পাল্টে যাচ্ছে পুলিশ, র্যাব ও সাধারণ আনসার সদস্যদের চিরচেনা পোশাক। শিগগির তাদের মাঠে দেখা যাবে নতুন রঙের পোশাকে। পোশাক পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে। সে অনুযায়ী, পুলিশের নতুন পোশাক হচ্ছে ‘আয়রন’ রঙের, র্যাবের ‘অলিভ’ আর আনসার বাহিনীর জন্য ‘গোল্ডেন হুইট’। ২০ জানুয়ারি, সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নতুন পোশাকের সিদ্ধান্তের কথা জানান। ১৮টি পোশাক পরিহিত পুলিশ, র্যাব ও আনসার সদস্য বৈঠকে পোশাক নির্বাচনের মডেল হিসেবে অংশ নেন। সেখান থেকেই প্রাথমিকভাবে পোশাক নির্বাচন বা চিহ্নিত করা হয়। জানা গেছে, পুলিশ, র্যাব ও আনসার বাহিনীর জন্য যে তিনটি রঙের পোশাক বাছাই করা হয়েছে সেগুলো প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদন পেলে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেয়া হবে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্বপালনকারী বাহিনীগুলোর সদস্যের হাতে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিজেদের নৈতিকতা যদি পরিবর্তন না করা যায় তবে পোশাক পরিবর্তন করে খুব বেশি কাজে আসবে না। আগেও অনেকবার পোশাক পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু তেমন নৈতিকতায় পরিবর্তন আসেনি। পোশাক পরিবর্তনের সঙ্গে তাদের মনোভাব পরিবর্তনও জরুরি, বিশেষ করে পুলিশের। তাদের ভাষ্য, পোশাক পরিবর্তনে সাধারণ মানুষের করের টাকা নষ্ট হবে। অবশ্য এ পরিবর্তনকে ইতিবাচকও বলছেন অনেকে। আমরা মনে করি, সমস্যাটা পোশাকে নয়, পুরো সিস্টেমেই ছড়িয়ে আছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ ছিল গোটা দেশের মানুষ। তাদের পোশাক অনেকের কাছে আতঙ্ক হয়ে দাঁড়ায় সে সময়। বিশেষ করে পুলিশের। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশ সদস্যরা পোশাক পরে বের হতেও সংকোচ বোধ করতেন। অনেক পুলিশ সদস্য ট্রমায় ভুগেছেন দীর্ঘদিন। গণঅভ্যুত্থানের পর বেশ কিছুদিন পুলিশ সদস্যদের প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। কাজে যোগ দেয়ার বিষয়েও নানা শর্তজুড়ে দিয়েছিলেন তারা। একপর্যায়ে সেনাবাহিনীর সহায়তায় কাজে ফিরতে শুরু করে। বাহিনীটি সচল করতে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের নানা উদ্যোগ নেয়। তখনই পোশাক পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি আলোচনায় আসে। এমন প্রেক্ষিতে পুলিশ, র্যাব ও আনসার বাহিনীর পোশাক পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। উল্লেখ্য, গত সরকারের ১৫ বছরে খুন, গুম, নারী নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছিল। বিশেষ করে বিরোধী দল ও মতো দমনে পুলিশ-র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। এতে ভেঙে পড়েছিল বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের বেশিরভাগ কাঠামো। মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আইনশৃঙ্খলার অবনতির ঘটনাও বেড়ে গিয়েছিল। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৫ বছরে ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে ১ হাজার ৯২৬ জন হত্যার শিকার হয়েছে। গুম হয়েছে ৭ শতাধিক ব্যক্তি। এর বাইরে সরকারের শেষ সময়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বহু মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সে সময় আওয়ামী লীগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দানবে পরিণত করেছিল। সে বাস্তবতায় পোশাক পরিবর্তনের এ সিদ্ধান্ত।
সহযোগী কয়েকটি মিডিয়ায় পোশাক পরিবর্তনের বিষয়ে বিশ্লেষকদের মতামত প্রকাশ পেয়েছে। সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেছেন, পোশাকের রং পরিবর্তন করলে বাহিনী পরিবর্তন হয় না। ব্রিটিশ আমলে পুলিশ খাকি পোশাক পরত। খাকি পোশাক এখনও শ্রীলঙ্কান পুলিশ পরে। এ কারণে তাদের দক্ষতা তো কমে যায়নি। পুলিশ বাহিনীর কর্মক্ষমতার সঙ্গে পোশাকের কোনো সম্পর্ক নেই। সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ও বিশ্লেষক খান সাইফ হাসান বলেছেন, পোশাক পরিবর্তনে কোনো লাভ হবে না। শুধু কিছু কন্ট্রাক্টরের (ঠিকাদার) ব্যবসা হবে। দেশের মানুষের করের টাকা নষ্ট হবে। তিনি আরো বলেছেন, ২০০৩ সালে পুলিশের পোশাক পরিবর্তন করা হয়। আদৌ কি এ পোশাক পরিবর্তনের কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে? তিনি মনে করেন, মনমানসিকতাসহ সার্বিকভাবে পুলিশের মনোবল ফিরিয়ে আনতে পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান ড. ওমর ফারুক বলেছেন, পুলিশের পোশাক পরিবর্তনে লাভ হবে না। গুণগত পরিবর্তন দরকার। দরকার নৈতিকতা শক্তিশালী করা, সরকারি আচরণ বিধিমালা যথাযথভাবে মেনে চলার মাধ্যমে আইনের শাসন নিশ্চিত করা। তবে র্যাবের পোশাক পরিবর্তনের বিষয়টি ইতিবাচক বলে মনে করেন তিনি। তার ধারণা, র্যাবের পোশাক মানুষের মনে আতঙ্ক হিসেবে কাজ করছে।
আসলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর নগ্ন হস্তক্ষেপ যেন পরম্পরা। যে দল ক্ষমতায় আসে সে দলই এদের দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করে। অভিযোগ রয়েছে, কেউ কেউ আনুগত্য লাভের আশায় নিজেই দলীয় কর্মী বনে যান। যার পরিণতিতে তাদের ওপর আস্থা হারায় জনগণ। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান এবং পরবর্তী ঘটনাগুলো এর দৃষ্টান্ত। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এখন চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি জনগণের আস্থা ফেরানো। জনবান্ধব করতে হলে এদের প্রশিক্ষণে পরিবর্তন আনা জরুরি। আমরা মনে করি, বাহ্যিক পোশাকের পরিবর্তনে কোনো কাজ হবে না। দরকার তাদের শুদ্ধ চিন্তা ও নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। এজন্য সবার আগে দরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিজেদের মনমানসিকতার পরিবর্তন। তাদের মনে রাখতে হবে, জনগণের করের টাকায় তাদের বেতন-ভাতাণ্ডসম্মান। তাই জনগণের সেবক হয়েই তাদের সব অপবাদ ঘুচিয়ে জনগণের কাতারে আসতে হবে। আমরা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জনগণের কার্যকর বন্ধু হিসেবে দেখতে চাই। পোশাক পরিবর্তনের উদ্যোগটি যেন কেবল পোশাকি বিষয়ে আটকে না থাকে। পরিবর্তনের বাস্তব প্রতিফলনও দেখতে চায় সবাই।