রেলওয়ে স্টাফদের কর্মবিরতিতে দেশজুড়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ আছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। গতকাল ঢাকা কমলাপুর ও বিমানবন্দরসহ সারা দেশের রেলওয়ে স্টেশন প্ল্যাটফর্মে এসে ফিরে গেছেন যাত্রীরা। কর্মবিরতি থেকে সরে আসতে রেলওয়ের রানিং স্টাফদের নিয়ে বৈঠকে বসেছিলেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী ও জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস। কিন্তু বৈঠকে কোনো সুরাহা না হওয়ায় স্টাফরা বেরিয়ে যান। রানিং স্টাফদের প্রতিনিধি সাইদুস রহমান বলেন, আমরা দীর্ঘক্ষণ রেল সচিব-মহাপরিচালকের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তবে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারিনি বলে ওই বৈঠক চলাকালীনই বেরিয়ে এসেছি।
জানা গেছে, রেলওয়ে স্টাফদের মূল বেতনের সঙ্গে রানিং অ্যালাউন্স যোগ করে পেনশন এবং আনুতোষিকের দাবিতে কর্মসূচি দিয়েছে। এই কর্মবিরতির কারণে গত সোমবার মধ্যরাতের পর ঢাকার কমলাপুর স্টেশন থেকে কোনো ট্রেন ছেড়ে যায়নি বলে স্টেশন মাস্টার মো. আনোয়ার হোসেন জানান। তিনি বলেন, ট্রেন চলাচল বন্ধ আছে। যাত্রীদের অনেকে আসছেন। আমরা টিকিট কাউন্টার থেকে তাদের ফেরত দিয়েছি।
বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রেন পরিচালকদের সংগঠন রেলওয়ে গার্ডস কাউন্সিল কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. আফজাল হোসেন বলেন, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন তারা। আমাদের কর্মসূচি চলছে, চলবে; যতক্ষণ না ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাদের সমস্যাগুলো নিরসন না করবে। ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেটসহ দেশের বড় শহরগুলো থেকে কোনো ট্রেন ছেড়ে যায়নি। ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় বিভিন্ন স্টেশনে এসে ফিরে গেছেন যাত্রীরা। পরে রেলপথ মন্ত্রণালয় জানায়, ট্রেনের যাত্রা বাতিল হলে যাত্রীদের টিকিট ফেরত দেয়া হবে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা রেজাউল করিম সিদ্দিকী জানান, রেলওয়ের রানিং স্টাফদের দাবি বহুলাংশে মেনে নেয়া সত্ত্বেও তারা তাদের পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি থেকে সরে আসেনি। এ কারণে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়েছে।
গত ২২ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে মাইলেজের ভিত্তিতে পেনশন ও আনুতোষিক প্রদান এবং নিয়োগপত্রের দুই শর্ত প্রত্যাহারসহ বিভিন্ন দাবি জানান রেলওয়ের রানিং স্টাফরা। দাবি বাস্তবায়নের দাবিতে ২৮ জানুয়ারি থেকে কর্মবিরতির ঘোষণা দেন রানিং স্টাফরা।
গার্ড, লোকোমাস্টার, সহকারী লোকোমাস্টার, সাব লোকোমাস্টার এবং টিটিইরা রেলের রানিং স্টাফ। এরা ট্রেন চালানোর সঙ্গে সরাসরি জড়িত। সারা দেশে রেলওয়েতে ১৭শ’ বেশি রানিং স্টাফ কাজ করেন। দৈনিক কর্মঘণ্টা ৮ ঘণ্টা হলেও রানিং স্টাফদের গড়ে ১৫ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। সেজন্য তাদের আগে দেয়া হতো বিশেষ আর্থিক সুবিধা, যাকে রেলওয়ের ভাষায় বলা হয় মাইলেজ। মাইলেজ রানিং স্টাফদের বেতনেরই অংশ। প্রতি ১০০ কিলোমিটার ট্রেন চালালে রানিং স্টাফরা মূল বেতনের এক দিনের বেসিকের সমপরিমাণ টাকা অতিরিক্ত পেতেন। ৮ ঘণ্টায় এক দিনের কর্মদিবস ধরলে রানিং স্টাফদের প্রতি মাসে কাজ দাঁড়ায় আড়াই বা তিন মাসের সমপরিমাণ। তাদের বেতনও সেভাবেই দেয়া হতো। এছাড়া মূল বেতনের হিসাবে অবসরকালীন ভাতা যা হয়, তার সঙ্গে অতিরিক্ত আরো ৭৫ শতাংশ টাকা বেশি দিয়ে তাদের পেনশন দেয়া হতো। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে রানিং স্টাফদের সেই সুবিধা বাতিল করা হয়। এরপর থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ঐক্য পরিষদে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন করছে।
গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস ধরে জামালপুরে যাওয়ার কথা হাসান আলীর। কিন্তু কর্মীদের ধর্মঘটে ট্রেন চলাচল যে বন্ধ, সেটা তিনি জানতে পেরেছেন ঢাকার কমলাপুর স্টেশনে আসার পর। একইরকম ভোগান্তিতে পড়েছেন দিনাজপুরের যাত্রী সোহরাব হোসেন। স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে সকালে কমলাপুর থেকে রওনা হওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু ট্রেন চলাচল বন্ধের ঘোষণায় তিনিও বিপাকে পড়েছেন। কক্সবাজারে যেতে কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসেছিলেন ৯ কিশোর। তাদের একজন মো. নাদিম বলেন, সকাল ৬টা ১৫ মিনিটে পর্যটন এক্সপ্রেসে কক্সবাজার যাওয়ার কথা ছিল। এখন এখানে এসে শুনি ট্রেন যাবে না। আগে জানলে আমরা টিকিট কাটতাম না।
বেসরকারি চাকরিজীবী শফিকুল ইসলাম বলেন, বেনাপোল যাওয়ার জন্য গত ২৪ তারিখে টিকিট কেটেছিলাম। ১০টা ৪৫ মিনিটে রূপসী বাংলা ট্রেনে বেনাপোল যাওয়ার কথা ছিল। আমি বাসে যাতায়াত করতে পারব না। ট্রেন যদি না-ই যাবে, তাহলে টিকিট বিক্রি করল কেন? আমি তো মহাপবিপদে পড়লাম।
ময়মনসিংহে রেলের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতিতে থাকা আন্দোলনকারীদের ভয়ে নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনটি যাত্রীসহই রেখে পালিয়ে যান চালক। এ ঘটনায় ট্রেন যাত্রীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে স্টেশন সুপারিনটেনডেন্টকে অবরুদ্ধ করলে প্রায় ৩৫০ জন যাত্রীর টিকিট মূল্য ফেরত দেয়া হয়।
বন্ধ থাকা ট্রেনের যাত্রীদের বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছে দিতে বিআরটিসির বাসের ব্যবস্থা করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, এসব বাস ঢাকার কমলাপুর এবং বিমানবন্দর স্টেশন থেকে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, কুমিল্লা, বগুড়া ও ময়মনসিংহে যাত্রী পৌঁছে দেবে। যাত্রীরা তাদের রেলের টিকিট ব্যবহার করে এসব বাসে চড়তে পারবেন। আর যাত্রী চাইলে টিকিটের টাকা রেলের কাউন্টার থেকে ফেরত নিতে পারবেন।
দূরদূরান্ত থেকে যাত্রীরা খুলনা রেলওয়ে স্টেশনে এসে ট্রেন চলাচল বন্ধ দেখে ফিরে গেছেন। অবশ্য এখানে অগ্রিম কাটা টিকিটের অর্থ যাত্রীদের ফেরত দিয়েছে রেলস্টেশন কর্তৃপক্ষ। খুলনা থেকে ট্রেন বন্ধ থাকায় চাপ পড়েছে বাসের উপর। এতে বাসের ভাড়া বাড়িয়ে দেয়ারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। বাস না পেয়ে ট্রেন ছাড়বে, সেই আশায় অনেককে স্টেশনের আশপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে।
বগুড়া : গতকাল সকাল থেকে কোনো ট্রেন চলাচল করেনি বগুড়ার রেলপথে। যাত্রী বিকল্পভাবে তাদের গন্তব্যে যেতে মাইকিং করে জানাচ্ছেন রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। বেলা ১২টার দিকে বগুড়া রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে, স্টেশন কর্তৃপক্ষ হ্যান্ডমাইকে ঘোষণা দিয়ে ট্রেন বন্ধের বিষয়ে যাত্রীদের অবগত করতে দেখা গেছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে যাত্রীরা এসেছেন যারা ট্রেনে করে যাতায়াত করেন। তারা অপেক্ষা করছেন ট্রেনের জন্য তবে যেহেতু চলাচল বন্ধ তাই এই খবরে ফিরে যাচ্ছেন। অনেকেই আক্ষেপ করে জানান যে আগে থেকে যদি জানানো হতো তাহলে হয়তো বা এমন ভোগান্তিতে তারা পড়তো না বিশেষ করে দূরপাল্লার যাত্রীরা যারা বেশ কয়েকদিন আগেই টিকিট কেটেছেন এবং ট্রেনে করেই তারা যাবেন কিন্তু এসে দেখেন ট্রেন বন্ধ তার কারণে জরুরি প্রয়োজনে যাওয়া সেই মানুষগুলোর ভোগান্তি আরো বেশি।
চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ট্রেনের অপেক্ষায় বসে আছেন অনেক যাত্রী। তারা বলছেন, রেলওয়ে রানিং স্টাফদের কর্মবিরতির কারণে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকবে সেটি জানতাম না। স্টেশনে এসে দেখি টিকিট বিক্রি হচ্ছে না। আবার দ্রুত গন্তব্যে যেতে হচ্ছে। সরকারের উচিত দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করা।
সিরাজগঞ্জ : সারা দেশের ন্যায় সিরাজগঞ্জেও গত সোমবার মধ্যরাত থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। রেওলয়ের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতির কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল সকাল থেকেই সিরাজগঞ্জ, সদানন্দপুর, উল্লাপাড়া, জামতৈল রেলস্টেশনে ট্রেন যাত্রীদের অবস্থান করতে দেখা গেছে। কিন্তু ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় যাত্রীদের মধ্যে নানা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া গত সোমবার দুপুরের পর থেকে সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেসসহ বিভিন্ন ট্রেনের সরাসরি টিকিট ও অনলাইনে টিকিট কেটেছিল বহু যাত্রী। কিন্তু তাদের এ দাবির প্রেক্ষিতে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য অনেক যাত্রী ট্রেনের টিকিট ফেরত দিয়ে এখন বাসের অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। এদিকে ট্রেন বন্ধের কারণে জেলার বিভিন্ন বাস টার্মিনালে যাত্রীর চাপ বাড়ায় বাস চালক, সুপার ভাইজার ও হেল্পারদের হাসিরও সৃষ্টি হয়েছে। একাধিক চালক বলছেন, এভাবে কয়েকদিন থাকলে আমাদের ভালোই হতো। সকাল থেকেই বাসের সিট নাই এবং অনেক যাত্রীকে দাঁড়িয়ে থেকে যেতে হচ্ছে। তবে মহাসড়কে দূরপাল্লার বাসের যাত্রী চাপ একই অবস্থা বলে তারা উল্লেখ করেন। এ বিষয়ে রেল স্টেশন মাস্টার হীরা আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, রেলওয়ের রানিং স্টাফরা কর্মবিরতিতে যাওয়ায় সারাদেশে ট্রেন চলাচল এখন বন্ধ রয়েছে। ট্রেনের অনেক যাত্রী টিকিট ফেরত দিয়ে টাকা ফেরত নিচ্ছেন এবং অনলাইনের মাধ্যমের টিকিটও ফেরত দেয়া হচ্ছে। তবে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক বিষয়ে এখন কিছু বলা যাচ্ছে না বলে তিনি উল্লেখ করেন।
রাজশাহী : হঠাৎ ট্রেন বন্ধ করে দেয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে রাজশাহী স্টেশনে ভাঙচুর চালিয়েছেন যাত্রীরা। গতকাল ভোর থেকে স্টেশন থেকে ছেড়ে যায়নি কোনো ট্রেন। লোকাল, আন্তঃনগর, মেইলসহ সব ধরনের ট্রেন বন্ধ রয়েছে। ভোর থেকে শত শত মানুষ অপেক্ষা করছেন। হঠাৎ ট্রেন চলাচল বন্ধে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ ও অফিসগামী যাত্রীরা। ফলে ক্ষুব্ধ হয়ে অনেকে স্টেশন ভাঙচুর করেছেন। রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের তথ্যমতে, রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশন থেকে প্রতিদিন ১৮ জোড়া ট্রেন ছেড়ে যায়।
ময়মনসিংহ : ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় যাত্রীচাপ বেড়েছে বাসে। আর এ সুযোগে ২ থেকে ৩ গুণ পর্যন্ত বাসভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন ময়মনসিংহের অনেক চালকরা। অফিস আদালত খোলা থাকায় বাধ্য হয়েই অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে গন্তব্যে যাচ্ছেন যাত্রীরা। গতকাল মঙ্গলবার সকালে ময়মনসিংহ নগরীর পাটগুদাম ব্রিজ মোড় ও বাইপাস মোড়ে যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়। অনেকে বাসের সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন গন্তব্যে। আবার অনেকে গাড়ির সিট না পেয়ে অন্য গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছেন। অন্যান্য দিনের চেয়ে যাত্রী বেড়েছে কয়েকগুণ। ঢাকাগামী সাদ্দাম হোসেন বলেন, অফিসে যাওয়ার জন্য ট্রেনের টিকিট কিনেছিলাম। স্টেশনে গিয়ে দেখি ট্রেন চলাচল বন্ধ। ফলে বাধ্য হয়ে বাসে যাওয়ার জন্য পাটগুদাম ব্রিজ মোড়ে যাই। এসে দেখি আজ বাসগুলো ৪০০-৫০০ টাকা ভাড়া চাচ্ছে। যেহেতু রাস্তায় যাত্রী বেশি তাই অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েই গন্তব্যে যেতে হবে। নগরীর আরেক বাসস্টপ বাইপাসে ঢাকামুখী পরিবহনের একটি বাসের সিটে বসে ছিলেন যুবক সাব্বির। তিনি বলেন, নগরীর মাসকান্দা থেকে ইউনাইটেড বাসে গেলে দ্রুত যাওয়া যায়। আমি এই বাস টার্মিনাল চিনি না তাই বাইপাস মোড়ে চলে আসি।