ঢাকা সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মদিনা শরিফের জুমার খুতবা

জগদ্বিখ্যাত মহামানবের কথা

শায়খ ড. আহমদ বিন তালিব বিন আবদুল হামিদ
জগদ্বিখ্যাত মহামানবের কথা

রাসুল (সা.)-এর সৌন্দর্যের কথা, তার গুণ-বৈশিষ্ট্যের কথা, তার অপূর্ব বিভাময় চরিত্রের কথা যতই বলা হোক, কম বলা হবে। মানুষের জ্ঞানের পরিধি যত বিস্তৃত হোক, বিবেক-বুদ্ধি যত পরিপূর্ণ হোক, মর্যাদা যত শ্রেষ্ঠ হোক; তার চূড়ান্ত প্রশংসা উপস্থাপন করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। কোনো বর্ণনাই তাকে পুরোপুরি ধারণ করতে পারে না। ভাষাচিত্রে তার পূর্ণ অঙ্কন করা সম্ভব নয়। লিখনীর রেখা তাকে সম্পূর্ণ ফুটিয়ে তুলতে পারে না। আল্লাহতায়ালা নিজে তাকে পাঠদান করেছেন। তিনি বলেন, ‘পড়ো তোমার রবের নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা আলাক : ১)। তাকে যা শিখিয়েছেন, তা মনে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি তোমাকে শেখাব, আর তুমি তা ভুলবে না।’ (সুরা আলা : ৬)। তার শিক্ষার দায়িত্ব তিনি নিজের কাছেই রেখেছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘(ঐশী বাণী) দ্রুত ধারণ করার জন্য জিহ্বা সঞ্চালন কোরো না। এটি সংরক্ষণ ও পাঠদানের দায়িত্ব আমার। যখন আমি তা পাঠ করি, তুমি সেই পাঠের অনুসরণ কর। এরপর এর বিশদ ব্যাখাদানের দায়িত্বও আমারই।’ (সুরা কিয়ামাহ : ১৯-১৬)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘আল্লাহ তোমার ওপর কিতাব ও হেকমত নাজিল করেছেন। শিখিয়েছেন যা তুমি জানতে না। তোমার ওপর আল্লাহর রয়েছে মহা-অনুগ্রহ।’ (সুরা নিসা : ১১৩)।

অনুসরণীয় পদরেখা : তিনি মানবীয় পূর্ণতার চূড়ান্তে অধিষ্ঠিত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বলো, নিশ্চয় আমি তোমাদের মতো একজন মানুষ। তবে আমার ওপর অহি অবতীর্ণ হয়।’ (সুরা কাহফ : ১১০)। এ আয়াত রাসুল (সা.)-এর অনন্য মর্যাদা ও গুরুত্বের কথা প্রকাশ করে। তিনি ছিলেন অহি অবতরণের জন্য নির্বাচিত। আল্লাহতায়ালা তাকে প্রস্তুত করেছেন। তিনি নিজে তাকে যোগ্য করে গড়ে তুলেছেন। তাকে সাহায্য করেছেন। তার আত্মা ও দেহ, বুদ্ধি ও বিবেক, দৃষ্টি ও অন্তর্দৃষ্টি এভাবে সব অনুভব-অনুভূতি, ভাবনা-চিন্তা আল্লাহতায়ালা কর্তৃক বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল। এসব কিছুর একমাত্র কারণ ছিল, তিনি যেন আল্লাহর পক্ষ থেকে অহি গ্রহণের উপযুক্ততা নিয়ে বেড়ে ওঠেন। আল্লাহতায়ালা বান্দাদের রাসুল (সা.)-এর অনুসরণের আদেশ করেছেন। তার অনুসরণকে আল্লাহর ভালোবাসার প্রমাণ সাব্যস্ত করেছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘বলো, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমার অনুসরণ কর; তাতে আল্লাহও তোমাদের ভালোবাসবেন, তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করবেন। আল্লাহ দয়ালু ও ক্ষমাশীল। বলো, তোমরা আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য কর। যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, (জেনে রেখ) আল্লাহ কাফেরদের ভালোবাসেন না।’ (সুরা আলে ইমরান : ৩১-৩২)।

রাসুল (সা.)-এর আনুগত্য হবে তার কথা ও কাজের অনুসরণের মাধ্যমে। তার উন্নত চরিত্র ও মহৎ গুণাবলি সম্পর্কে অবগতি লাভ করতে হবে, যাতে তার অনুসরণ-অনুকরণ করা যায়। তার আদেশ লঙ্ঘন করা যাবে না। বিরত থাকতে হবে দ্বীনের মাঝে নতুন কিছু আবিষ্কার করা থেকে। তার ভালোবাসাকে স্থান দিতে হবে সবকিছুর ওপর। পিতা-পুত্র, স্ত্রী-পরিবার, ব্যবসা, সম্পদ সবকিছুর চেয়ে তাকে অধিক ভালোবাসতে হবে। যেসব কারণে মানুষ ভালোবাসা প্রাপ্তির উপযুক্ত হয়, তার সবই রাসুল (সা.)-এর মাঝে পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। অবয়বের সৌন্দর্যে তিনি অতুলনীয়। গুণাবলির পূর্ণতায় তার মতো কেউ নেই। তার দানশীলতার অভিধানে ‘না’ বলতে কিছু ছিল না। তিনি মানবীয় গুণাবলির পরিপূর্ণতার আধার। আল্লাহতায়ালা তাকে অভিনব সৌন্দর্য দান করেছেন। মহত্বের একটি আবেশ তাকে ঘিরে রাখত সবসময়। আল্লাহতায়ালা তার সত্তায় সচ্ছতা, উজ্জ্বলতা ও পবিত্রতার অপূর্ব সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন।

তাকে ভালোভাবে জানতে হবে : প্রেমাষ্পদের সৌন্দর্য সম্পর্কে অবগতি যত বাড়বে, তার প্রতি ভালোবাসাও তত বৃদ্ধি পাবে। রাসুল (সা.)-এর গুণাবলি আলোচনায়, তার প্রশংসা শ্রবণে হৃদয় সজীব হয়, মন প্রফুল্লতা লাভ করে। তার প্রতি আকর্ষণ ও ভালোবাসা বাড়তেই থাকে ক্রমান্বয়ে। আল্লাহতায়ালা আমাদের নবীকে সবচেয়ে সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন। একজন মানুষ যতটা পূর্ণতা ধারণ করতে পারে, তার সবটুকু তাকে দান করেছেন। যারা তার আকার-অবয়ব ও গুণাবলির বর্ণনা দিয়েছেন, তারা সবাই এ ব্যাপারে একমত, তার মতো না তার আগে কাউকে দেখা গেছে, না পরে। চেহারা ও চরিত্রে তিনি সবার চেয়ে সুন্দর ছিলেন। তার আগে বা পরে তার চেয়ে সুন্দর বা তার মতো কাউকে দেখা যায়নি। তিনি ছিলেন সবচেয়ে বড় মনের অধিকারী। কথায় সবচেয়ে সত্যবাদী। স্বভাবে সবার চেয়ে নম্র। সঙ্গদানে সবচেয়ে উদার ও মহান। হঠাৎ কেউ তাকে দেখলে একটু ভয় পেত। আবার তার সঙ্গে মিশলে বা তাকে জানলে ভালোবাসতে শুরু করত। তিনি চুপ থাকলে একটা গাম্ভীর্য ছড়িয়ে পড়ত। কথা বললে আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যেত। একটা খুশির আভা প্রকাশ পেত। তিনি ছিলেন সুমিষ্টভাষী। তার কথা ছিল স্পষ্ট; খুব সংক্ষিপ্তও নয়, আবার লম্বাও নয়। কথাগুলো যেন মুক্তার দানা, মালা থেকে একেকটা খসে খসে পড়ছে। দূর থেকে সবচেয়ে প্রভাবশালী। কাছ থেকে সবচেয়ে সুন্দর। তার দীর্ঘকায়তা দৃষ্টিকে বিরক্ত করত না, আবার তিনি দৃষ্টিকটু রকমের খর্বকায়ও ছিলেন না। ছিলেন এর মাঝামাঝি। বিরল সৌন্দর্যের অধিকারী ছিলেন। তার উচ্চতা ছিল সুন্দর ও মানানসই। যখন বলতেন, লোকেরা মনোযোগ দিয়ে শুনত। যখন আদেশ করতেন, তা দ্রুত পালিত হতো। অন্যরা তার সেবা করার জন্য সদা ব্যস্ত থাকত। মানুষ তার কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করত। তিনি মলিনমুখো থাকতেন না। কারও মত খণ্ডন করে তাকে অপমান করতেন না।

সৌন্দর্যের অনন্য উপমা তিনি : রাসুল (সা.) ছিলেন উজ্জ্বল চেহারার অধিকারী। তার চেহারায় নুর চমকাতো। অনন্য ঔজ্জ্বল্যে ভাস্বর থাকত সবসময়। তাকে দেখলে মনে হতো, যেন এক নতুন সূর্য উদিত হয়েছে। তিনি ছিলেন বড় ও মহান। তার চেহারা পূর্ণিমা চাঁদের ন্যায় ঝলমল করত। তার উজ্জ্বল চেহারা, রহস্য ও মর্ম উপচেপড়া অবয়ব এ কথার অকাট্য ও সুস্পষ্ট প্রমাণ যে, তিনি আল্লাহর সত্যিকার রাসুল। রাসুল (সা.) মদিনায় এলেন। সবাই তাকে প্রাণ ভরে দেখছে। আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.)-ও এলেন। ইহুদি পণ্ডিত তিনি। বিদ্যান মানুষ। তীক্ষè দৃষ্টিতে তাকালেন রাসুল (সা.)-এর দিকে। প্রথম দেখাতেই বলে উঠলেন, ‘আমি ভালো করে চিনে নিয়েছি, এ চেহারা কোনো মিথ্যুকের চেহারা নয়।’ (মুসনাদে আহমদ : ২৩৭৮৪)।

রাসুল (সা.) আল্লাহর সৃষ্টির মাঝে সর্বাধিক পরিচ্ছন্ন ছিলেন। তার শরীর, কাপড় ও আশপাশের পরিবেশে অপরিচ্ছন্নতার ছোঁয়া লাগতে দিতেন না কখনও। তিনি ছিলেন সুশুভ্র, সুন্দর, লাবণ্যময়। হৃদয়ে সর্বদা মহৎ উদ্দেশ্য বয়ে বেড়াতেন। তার কাঁধ ও কণ্ঠদেশ ছিল মসৃণ, রুপার ন্যায় সচ্ছ। তার মুখগহ্বর থেকে যেন আলো ঠিকরে বেরুত। কোথাও প্রবেশ করা বা কোথাও থেকে বের হওয়া- উভয় সময়ই তিনি মেসওয়াক করতেন। তিনি এমনিতেই সুন্দর ছিলেন, তা সত্ত্বেও নিজেকে সুন্দর ও পরিপাটি রাখার চেষ্টা করতেন। তার একটি সুন্দর জোড়া (কাপড়ের সেট) ছিল, দুই ঈদ ও জুমার দিন তা পরতেন। রাসুল (সা.) একবার সাহাবিদের কাছে বেরুচ্ছিলেন। বেরুনোর পথে একটি পানিভর্তি পাত্র দেখলেন। তিনি তাতে নিজের চেহারা ও চুল ঠিক আছে কি-না, দেখে নিলেন। এরপর বললেন, ‘আল্লাহতায়ালা সুন্দর। তিনি সুন্দর পছন্দ করেন। তোমাদের কেউ নিজেদের ভাইদের কাছে গমন করলে, সে যেন নিজেকে পরিপাটি করে নেয়।’ রাসুল (সা.)-এর কাছে কোনো প্রতিনিধিদল এলে, তিনি সবচেয়ে সুন্দর কাপড়টি পরতেন। সাহাবিদেরও এমনই নির্দেশ দিতেন। তিনি মানুষকে মধ্যমপন্থা ধারণ করা ও পরস্পর ভালোবাসা রাখার তাগিদ দিতেন। উদ্বুদ্ধ করতেন সুন্দর চরিত্র ও উত্তম আদর্শ গ্রহণ করার প্রতি।

রাসুল (সা.) যেভাবে কথা বলতেন : রাসুল (সা.)-এর আওয়াজ ছিল অত্যন্ত সুন্দর। তার কথা হতো স্পষ্ট। জোর আওয়াজে কথা বলতেন। কথায় কর্কশতা ছিল না, তবে আওয়াজে ছিল স্পষ্টতা ও সশব্দতা। তিনি খুতবা দিলে অন্দরমহলের কুমারী নারীরা পর্যন্ত শুনতে পেত। উম্মে হানি (রা.) মাঝরাতে নিজের ঘরে শুয়ে কাবার দিক থেকে ভেসে আসা রাসুল (সা.)-এর কোরআন তেলাওয়াতের আওয়াজ শুনতে পেতেন। তার কথা ছিল সুন্দর, সুমিষ্ট। যখন বলতেন, মানুষের হৃদয় কেড়ে নিতেন। আত্মা ও বুদ্ধি হারিয়ে যেত তার কথার জাদুতে। মনে হতো, তার পবিত্র দন্তরাজি থেকে আলোক বিচ্ছুরিত হচ্ছে। ভাষিক বিশুদ্ধতায় ছিলেন সবার উপরে। বক্তব্যের স্পষ্টতায় তার কোনো জুড়ি ছিল না। তাকে স্বল্প শব্দে ব্যাপক মর্মবহুল বাণী ব্যক্ত করার সক্ষমতা দান করা হয়েছিল। দান করা হয়েছিল প্রজ্ঞাপূর্ণ কথামালা। কখনও তিনি জলদগম্ভির স্বরে কথা বলতেন। যা আদেশ করতেন, তা ছিল অবশ্য পালনীয়। বিচারিক কাজে তিনি ছিলেন সুদৃঢ়। উপদেশদানে অকাট্য। তার হিতোপদেশ হতো মর্মস্পর্শী, চূড়ান্ত প্রমাণসমৃদ্ধ, অখণ্ডনীয়। কথা বলতেন থেমে থেমে। যে শুনত, সে-ই বুঝতে পারত। কেউ গুণতে চাইলে শব্দগুলো পর্যন্ত গুণে নিতে পারত। তার কথা হতো ধীরলয়ে বিশুদ্ধ উচ্চারণে। তিনি দ্রুতলয়ে ও চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলা অপছন্দ করতেন। তার নামাজ ও খুতবার গতি ও পরিধি ছিল মধ্যম পর্যায়ের। একেবারে সংক্ষিপ্ত নয়, আবার দীর্ঘতার কারণে বিরক্তিকরও নয়।

খুতবার সময় তিনি লাঠিতে ভর করতেন। আল্লাহর প্রশংসা করতেন। সহজ, সাবলীল শব্দে ও পবিত্র বাক্যমালায় আল্লাহর স্তুতি বর্ণনা করতেন। ভাষণ দানের সময় কখনও তাকে তীব্র ক্রোধী মনে হতো। আওয়াজ উচ্চ হয়ে যেত। চোখ লাল হয়ে যেত। যেন কোনো সেনাবাহিনীকে সর্তক করছেন। বলছেন, ‘শত্রুসৈন্য হয়তো সকালেই এসে পড়বে, তারা হয়তো সন্ধ্যায় তোমাদের ওপর হামলে পড়বে।’ তার ওয়াজ শ্রোতাদের হৃদয়ে দাগ কেটে যেত। তাদের মন ভালো করে দিত। হৃদয় বিগলিত হতো। চোখে অশ্রু ঝরত। কখনও এমন হতো যে, তিনি যা বলছেন, যেন তার সবকিছু তারা চাক্ষুষ দেখতে পাচ্ছে। ইরবাজ ইবনে সারিয়া (রা.) বলেন, একবার রাসুল (সা.) আমাদের সামনে খুব মর্মস্পর্শী ভাষণ দিলেন। অন্তর সন্ত্রস্ত হলো। চোখ অশ্রুসিক্ত হলো। আমরা বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! যেন আপনি বিদায়ি ভাষণ দিচ্ছেন? আমাদের ওপর কী দায়িত্ব অর্পণ করবেন?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আমার সুন্নতের অনুসরণ কর। আমার পরে অনুসরণ কোরো আমার সুপথপ্রাপ্ত খলিফাদের। (আমার ও খোলাফায়ে রাশেদিনের সুন্নতকে) মজবুতভাবে আঁকড়ে ধর। কারণ, সব বেদাতই ভ্রষ্টতা।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৭১৪৪)।

মদিনার মসজিদে নববির জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন- মুফতি মুইনুল ইসলাম

জগদ্বিখ্যাত,মহামানব
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত