পাখি শিকারিদের অত্যাচারে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে শেরপুরের গারো পাহাড়ের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বন মোরগ। বন মোরগ পাখি নয়, অথচ গাছে গাছে উড়ে বেড়াতে পারে। জীবন বাঁচানোর তাগিদে বংশবিস্তারসহ নিজেদের রক্ষা করে বনেই স্থায়ী আবাস বন মোরগের। সাধারণ মোরগের মতোই বন মোরগ। কিন্তু স্বভাব অনেকটা ভিন্ন। বনের মধ্যেই বাঁচা-মরা, যুদ্ধ করা আর বন্যপ্রাণীর হাত থেকে নিজেদের রক্ষা ও সন্তানদের নিরাপদ রাখার জন্য বন মোরগ অনেকটা হিংস্র প্রাণীর মতো হয়। দেখতে আমাদের গৃহপালিত মোরগ-মুরগির মতোই। তবে মোরগের লেজের দুটি পালক লম্বা। বন মোরগ পাহাড়, চা-বাগান এবং প্রাকৃতিক গভীর বনের কাছাকাছি নিরাপদ খোলা মাঠে একাকী, জোড়ায় ও দলবদ্ধভাবে চরে বেড়ায়। সকালে ও সন্ধ্যার আগে বনের কাছাকাছি খোলা জায়গায় খাবারের সন্ধানে বের হয়। একটি দলে ৬টি মুরগি ও ১টি মোরগ থাকে। খাদ্য হিসেবে বনের পোকাণ্ডমাকড়, ফল-মূল খেয়েই জীবনধারণ করে বন মোরগ। এদের প্রধান খাদ্য ফল, বীজ, শস্য কণা, কচি পাতা, কেঁচো ও কীটপতঙ্গ। শীতের সময় কুয়াশা থাকাবস্থায় খাদ্যের সন্ধানে বের হয়। বনের কোনো গাছতলায় পাকা ফল ঝড়ে পড়া শুরু করলে বন মোরগ-মুরগি প্রতিদিন সকাল-বিকাল সেই গাছতলায় আসে। আবার বনের বড় গাছে উঠেও ফল খায়। যেখানে ঘন বন, সেখানেই বন মোরগ আবাস গড়ে তোলে। বন মোরগ পাখি নয়, তবে নিজের প্রয়োজনে খুব দ্রুত দৌড়াতে পারে এবং উড়তে পারে অনেক ওপরে। উড়ে যেতে পারে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, চীন, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার ও ইন্দোনেশিয়ায় বন মোরগের দেখা মেলে। পাহাড়ের পাদদেশে ঘন প্রাকৃতিক ঝোপের ভেতর মাটিতে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাসে এরা বাসা তৈরি করে থাকে। ছয়-সাতটি ডিম দেয়। বন মুরগি শুধু ডিমে তাপ দেয় ও ছানাদের লালন-পালনে ব্যস্ত থাকে। ডিম থেকে ছানা ফুটতে ২০-২১ দিন সময় লাগে। ছানারা বাসা থেকে নেমেই খাবার খেতে পারে। বাংলাদেশের উত্তর অঞ্চলের বৃহত্তর ময়মনসিংহের গজনী, বালিজুরী, তাওয়াকুচা ও সমচূড়া ফরেষ্ট বিটে বন মোরগ বাস করে। গারো পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বনে গিয়ে বন মোরগের দেখা মেলে মাঝে মধ্যে। কিন্তু এই প্রাণীগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছে বনরাক্ষুসী ও পাখি শিকারীরা। অব্যাহত ভাবে বনাঞ্চল উজাড় আর পাখি শিকারিদের অপতৎপরতার কারণে বিপন্ন এই প্রজাতির বন মোরগ। বনাঞ্চলে তারা পাচ্ছে না নিরাপদে বাঁচার পরিবেশ।
বিশেষ করে স্থানীয় আদিবাসীদের শিকারের মধ্যে বন মোরগ-মুরগি অন্যতম। এটি তাদের নিয়মিত শিকারের পাখি। প্রাকৃতিক বনে বাস করা বন মুরগি আদিবাসীরা শিকার করে ক্ষান্ত হয় না, মোরগের বাসা খুঁজে বের করে তাদের ডিমগুলোও খেয়ে ফেলে। তাছাড়া বন এলাকার বাঙালিরাও বন মোরগ-মুরগি ধরতে প্রতিদিন নানা রকমের ফাঁদ পেতে থাকে। সরেজমিনে ঘুরে এমনই চিত্র দেখা যায়। ঘরে পোষা মুরগি থাকা স্বত্বেও বনের এই পাখির প্রতি লোকের লোভের সীমা নেই। ফলে কমে গেছে এদের সংখ্যা। পড়ে গেছে বিপন্ন পাখির তালিকায়। আমাদের উচিত সময় থাকতে বন মোরগসহ বনের বিভিন্ন পশু-পাখিকে বিলুপ্ত হওয়ার হাত থেকে বাঁচানো। অভিজ্ঞ মহল এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে টিকিয়ে রাখা দরকার বলে মত প্রকাশ করেছে।