রামদা দিয়ে প্রকাশ্যে কোপানোর একটি ভিডিওচিত্র ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওটিতে দেখা যায়, সড়কের মাথায় একটি বাড়ির দেয়ালঘেঁষে ফুটপাতে এক নারীকে রামদা দিয়ে জোরে আঘাত করছে এক যুবক। নারীর পাশে থাকা পুরুষকে রামদা দিয়ে সজোরে আঘাত করছে আরেক যুবক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া চলমান ছবিটি দেখে যে কোনো মানুষ আতঙ্কিত বোধ করবে। ভয়ে শিউরে উঠতে বাধ্য হবে। আমরা যে ভেতরে এখনও প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকার বয়ে চলেছি, এমন ঘটনার মধ্য দিয়ে তা-ই যেন প্রতিনিয়ত স্পষ্ট হচ্ছে। ঝা-চকচকে ইমারত আর সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গড়ে ওঠা গতির লড়াই আমাদের ভেতরটা পাল্টাতে পারেনি। আর তাই পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে অন্ধকার দিকগুলোর। রাজধানীর উত্তরায় প্রকাশ্যে রামদা দিয়ে এক দম্পতিকে কোপানোর খবরে আমরা শিউরে উঠি, আতঙ্কগ্রস্ত হই। মনে প্রশ্ন জাগে, এ কোথায় চলেছি?
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে- যাদের প্রকাশ্যে রামদা দিয়ে কোপানো হয়েছে তাদের অপরাধ কী ছিল? তাদের অপরাধ- বেপরোয়া গতিতে বাইক চালানোর তারা প্রতিবাদ করেছে। আর সেই প্রতিবাদের শোধ নিতেই তাদের ওপর রামদার কোপ। আমরা দেখছি, পথেঘাটে, পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে, সমাজে সবখানেই নিরাপত্তাহীনতার ছায়া। সবখানেই যেন বিপদ হাত বাড়িয়ে রয়েছে। এক্ষেত্রে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার অভাবও আমরা লক্ষ্য করছি। উত্তরায় দম্পতির ওপর হামলাকারীরা অস্ত্রধারী হলেও আশপাশের সাধারণ মানুষ এর প্রতিবাদে প্রতিরোধ না গড়ে ঘটনার ভিডিওচিত্র ধারণ করেছেন। আমাদের কাছে এ বিষয়টিও উদ্বেগের। কারণ আমরা মনে করি, আদালতের মাধ্যমে অপরাধীর দৃষ্টান্তযোগ্য শাস্তি নিশ্চিত করা যেমন জরুরি, তেমনি এ ধরনের ঘটনায় সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলাও জরুরি। অন্যথায় সমাজে এমন দানবের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে।
শুধু রাজধানীতেই নয়, সারা দেশেই সংঘাত, সহিংসতা, খুন-নির্যাতনসহ নানাবিধ অপরাধের সংখ্যা বাড়ছে। বরিশালের গৌরনদী উপজেলার মাহিলাড়া ইউনিয়নের জঙ্গলপট্টি গ্রামে আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদা দাবিকে কেন্দ্র করে হামলা চালিয়ে বাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট ও কুপিয়ে তিনজনকে রক্তাক্ত জখম করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক সহিংসতার খবর তো রয়েছেই। দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটা রাজনৈতিক এবং সামাজিক অপরাধবিষয়ক খবরগুলোও শঙ্কা ও উদ্বেগের।
সমাজ ও সংঘবদ্ধতার কারণে স্বাভাবিকভাবেই মানুষ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তবে তা যখন স্বাভাবিকতার সীমা অতিক্রম করে, তখনই তার অস্বাভাবিকত্ব ধরা পড়ে, তখনই তা ভীতির সঞ্চার করে। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তাকে সামাজিক অপরাধ বাড়ার বড় কারণ হিসেবে সম্প্রতি বিবেচনা করা হচ্ছে। গত ১৫ বছরে দলীয়করণের অভিযোগে অভিযুক্ত পুলিশ প্রশাসন গণঅভ্যুত্থানের পর অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। অন্তর্বর্তী সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে পুলিশকে কার্যকর করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এরইমধ্যে ?সাধারণের সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ প্রশাসনও সক্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছে। তারই উদাহরণ রাজধানীর উত্তরায় কোপানোর ঘটনার পরপরই অভিযুক্ত তিন যুবকের গ্রেপ্তার নিশ্চিত করার খবর।
আমরা অতীতে দেখেছি, অধিকাংশ সময়ই উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নেয় সামাজিক অপরাধে জড়িতরা। সেই সঙ্গে রয়েছে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের ঘটনাও; যা থেকে হিংসা, হানাহানি ও সংঘাতের শুরু। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে অবিলম্বে পুলিশ বাহিনীকে পরিপূর্ণরূপে সক্রিয় করে তুলতে হবে। তাদের সক্রিয় অনুপস্থিতির সুযোগে কেউ অস্থিরতার সুযোগ তৈরির মাধ্যমে দেশকে উত্তপ্ত করে তুলবে, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সাধারণের শান্তি বিঘ্নিত হবে, তেমনটি তো কারও কাছেই প্রত্যাশিত নয়। আমরাও চাই না, সংঘাত ও হানাহানি ছড়িয়ে পড়ুক। এজন্য সব পরিস্থিতিতে যেমন সব নাগরিককে সর্বোচ্চ সংযম দেখানোর জন্য বলি, তেমনি কারও প্ররোচনায় প্ররোচিত না হতেও আহ্বান জানাই। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, শান্তির পরিবেশ না থাকলে জনজীবনে স্বস্তি ফিরবে না। শুধু মুখে বা কাগজে-কলমে নয়, আমরা বাস্তবেও অহিংসার প্রতিফলন দেখতে চাই। এজন্য আমরা চাই, পুলিশ প্রশাসন দুষ্কৃতদের উদ্দেশে কড়া বার্তা দিক। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির দিকে সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে নজর দিক। একই সঙ্গে সংঘাত, সহিংসতা দমন করে কীভাবে দ্রুত জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব, তা নিয়ে সরকারকেও পরিকল্পনামাফিক কাজের জন্য বলি।