গবেষকেরা মুগ্ধ হলো লনিয়ার কথায়। তার কথায় যুক্তি আছে। আজ না হোক কাল তো নিজেদেরকেই তাঁবু খাটিয়ে থাকতে হবে। সুতরাং কাজটা না হয় আজ থেকেই শুরু করা যাক। তাছাড়া টিকে থাকার লড়াইয়ে আত্মবিশ্বাসও বেড়ে যাবে। বিষয়টা নিয়ে সবাই পরামর্শ করে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে উপরে উঠার উদ্যোগ নিলো। এখন যতটা উপরে উঠা যাবে, ততই তাদের জন্য মঙ্গল হবে।
এক-দুই পা করে উপরে উঠছে তিনজন। পর্বতের গায়ে তুষারের আস্তর নেই খুব একটা। সাইবেরিয়ায় এখন বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে, ধীরে ধীরে তাপমাত্রা বাড়ছে, ফলে উঁচু উঁচু পাহাড়-পর্বতের গায়ে লেগে থাকা তুষার ঝরে পড়ছে নিচের দিকে। পায়ে হাঁটতে কিছুটা সুবিধা হচ্ছে আজ। পর্বতের গায়ে তুষার জমে থাকলে পিচ্ছিল হয়ে যেত, ফলে খাড়া পথ বেয়ে উপরে ওঠা অনেকটাই কঠিন হতো। বসন্তের আগমনে সেদিক থেকে কিছুটা সুবিধা পাচ্ছে তারা।
চার. ইয়াকুটস্ক শহরে দুই-তিন দিন কাটতেই পর্যটকদের একঘেয়েমি লাগতে শুরু করেছে। এই কয়েক দিনে শহরের বিভিন্ন স্থাপত্য এবং ইতিহাস সংবলিত জাদুঘরগুলো ঘুরে দেখেছে। এখন আর তেমন কিছু দেখার নেই শহরে। তাছাড়া শহরে আর মনও টিকছে না। তীব্র ঠান্ডায় তাদের শরীরও বিদ্রোহ ঘোষণা করছে। মূলত শীতের তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে দ্রুত বুরিয়াতিয়ায় চলে যাবে। সেখানে ঠান্ডা তুলনামূলক কিছুটা কম। তাই নিকোলাস আগেভাগেই বুরিয়াতিয়ার রাজধানী উলান-উদের বিমান টিকিট সংগ্রহ করে ফেলেছে। যাত্রা ছয়দিন পর। তাদের পরিকল্পনা ছিল ইয়াকুটস্কে অন্তত দশ দিন থাকার। অতিরিক্ত ঠান্ডা সহ্য করতে না পেরে সিডিউল পরিবর্তন করেছে তারা, ফলে সাত দিনের মাথায় যাত্রা করতে হবে। না গেলে আরও এক সপ্তাহের জন্য পুরো সিডিউল পিছিয়ে যাবে। ফ্লাইটের সময়সূচি পরিবর্তন করাও কঠিন। তাই বাধ্য হয়েই আরও পাঁচ দিন এই শহরে থাকতে হবে। তবে উপাল এখানে আর এক মুহূর্তও থাকতে রাজি নয়। আসলে হোটেলবন্দি থাকতে কারও ভালো লাগার কথাও নয়। উপাল সেনানায়েকে হোটেলের ব্যালকুনিতে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তায় নজর পড়তেই দেখতে পেলো হিমশীতল ঠান্ডার মধ্যেও স্থানীয়রা নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছে, দৈনন্দিন কাজকর্মও স্বাভাবিকভাবে চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
তুষারাবৃত রাস্তা পেরিয়ে নির্দ্বিধায় চলাফেরা করছে। কেউ কেউ ফায়ারপ্লেসের জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করছে, কেউবা বাড়ির সামনের বরফ সরিয়ে দিচ্ছে। তাছাড়া মার্কেটগুলোতেও মানুষের আনাগোনা লেগেই আছে। কেউ প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করছে, কেউ শীতের পোশাক নেড়েচেড়ে দেখছে। তাদের মধ্যে শীতের তীব্রতা নিয়ে কোনো আক্ষেপও নেই। সবচেয়ে বিস্ময়কর দৃশ্য হচ্ছে, এত ঠান্ডার মধ্যেও ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা গায়ে ভারী উলের জামা গায়ে জড়িয়ে, কানটুপির ভেতর মুখ গুজে স্কুলে যাতায়াত করছে। আসলে এখানকার স্থানীয়রা প্রকৃতির কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়েই জীবন যাপন করছে।
ব্রেকফাস্ট শেষে কফি খেতে খেতে উপাল সেনানায়েকে বলল, ‘চলো, তুন্দ্রা অঞ্চল থেকে ঘুরে আসি। শুনেছি এখান থেকে তুন্দ্রা বেশি দূরে নয়। নিকোলাস ডি সিলভা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ‘বেশ ভালো একটা প্রস্তাব করেছ। বিষয়টা আগে জানাওনি কেন? আগে জানালে কিন্তু এরই মধ্যে সবকিছু ঠিকঠাক করে ফেলতাম। তবে সত্যি বলতে দারুণ একটা প্রস্তাব দিয়েছ উপাল। উপাল সেনানায়েকে মৃদু হেসে বলল, ‘আমার অনেক দিনের ইচ্ছা তুন্দ্রায় যাওয়ার। তুমি যদি চাও তাহলে অবশ্যই যাবো। আচ্ছা শহর থেকে তুন্দ্রার দূরত্ব সম্পর্কে তোমার কি কোন ধারণা আছে? নিকোলাস মাথা নেড়ে বলল, ‘না, ধারণা নেই।
সমস্যা হবে না এখনই জেনে নিতে পারব। চলো রিসেপশনে যোগাযোগ করি। ওখানে গিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত জেনে নেই। তারপর সিদ্ধান্ত নেবো কখন যাবো। এই শহরে হয়তো দুজনের একত্রে আর কখনও আসা নাও হতে পারে। যখন সুযোগ এসেছেই তখন অবশ্য তুন্দ্রায় যাওয়ার চেষ্টা করব আমরা।’ নিকোলাস ডি সিলভা অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ। যেখানে চ্যালেঞ্জ সেখানেই সে নিজেকে জড়াতে পছন্দ করে। ব্যবসার ক্ষেত্রেও সে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগেই সবচেয়ে বেশি আগ্রহী থাকে। ইয়াকুটস্কে এসেও সে এক মুহূর্ত বসে থাকেনি, ব্যবসার নতুন নতুন সুযোগ খুঁজছে। এমন সময় কফি খাওয়ার ফাঁকে উপালের কাছ থেকে তুন্দ্রায় যাওয়ার প্রস্তাব পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল নিকোলাস।
সে জানে, দেরি করলে মত পাল্টাতে পারে উপাল। তাই যত দ্রুত সম্ভব বন্ধুকে নিয়ে রিসেপশনে চলে এলো। রিসেপশনে এসে এক অষ্টাদশী তরুণীর সাক্ষাত পেলো তারা। নাম নাটালিয়া। গোলগাল মুখ, হাসিখুশি স্বভাবের। তার প্রাণবন্ত আচরণে মুহূর্তেই মনে দাগ কাটল নিকোলাস ও উপালের। তাদের দেখে নাটালিয়া মিষ্টি হেসে জানতে চাইল, ‘আজ কোথায় যাওয়ার পরিকল্পনা করেছ?’ নিকোলাসের জবাব, ‘এখনই কোথাও যাচ্ছি না। যাবো। তার আগে তোমার কাছে একটা বিষয় জানতে এসেছি।’
‘কোন বিষয়?’ ‘শহর থেকে তুন্দ্রার দূরত্ব কতটা, আর ওখানে কিভাবে যাওয়া যায় সেটা জানতে এসেছি।’ ‘দূরত্বটা সঠিক বলতে পারব না। তাছাড়া তুন্দ্রার কোন অঞ্চলে যাবে সেটাও একটা প্রশ্ন। তবে যতটা শুনেছি ওখানে ‘চুচকা’ নামে একটা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল আছে। চুচকার বিলিবিনস্কি জেলায় ‘ওমোলন’ নামে একটা গ্রাম আছে; সেখানে মাঝে মধ্যে অভিযাত্রীরা যাতায়াত করেন। তাদের মুখে শুনেছি যাতায়াতে ১৪-১৫ ঘণ্টা সময় লাগে। তাদের অনেকেই এ হোটেলেই রাত যাপন করেন, সেসুবাদেই এতসব জানতে পেরেছি।’ নিকোলাস বলল, ‘আমরা ওখানেই যেতে চাই। তুমি যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে?’ ‘পারব। কিন্তু অতদূর তো যেতে পারবে না; কবে যেতে চাচ্ছ?’ ‘আজই যেতে পারলে ভালো হতো। হোটেলে শোয়ে-বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না। ‘যেতে চাচ্ছ ভালো কথা; আজই যাবে এটা ভাবেনি আবার। অন্তত একটা দিন তো সময় দিতে হয়। ভোরে জানালেও আজ যেতে পারতে।’
‘তুমি ব্যবস্থা করো, আমরা আগামীকাল ভোরেই যাত্রা করব। কালকের মধ্যে যেতে না পারলে সমস্যায় পড়ব, বিমানের সিডিউলের হেরফের হয়ে যাবে। বুরিয়াতিয়া যাওয়ার টিকিট কনফার্ম করা হয়ে গেছে। দেরি করলে এক সপ্তাহ পিছিয়ে যাবে। এতদিন এই শহরে থাকা সম্ভব নয়। তাপমাত্রা সহনীয় থাকলে ঘুরেফিরে সাতদিন পার করিয়ে দিতাম, এখন সেটা কোন মতেই সম্ভব হচ্ছে না। হোটেলে শোয়ে ঘুমানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তাছাড়া উপালও এখানে থাকতে রাজি নয়; তুমি একটু ব্যবস্থা করে দাও প্লিজ।’ ‘যেতে চাও, যাবে। আমি সব ব্যবস্থা করব। তবে মনে রেখো ওটা কিন্তু তুন্দ্র অঞ্চল; রক্তহিম করা ঠান্ডা ওখানে। রাত কাটানোর কোনো ব্যবস্থা নেই; ভেবেচিন্তে যেও। কিছু যাযাবর আদিবাসীরা ওই গ্রামে তাঁবু টানিয়ে অস্থায়ীভাবে বসবাস করে, ওদের সাক্ষাত পেলে হয়তো থাকার ব্যবস্থা হবে; নচেৎ ফিরে আসতে হবে; বিষয়টা মাথায় রেখো। ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব-৬) চলবে...