা।
তবে ফাইনালের মঞ্চে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে, চতুর্থ ইনিংসে ২৮২ রান তাড়া করা সহজ ব্যাপার নয় মোটেও। বীরত্বপূর্ণ ব্যাটিংয়ে সেটাই করে দেখালেন মার্করামণ্ডবাভুমারা। গত বছর ভারতের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে জয়ের দারুণ সম্ভাবনা জাগিয়েও শেষ দিকে তালগোল পাকিয়ে হেরে গিয়েছিল মার্করামের নেতৃত্বাধীন দক্ষিণ আফ্রিকা।
হৃদয় ভাঙার অনেক উপাখ্যানের পর অবশেষে রচিত হলো তাদের স্বপ্নপূরণের গল্প। বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে ২০২৫ সালে বিভিন্ন দল ও খেলোয়াড়ের অপূর্ণতা কাটানোর ধারায় নতুন সংযোজন হলো দক্ষিণ আফ্রিকার এই সাফল্য।