ঢাকা রোববার, ১৮ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

প্রচণ্ড গরমে কদর বেড়েছে তালের হাতপাখার

প্রচণ্ড গরমে কদর বেড়েছে তালের হাতপাখার

যশোরের কেশবপুর টানা প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে তীব্র তাপপ্রবাহ ও প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন। মাঝেমধ্যে লোডশেডিং আর প্রচণ্ড গরমের কারণে শহর-গ্রাম সর্বত্রই যান্ত্রিকযুগেও হাতপাখার কদর বেড়েছে। তবে শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের লোডশেডিং বেশি হওয়ায় গ্রামগঞ্জে হাতপাখার কদর সবচেয়ে বেশি। আধুনিক ও যান্ত্রিক যুগে অনেকটাই বিলুপ্তির পথে হাতে তৈরি তালপাতা পাখা বা শীতল পাখা। তবুও পৈতৃক এই পেশাকে যুগ যুগ ধরে আজও বুকে লালনপালন করে রেখেছে, উপজেলার আলতাপোল গ্রামের শতাধিক পরিবার। গ্রীষ্মের উষ্ণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদিনই খুব সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শরীর শীতল করা তালপাতার হাতপাখা তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে এখানকার কারিগররা।

জানা গেছে, গ্রাম বাংলার এই প্রাচীন হাতপাখা তৈরির প্রধান কাঁচামাল তাল গাছের পাতা, বাঁশ, সুতা বা লোহার চিকন তার (জিআই তার)। আর সাজসজ্জার জন্য ব্যবহার করা হয় রঙ-বেরঙের বেরা রং এবং কয়েকজন নারী ও পুরুষ মিলে একটি করে দল গঠন করে তৈরি করে পাখা। সরজমিনে আলতপোল গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, কেউ তালপাতাগুলো পানি দিয়ে ভেজানোর কাজ করছে, কেউ পাতা রোদে শুকাচ্ছে। কেউ কেউ আবার পাতা কেঁটে সাইজ করছে, বাঁশ চিরে শলা তৈরি করছে। কেউবা সুতা ও বাঁশের শলাতে বং লাগাচ্ছে। এভাবেই কয়েকজনের হাতের ছোঁয়ায় তৈরি পাখাগুলো। কেউ আবার বিক্রয় স্থানে নেওয়ার জন্য বোঝা বানছে। কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আলতাপোল গ্রামের শতাধিক পরিবারের ২ থেকে ৩ শতাধিক নারী ও পুরুষ পাখা তৈরির কাজ করেন।

হাত পাখা তৈরির উপকরণ তালপাতা, জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ ও তৈরি পাখা বিক্রির কাজ মূলত পুরুষরাই করে থাকে। তবে সংসারের কাজের পাশাপাশি রং মিশ্রিত বাঁশের কাঠি, সুই ও সুতা দিয়ে পাখা বাঁধার কাজটি করেন গৃহবধূরা। পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও পাখা তৈরির কাজে সহযোগিতা করে থাকে। কারিগরদের সঙ্গে আলাপকালে আরও জানা যায়, উপজেলা ও উপজেলার বাইরের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাখা তৈরির প্রধান কাঁচামাল তালের পাতা পিচ প্রতি কেনা হয় ৫-৮ টাকা দরে। প্রতি পিচ পাতায় ৮-১০টি পাখা তৈরি করা যায়। প্রতি পিচ বাঁশ কেনা হয় ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়। প্রতিটি বাঁশে শতাধিক পাখা হয়। প্রতি পিচ পাখা তৈরিতে খরচ হয় ৫ থেকে ৬ টাকা। পাইকারি বিক্রি হয় ১০ থেকে ১২ টাকায় আর খুচরা বিক্রয় হয় ২০ থেকে ২৫ টাকা। এখানকার তৈরি পাখাগুলো স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে জেলার বাইরেও বিক্রি করা হয়।

এ বিষয়ে আলতাপোল গ্রামের আমজাদ আলী ছেলে রেজাউল ও কাদেরের ছেলে বাবলু আক্তার বলেন খুব ছোট থেকেই একাজ করে আসছি। বিদ্যুৎ আর যান্ত্রিক যুগে হাত পাখার চাহিদা কমে গেলেও পৈতৃক পেশা হিসেবে ধরে রেখেছি। তারা আরও বলেন, নারী ও পুরুষ সবাই মিলে দল বেঁধে আমরা কাজ করি। প্রতিটি দল দিনে ২৫০ থেকে ৩০০ পিচ পাখা তৈরি করি। নারী কারিগর আলেয়া বেগম বলেন, ঘরের কাজের পাশাপাশি পাখা তৈরির কাজ করে যা পায়, তাতে সংসার ভালোভাবে চলে যায়। নাম প্রকাশ না করা শর্তে একজন কলেজছাত্রী বলেন, বিজ্ঞানের যুগেও আমাদের এলাকায় ঐতিহ্যবাহী তালপাখা তৈরি হয়। পড়াশোনার পাশাপাশি তালপাখা তৈরি করে নিজের খরচ মিটাই।

একই গ্রামের রহমত আলী বলেন, কাজের সুব্যবস্থা না থাকায় সিজনভিত্তিক গরমকালে পাখার কাজ করি। অন্যান্য সময় অন্যকাজ করে সংসার চালায়। কেশবপুর সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলা উদ্দীন আলা বলেন, যান্ত্রিক যুগেও আমার এলাকায় শতাধিক পরিবায় হাতপাখা তৈরির কাজ করে। ঐতিহ্যবাহী এই কুটিরশিল্পটি আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পাখা তৈরিতে শতভাগ কাজ কারিগররাও করলেও সংরক্ষণের অভাবে মুনাফা ভোগ করে মধ্যস্থতাকারী ব্যবসায়ীরা। ফলে পাখা তৈরির ভাগ্য বদলে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানান কারিগররা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত