জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনতিবিলম্বে কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। অন্যথায় দেশের জনগণ ও অর্থনীতির সুরক্ষায় সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার বার্তা দিয়েছে। সম্প্রতি এনবিয়ার পুনর্গঠনের সিদ্ধান্তের পর এর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লাগাতার আন্দোলন এবং কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির প্রেক্ষিতে এ বিবৃতি দিয়েছে সরকার। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বাজেট ব্যবস্থাপনায় উন্নয়নমুখী কার্যক্রম পরিচালনার সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো দুর্বল রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থা। রাষ্ট্রের প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের রাজস্ব সংগ্রহ অনেক কম। এর মূল কারণ হলো আমাদের রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থাপনার নানা দুর্বলতা, অনিয়ম ও দুর্নীতি। এ প্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকার সকল অংশীজনের পরামর্শ অনুযায়ী জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এই পুনর্গঠনের সিদ্ধান্তের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনের কারণে জনদুর্ভোগ তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে বিবৃতি বলা হয়, সরকার গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছে যে, রাজস্ব সংস্কারের কাজকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ নজিরবিহীনভাবে গত ২ মাস ধরে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি এবং রাজস্ব আদায় কার্যক্রম অন্যায় ও অনৈতিকভাবে ব্যাহত করে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে আন্দোলনের নামে চরম দুর্ভোগ তৈরি করেছে যা সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য।
এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনকে সংস্কারবিরোধী আখ্যা দিয়ে বিবৃতি আরও বলা হয়, সংস্কারের বিরোধিতা ছাড়াও অর্থ বছরের শেষ ২ মাসে তারা রাজস্ব আদায় কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে। এই তথাকথিত আন্দোলন পরিকল্পিত ও দুরভিসন্ধিমূলক যা জাতীয় স্বার্থ এবং নাগরিক অধিকারের চরম পরিপন্থি। সরকারের পক্ষ থেকে রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি বিবেচনায় নেওয়ার সুস্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া হয় এবং আলোচনায় আসার আহ্বান জানালেও তারা তা অগ্রাহ্য করে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান না করে তারা আন্দোলনের নামে অনমনীয় অবস্থান নিয়ে ক্রমাগত দেশের অর্থনীতির ক্ষতি করে চলেছে। এ পরিস্থিতিতে জাতীয় স্বার্থে সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতাধীন সকল কাস্টমস হাউস, আইসিডি, বন্ড কমিশনারেট এবং শুল্ক স্টেশনসমূহের সকল শ্রেণির চাকরিকে অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস (Essential Services) ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এদিকে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) দ্বিতীয় দিনের মতো ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। শনিবার এনবিআরসহ দেশের সব শুল্ক-কর কার্যালয়ে দিনভর পূর্ণাঙ্গ শাটডাউন কর্মসূচি পালনের পর রোববারও তা অব্যাহত রেখেছেন আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। মূলত, এনবিআর বর্তমান চেয়ারম্যানের অপসারণ ও সব পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে রাজস্ব খাতের সংস্কারের দাবিতে এ কমপ্লিট শাটডাউন ও মার্চ টু এনবিআর কর্মসূচি পালন করছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে এ আন্দোলন হচ্ছে।
গতকাল রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় আগারগাঁওয়ের রাজস্ব ভবনের সামনে আন্দোলনকারীদের উপস্থিতি দেখা যায়। এনবিআরের প্রধান কার্যালয়ের সবগুলো গেট বন্ধ রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সশস্ত্র অবস্থান দেখা যায়। ফলে এনবিআরে কেউ প্রবেশ কিংবা বের হতে পারেনি। অবরুদ্ধ এনবিআরের প্রধান গেটের সামনেই এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে পালিত হচ্ছে শাটডাউন কর্মসূচি।
আন্দোলনকারীদের হাতে গতকালও ‘দফা এক, দাবি এক, চেয়ারম্যানের পদত্যাগ’, ‘আব্দুর রহমান খানকে রেখে কোনো আলোচনা নয়’ ইত্যাদি প্ল্যাকার্ড দেখা গেছে। ঢাকাসহ সারাদেশের এনবিআরের কর ও কাস্টমস কার্যালয়েও একই ধরনের কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।
আন্দোলনকারীরা ‘শাটডাউন’ করুক, কোনো বৈঠক হবে না -অর্থ উপদেষ্টা : জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আন্দোলনকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে আজ কোনো বৈঠক হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেছেন, কর্মকর্তারা শাটডাউন কর্মসূচি পালন করতে চাইলে করুক। গতকাল রোববার অর্থ মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে এসব কথা বলেন অর্থ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, এনবিআরের কর্মকর্তাদের আন্দোলনের বিষয় নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রেস রিলেজ দিয়ে জানানো হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আন্দোলনকারী এনবিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক না করার বিষয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এমনকি ১ জুলাই বিকেল ৪টায় তাদের সঙ্গে যে বৈঠক হওয়ার কথা, সেটাও হবে কি না, তা নিয়ে পরে সিদ্ধান্ত হবে।
এর আগে এনবিআরের একটি সূত্র জানিয়েছিল, অচলাবস্থা নিরসনে রোববার বিকেল ৪টায় অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করবেন এনবিআরের আন্দোলনকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অর্থ উপদেষ্টার কার্যালয়ে এই বৈঠক হবে।
এনবিআর সংস্কারে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন : জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় পাঁচ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। গতকাল রোববার সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের একথা বলেন। তবে কমিটিতে কারা আছেন এবং কমিটির কার্য পরিধি কী হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত জানাননি অর্থ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, এনবিআর কীভাবে সংস্কার করা যায়, সে বিষয়ে কমিটি আলাপ-আলোচনা করবে। তারা সবার কথা শুনবে।
৫ সদস্যের কমিটিতে কারা কারা আছেন? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, কমিটিতে কারা আছেন তাদের নাম আমি এখন বলব না। এনবিআরর ৬ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক, যারা আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ওটা আমার কনসার্ন ডিপার্টমেন্ট না। গতকাল রোববার পৌনে ছয়টার দিকে সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন অর্থ উপদেষ্টা। সন্ধ্যা ৭টার দিকে বৈঠক শেষ হয়। এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সব শ্রেণির চাকরিকে অত্যাবশ্যকীয় সেবা ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। একই সঙ্গে সংস্থাটির আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্থলে ফেরার আহ্বান জানিয়ে সরকার বলেছে, কাজে যোগ না দিলে দেশের জনগণ ও অর্থনীতির সুরক্ষায় সরকার কঠোর হবে। গতকাল রোববার সরকার এক বিবৃতিতে এমনটা জানিয়েছে।