ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫, ২৪ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র দেখছে বিএনপি

* নির্বাচনকে পিছিয়ে দিয়ে একটি গোষ্ঠী জাতির সর্বনাশ করতে চাচ্ছে : মির্জা আব্বাস * যত বাধাই আসুক ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হতেই হবে : শামসুজ্জামান দুদু * অধ্যাপক ইউনূস ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন দেবেন, বিশ্বাস হয় না বিএনপি নেতা ফজলুরের
নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র দেখছে বিএনপি

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনকে স্পষ্ট কোনো বার্তা না দেয়ায় ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় নিয়ে কৌতূহল বাড়ছে। বিশেষ করে বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলো বাদে বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ বেশ কিছু দল সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি ও সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) নির্বাচনসহ কিছু বিষয় নতুন করে সামনে আনার চেষ্টা করছে।

জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার উপাদান বলে মনে করছে বিএনপি। লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকের পর সারাদেশে নির্বাচনের যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল, তা এখন আর নেই। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র দেখছে বিএনপি। দলটির একাধিক বিশ্বস্থ সূত্র থেকে এমন তথ্য জানা গেছে। সূত্রমতে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় নিয়ে ঐকমত্য দেখা যাচ্ছে। একাংশের মধ্যে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিও যেমন রয়েছে, তেমনি অন্য অংশের নেতারা এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে আরো সময় নিতে বলছেন। দোদুল্যমান অবস্থায়ও রয়েছে কিছু দল। নতুন ও ছোট দলগুলো দেরিতে নির্বাচনের পক্ষে।

বিএনপির নেতাকর্মীরা বলছে, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে এরইমধ্যে একটি মহল ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। কিন্তু সেই ষড়যন্ত্র কোনোভাবেই বাস্তবায়ন হতে দেওয়া হবে না। সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা হবে।

একটি গোষ্ঠী নির্বাচনকে পিছিয়ে দিয়ে জাতির সর্বনাশ করতে চাচ্ছে বলে মন্তব্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, একেকজন একেকটা দাবি তুলে নির্বাচনকে পিছিয়ে, নির্বাচনের অবস্থা সর্বনাশ করে দিয়ে এ জাতির সর্বনাশ করতে চাচ্ছে। রমনা থানা বিএনপির নতুন সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন কার্যক্রম অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন মির্জা আব্বাস। তিনি বলেন, এভাবে বড় বড় সমাবেশ করে জাতির কাছে ভুল বার্তা পৌঁছাবেন না। সমাবেশ দিয়ে যদি প্রমাণ করা যায় কে কত জনপ্রিয়, আমরা সারা বাংলাদেশকে একদিনে সমাবেশের আওতায় আনতে পারি। সারা বাংলাদেশ একদিনে সমাবেশ করবে। কেউ কোনো জায়গা ছাড়বে না। এটা তো সিস্টেম হলো না।

মির্জা আব্বাস বলেন, সবাইকে অনুরোধ জানাব আউল-ফাউল কথাবার্তা বইলেন না কেউ। আপনারা এই সমস্ত কথাবার্তা বলে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করবেন না।

ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ রেজাউল করীমকে উদ্দেশ করে মির্জা আব্বাস বলেন, যখন বিএনপি-জামায়াতের ওপরে স্টিমরোলার চালানো হচ্ছিল, তখন ওই দলটি এবং তার নেতা দূরে থেকে বাহবা দিয়েছেন। ইনডাইরেক্টলি হাসিনাকে সমর্থন দিয়েছেন। কালো নির্বাচন, রাতের নির্বাচন, দিনের নির্বাচন; তিনবার নির্বাচন হয়েছে, উনারা কোনো প্রতিবাদ করেন নাই। এখন লম্বা কথা বলতেছেন, আগে দিতে হবে স্থানীয় নির্বাচন, এরপর দিতে হবে পিআর সিস্টেম (আনুপাতিক পদ্ধতি)। যত দিন এগুলো না হবে, তত দিন এ দেশে কোনো নির্বাচন হবে না।

‘পিআর পদ্ধতি কই থেকে আসে’ প্রশ্ন করে মির্জা আব্বাস বলেন, দেশটাকে সুন্দর করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে কিছু করেন না, শুধু আপনার কথামতোই হতে হবে, স্থানীয় সরকার আগে হতে হবে, আবার পিআর ভোট করতে হবে। কেন ভাই? কই থেকে আবিষ্কার করেন এগুলা? কে দেয় বুদ্ধি আপনাদের? এসব কুপরামর্শ নিয়ে, এই দেশ ও জাতিকে ধ্বংস করার জন্য একদল লোক আজ মাঠে নেমেছে।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেছেন, নির্বাচনের দিনটার জন্য মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে গণতন্ত্র রক্ষা পাবে। তাই যত বাধা-বিপত্তি আসুক না কেন, ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হতেই হবে। এর সঙ্গে কোনো আপস নয়। গতকাল এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। শামসুজ্জামান দুদু বলেন, যারা সকালে এক কথা, দুপুরে এক কথা, আবার বিকালে আরেক কথা বলছেন, তাদের বলব- আসুন, আমরা সবাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি। ত্রুটি-বিচ্যুতি যেগুলো থাকবে, আমরা বসে সমাধান করি। আর মানুষ যাকে ভোট দেবে, সেই দল সরকার গঠন করবে। আসুন, আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করি। তিনি বলেন, গণতন্ত্র উত্তরণের একমাত্র পথ হচ্ছে নির্বাচন। আর সেই নির্বাচনকে যদি বাদ দেওয়া হয়, বিতর্ক করা হয়- তাহলে তো পরোক্ষভাবে স্বৈরতন্ত্রের পক্ষ হয়ে যায়।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ফজলুর রহমান বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন দেবেন বলে তাঁর বিশ্বাস হয় না। তিনি বলেন, ‘ইউনূস সাহেব যেদিন ইলেকশন (নির্বাচন) দেবেন, সেদিন আমি বিশ্বাস করব। আমার নেতা তারেক রহমান বিশ্বাস করছেন, আমিও করলাম। কিন্তু ভাবসাব দেখে মনে হয় না।’

ফজলুর রহমান বলেন, ‘ফেব্রুয়ারিতে যদি ইলেকশন হয়, ইউনূস সাহেব আপনাকে সালাম। আপনি ঘোষণা করেন, ফেব্রুয়ারির কত তারিখ ইলেকশন দেবেন? কী বারে ইলেকশন দেবেন? কারা কারা রিটার্নিং অফিসার হবে? কত দিন পর্যন্ত নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা করা যাবে? এগুলো করেন। করেন না কেন?’

গত শনিবার ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সমাবেশে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি ছাড়া আগামী নির্বাচন দেশের মানুষ মানবে না। এ নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঐক্য তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘দৃশ্যমান সংস্কার সম্পন্ন করতে হবে। যারা বলেন ক্ষমতায় গেলে সংস্কার করবেন, তারা কীভাবে বুঝলেন তারা ক্ষমতায় যাবেন?’ মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিছু কিছু আচরণ জনগণের মধ্যে সন্দেহ তৈরি করেছে। নির্বাচনের আগে নিজেদের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে হবে। লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে।’ ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাইর পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেছেন, আগামী নির্বাচনে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে হবে। যে যত শতাংশ ভোট পাবে তাদের তত শতাংশ প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এটা এখন জনগণের দাবি, অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের দাবি।’ এসময় তিনি বিএনপিকেও পিআর সিস্টেমে নির্বাচনে আসা উচিত বলে মত দেন।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সমাবেশে যোগ দিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন যেন পিআর পদ্ধতিতে হয়, সেই দাবি নিয়ে জোরেজোরে জাগতে হবে। তিনি বলেন, দেশ ও জনগণের জন্য প্রয়োজনে তারা আবারও লড়াইয়ে নামবেন।

এদিকে, গত বৃহস্পতিবার বিকেলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন। তারা দীর্ঘ সময় একান্তে কথা বলেন। বিএনপির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা ধারণা করেছিলেন, প্রধান উপদেষ্টা গত বৃহস্পতিবার যমুনায় এই বৈঠকে সিইসিকে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর কথা বলবেন; কিন্তু সরকারের দিক থেকে এই বৈঠককে শুধু সৌজন্য সাক্ষাৎ বলা হয়েছে। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনও কোনো বক্তব্য দেয়নি। ফলে বিএনপি মনে করছে, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের বিষয়ে সিইসিকে স্পষ্ট কোনো বার্তা দেননি। যার ফলে প্রধান উপদেষ্টা ও সিইসির সাক্ষাতে কী আলাপ হয়েছে, তা পরিষ্কার করার আহ্বান জানায় বিএনপি। এ বিষয়ে গত শুক্রবার বিকেলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যদি উভয় পক্ষ থেকে জাতির সামনে বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়, তাহলে আমরা আশ্বস্ত হই।’ তিনি আরও বলেন, যারা স্থানীয় নির্বাচন ও আনুপাতিক হারে নির্বাচনের দাবি তুলছে, তাদের একটা উদ্দেশ্য থাকতে পারে; হয় নির্বাচন বিলম্বিত করা অথবা নির্বাচন না হওয়া।

বিএনপির নেতারা বলছেন, তাদের কাছে এখন পর্যন্ত সরকারের দিক থেকে লন্ডন বৈঠকের ওই ঘোষণার কোনো প্রতিফলন নেই; বরং রাজনীতিতে নতুন নতুন কিছু ইস্যু তৈরির চেষ্টা হচ্ছে, যা জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার উপাদান বলে মনে করছেন। এর মধ্যে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা এবং আগামী নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন (পিআর) পদ্ধতি প্রবর্তনের দাবি জোরদার করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত