ঢাকা বুধবার, ১৩ আগস্ট ২০২৫, ২৯ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মুসলিম সভ্যতার অবদান

মাওলানা নুরুল হক
মুসলিম সভ্যতার অবদান

ইসলামি সভ্যতা যে বিশ্বের উন্নতির আবিষ্কার ও সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে অপূরণীয় অবদান রেখেছে, তা এক ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের আবিষ্কারে মুসলিম জাতির ব্যাপক সংশ্লিষ্টতা খুঁজে না পাওয়ার ফলে মুসলিম তরুণ ও যুবকরা এক ধরনের হীনমন্যতায় ভোগে। আজ আমরা মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞানের অবদানের কথা বিস্মৃত হচ্ছি।

ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যায়, প্রথম ভূ-মানচিত্র যারা এঁকেছিলেন তারা সবাই মুসলিম ছিলেন। ৬৯ জন মুসলিম ভূগোলবিদ পৃথিবীর প্রথম যে মানচিত্র এঁকেছিলেন তার নাম ‘সুরাতুল আরদ’ যার অর্থ হচ্ছে বিশ্ব আকৃতি। ইবনে ইউনুসের অক্ষরেখা ও দ্রাঘিমা মণ্ডল নিয়ে গবেষণার ফলকে ইউরোপ মাথা পেতে মেনে নিয়েছিল। তাছাড়া মুসলিম ফরগানি, বাত্তানি, আল-খারেজমি প্রমুখের ভৌগোলিক অবদান অবিস্মরণীয়। এছাড়াও কম্পাস যন্ত্রের আবিষ্কারক ছিলেন ইবনে আহমদ। পানির গভীরতা ও স্রোত মাপার যন্ত্র মুসলিম বৈজ্ঞানিক আব্দুল মজিদ আবিষ্কার করেছিলেন। মুসলিম বৈজ্ঞানিক আলকিন্দি বিজ্ঞানের ওপর ২৭৫টি গ্রন্থ লিখেছিলেন। প্রাচীন মুসলিম বৈজ্ঞানিক হাসান, আহমদ, মুহাম্মাদ সম্মিলিতভাবে ৮৬০ সালে বিজ্ঞানের একশ প্রকারের যন্ত্র তৈরির নিয়ম ও ব্যবহার প্রণালি এবং এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কিত গ্রন্থ লিপিবদ্ধ করেন।

বর্তমান বিশ্বের বিবর্তনবাদ ও বিবর্তনবাদের জনক বলে যে চার্লস ডারউইনের কথা উল্লেখ করা হয়, সেই পশু-পাখি, লতাণ্ডপাতা নিয়ে ডারউইনের আগেও যিনি কাজ করেছেন তিনি ছিলেন মুসলিম বৈজ্ঞানিক আল আসমায়ি। মুসলিমরা চিনিও আবিষ্কার করেছিলেন। ভূতত্ত্ব সম্পর্কিত বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মুজাম আল উবাদা’ এর লেখক হচ্ছেন মুসলিম ইয়াকুব ইবনে আব্দুল্লাহ। তুলা থেকে মুসলিম আবিষ্কারক ইউসুফ ইবনে উমার প্রথম তুলট কাগজ আবিষ্কার করেন।

এ আবিষ্কারের ২ বছর পর বাগদাদে কাগজের কারখানা তৈরি করা হয়েছিল। মুসলিম বিজ্ঞানী জাবির ইবনে হাইয়ান ইস্পাত, ধাতুর শোধন, তরল বাষ্পীকরণ, কাপড় ও চামড়া রঙ করা, ওয়াটার প্রুফ তৈরি করা, লোহার মরিচা প্রতিরোধক বার্নিশ, চুলের কলপ, লেখার পাকা কালি আবিষ্কার করেন। ম্যাঙ্গানিজ-ডাই-অক্সাইড থেকে মুসলিম বিজ্ঞানী আল-রাজি প্রথম কাচ আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি ছিলেন ধর্মীয় পণ্ডিত, গণিতজ্ঞ ও চিকিৎসাবিশারদ। পারদ, গন্ধক, আর্সেনিক ও সালমিয়াক নিয়ে তাঁর গবেষণা উল্লেখযোগ্য। পৃথিবীতে প্রথম পানি জমিয়ে বরফ তৈরি তাঁরই অক্ষয় কীর্তি।

গণিত ও চিকিৎসাবিশারদ ওমর খাইয়াম পৃথিবীখ্যাত ও সর্বজনবিদিত। তাছাড়া সভ্যতার বিকাশ ও বিজ্ঞানের উৎকর্ষের ক্ষেত্রে নাসির উদ্দিন তুসি ও আবু সিনার অবদান ব্যাপক। পৃথিবীর প্রথম মানমন্দিরের আবিষ্কারক ছিলেন হাজ্জার ইবনে মাসার এবং হুনাইন ইবনে ইসহাক। পৃথিবীর প্রথম মানমন্দির তৈরি হয় ৭২ খ্রিষ্টাব্দে, দ্বিতীয়টি ৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে। দ্বিতীয় মানমন্দির জন্দেশপুরে, তৃতীয়টি বাগদাদে এবং চতুর্থটি দামেস্কে। তা তৈরি করেন মুসলিম খলিফা আল মামুন।

পৃথিবীর প্রথম বীজগণিতের জন্মদাতা মুহাম্মাদ ইবনে মুসা আল খারেজমি ছিলেন। তিনি কিতাবুল হিন্দ নামে ভারত সম্পর্কিত একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন। শূন্যের মূল্য অমূল্য ও অপরিসীম, এই শূন্য (০)ও তিনি আবিষ্কার করেছেন। হিসাব আল জাবর ওয়াল মোকাবিলা গ্রন্থটি তাঁর অবদান। শুধু তাই নয়, তিনি জ্যোতির্বিদও ছিলেন। খলিফার অনুরোধে আকাশের মানচিত্রও তিনি এঁকেছিলেন এবং একটি পঞ্জিকার জন্ম দেন। তাঁকে সরকারি উপাধি দেয়া হয়েছিল ‘সাহিব আলজিজ’।

মুসলিম ঐতিহাসিকদের কথা বাদ দিলে পৃথিবীর ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায়। মুসলিম ঐতিহাসিকগণই ভারতীয় ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন। তবে এ ক্ষেত্রে ইংরেজ ঐতিহাসিকদের অবদানও কম নয়। তবে স্মরণ রাখতে হবে যে, ইতিহাসের স্রষ্টা মুসলিম এবং অনুবাদক ছিলেন ইংরেজ। এসব মুসলিম ঐতিহাসিকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আলবিরুনি, ইবনে বতুতা, আলিবিন হামিদ, বাইহাকি, উতবি, কাজি মিনহাজুদ্দিন সিরাজ, মহিউদ্দিন, মুহাম্মদ ঘোরি, জিয়া উদ্দিন রারনি, আমির খসরু, শামসি সিরাজ, বাবর, ইয়াহিয়া বিন আহমদ, জওহর, আব্বাস শেরওয়ানি, আবুল ফজল, বাদাউনি, ফিরিস্তা, কাফি খাঁ, মির গোলাম হুসাইন, হুসাইন সালেমি, সাইদ আলি প্রমুখ।

তাঁদের লিখিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ হলো- তারিখই সিন্ধু, কিতাবুল ইয়ামিনি, তারিখণ্ডই মাসুদি, তারিখণ্ডই ফিরোজশাহি, তারিখুল হিন্দ, তাবাকাত-ই-নাসিরি, খাজেনুল ফতওয়া, ফতওয়া উস সালাতিন, তারিখে মুবারকশাহি, তারিখে সানাতিনে আফগান, তারিখে শেরশাহি, মাখজানে আফগান, আকবর নামা, আইনি আকবর, ফুতুহুল বুলদান, তারিখে ইয়াকুব, তারিখে তাবারি, তামবিনুল আশরাফ, উসদুল গাবাহ, আখবারুল আব্বাস ইত্যাদি।

সভ্যতার সংকট ও বৈশ্বিক রাজনীতির কুপ্রভাব থেকে আমরাও মুক্ত নই। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতা দেখা যাচ্ছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় অস্থিরতা বিরাজ করছে। সভ্যতা ও সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি মানবসভ্যতাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের চর্চার সঙ্গে রয়েছে রাজনীতির নিবিড়তম সম্পর্ক। রাজনীতিতে মূল্যবোধ ও ন্যায্যতার কাঠামো শক্তিশালী না থাকলে কল্যাণের পরিবর্তে হয় অকল্যাণ। তখন রাজনীতি অপরাজনীতিতে রূপ লাভ করে। ফলে সমাজে ন্যায্যতা ও মূল্যবোধ নষ্ট হয়। কোনো ব্যক্তির মূলবোধ নষ্ট হলে ক্ষতি হয় একজনের; কিন্তু শাসকশ্রেণির মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্রেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

লেখক : আলেম ও গবেষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত