বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ তীরে দেশের সর্ববৃহৎ জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল দুপুর পৌনে ২টায় জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এতে ইমামতি করেন তাবলিগ জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় মাওলানা জুবায়ের আহমেদ। জুমার নামাজে অংশ নিতে ময়দান ছাড়িয়ে আশপাশে সড়ক, মহাসড়ক, ফুটপাত ও বিভিন্ন অলিগলি মুসল্লিতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। তাবলিগ জামাতের শুরায়ি নেজামের মিডিয়া সমন্বয়ক হাবিবুল্লাহ রায়হান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এদিকে সকালে ফজরের নামাজের পর আম বয়ান করেছেন পাকিস্তানের মাওলানা জিয়াউল হক। তাৎক্ষণিকভাবে তা বাংলায় অনুবাদ করছেন মাওলানা নুরুর রহমান। পৌনে ১০টায় খিত্তায় খিত্তায় তালিমের আমল করা হয়। তালিমের আগে মোজাকেরা (আলোচনা) করেন ভারতের মাওলানা জামাল সাহেব। এছাড়া বিশেষ কিছু অনুষ্ঠান হয়েছে। যেমন, সকাল ১০টায় শিক্ষকদের বয়ানের মিম্বারে বয়ান করেছেন ভারতের মাওলানা ফারাহিম সাহেব। ছাত্রদের সঙ্গে নামাজের মিম্বারে বয়ান করেছেন প্রফেসর আব্দুল মান্নান সাহেব, খাওয়াছদের (গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ) মাঝে টিনশেড মসজিদে বয়ান করেছেন ভারতের মাওলানা আকবর শরিফ সাহেব।
এদিকে দেশের বৃহত্তম জুমার নামাজে অংশ নিতে সকালে থেকেই ইজতেমা ময়দানের উদ্দেশে মুসল্লিদের ঢল নামে। ইজতেমায় অংশ নিতে না পারলেও দেশের বৃহত্তম জুমার নামাজের জামাতে অংশ নিতে ময়দানমুখী হয়েছে ঢাকা ও গাজীপুরের আশপাশের বিভিন্ন জেলার মানুষ।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ভারতের মাওলানা ইব্রাহিম দেওলার আমবয়ানের মধ্য দিয়ে ইজতেমার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। এ ধাপে অংশ নিতে আসা মুসল্লিতে ভরে যায় ইজতেমা মাঠ। এর মধ্যে ইজতেমার জামাতের সঙ্গে জুমার নামাজ পড়তে গতকাল সকাল ১০টা থেকেই দল বেঁধে ইজতেমা মাঠে আসতে থাকেন রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের এলাকার সাধারণ মুসল্লিরা। একপর্যায়ে মাঠে জায়গা না পেয়ে অনেকেই রাস্তায় বা ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়েন।
জুমার নামাজ পড়ানোর (ইমাম) জন্য মাওলানা জোবায়ের দাঁড়ান তুরাগ নদের পশ্চিম পাড়ে আইইউবিএটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। নামাজের খুতবা শুরু হয় বেলা একটা ৪৩ মিনিটে। এরপর নামাজ শুরু হয় একটা ৫০ মিনিটে। এ সময় মাঠে জায়গা না পেয়ে অনেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বাটাগেট, স্টেশন রোড এলাকাসহ কামারপাড়া-মন্নুগেট সড়কে দাঁড়ান। এতে কিছু সময়ের জন্য সড়কের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
সরজমিনে দেখা যায়, টঙ্গীর ইজতেমা মাঠ ও তুরাগ নদের তীরে হাজারো মুসল্লির আনাগোনা। মূল ইজতেমা মাঠে বাঁশ ও চটের তৈরি শামিয়ানার নিচে অবস্থান নেন হাজার হাজার মুসল্লি। জুমার নামাজে অংশ নিতে সকাল থেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে মুসল্লিরা ইজতেমা মাঠের দিকে আসতে থাকেন। কারও হাতে নামাজের বিছানা, কারও হাতে পাটি। এর মধ্যে বেলা একটা ৫০ মিনিটে মাইকে ভেসে আসে নামাজের আকামত। মুহূর্তেই বন্ধ হয়ে যায় সব ছোটাছুটি। যে যেখানে ছিলেন, বিছানা পেতে নামাজে দাঁড়িয়ে যান। মুসল্লিদের সেজদায় মাথা নোয়ানোর মাধ্যমে পুরো এলাকায় নেমে আসে পিনপতন নীরবতা।
বিগত বছরগুলোয় তাবলিগের দুই পক্ষ মাওলানা জোবায়ের ও সাদ কান্ধলভীর অনুসারীরা দুই পর্বে আলাদাভাবে ইজতেমা করতেন। তবে এবারই প্রথম মাওলানা জোবায়ের অনুসারীরা দুই ধাপে ইজতেমা করবেন। এর মধ্যে গতকাল ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হবে প্রথম ধাপের ইজতেমা। এ ধাপে অংশ নেবেন ৪১ জেলা ও ঢাকার একাংশের মুসল্লিরা। এরপর ৩ থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে দ্বিতীয় ধাপের ইজতেমা। ২ ও ৫ ফেব্রুয়ারি দুই পর্বের আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। এরপর তৃতীয় ধাপে আগামী ১৪ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি মাওলানা সাদের অনুসারীদের ইজতেমা পালনের কথা আছে।
ইজতেমা মাঠের সার্বিক নিরাপত্তায় পুলিশ ও র্যাবের কন্ট্রোল রুম এবং ওয়াচ টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছে। মনিটরিং করা হচ্ছে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে। খিত্তায় খিত্তায় সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়েছেন। ইজতেমা আয়োজক কমিটির নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রায় ১০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে।
ইজতেমার মুরুব্বিদের দেয়া তথ্যমতে, ১৯৪৬ সালে কাকরাইল মসজিদে প্রথম ইজতেমার আয়োজন করা হয়। তারপর ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামের হাজী ক্যাম্পে এবং ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। পরে লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ১৯৬৬ সালে গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে স্থানান্তর করা হয় ইজতেমা। পরে ১৯৭২ সালে সরকারিভাবে তুরাগ তীরের ১৬০ একর জমি স্থায়ীভাবে ইজতেমার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়।
প্রথম দিনেই ৩ মুসল্লির মৃত্যু : গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপির) গোয়েন্দা বিভাগের তথ্যে জানা গেছে, ৪৬টি দেশের বিদেশি মুসল্লি এবারের প্রথম পর্বের ইজতেমায় অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে উর্দুভাষী ৭৬০, আরবের ৮৯ ও ইংরেজ ৩০৫ জন। আগে থেকেই বাংলাদেশে থেকে অবস্থানরত বিদেশি মেহমান ৪২৬ জনসহ মোট ১৫৮০ জন চারটি বিদেশি টেন্টে অবস্থান করছেন। এ পর্যন্ত তিনজন মুসল্লির মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
তারা হলেন- আমিরুল ইসলাম (৪০), আব্দুল কুদ্দুস গাজী (৬০) ও সাবেদ আলী (৭০)। এর মধ্যে আব্দুল কুদ্দুস গাজী ইজতেমা ময়দানে ও বাকি দুইজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। আব্দুল কুদ্দুস খুলনা জেলার ডুমুরিয়া বাজার এলাকার লোকমান হোসেন গাজীর ছেলে।
শ্বাসকষ্টসহ অন্য রোগে এখন পর্যন্ত ৩৮ মুসল্লি টঙ্গী শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে যার যার খিত্তায় চলে যান। এর মধ্যে একজন বিদেশি, পাঁচজন পুলিশ সদস্য রয়েছেন। মুসাব্বির নামে এক পুলিশ সদস্য শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।