আজ ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় শহিদ সেনা দিবস’। পিলখানা বিডিআর সদর দপ্তরে হত্যাযজ্ঞের ১৬ বছর। ১৬ বছর আগে ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআরের (বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি) সদর দপ্তর ঢাকার পিলখানায় রহস্যময় এক বিদ্রোহের নামে বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা বর্বরোচিত ও নির্মম হত্যার শিকার হন। সব মিলিয়ে ওই ঘটনায় ৭৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এদিকে ২৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘জাতীয় শহিদ সেনা দিবস’ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা এক পরিপত্রের মাধ্যমে গত রোববার এ ঘোষণা দেয়া হয়। পরিপত্রে বলা হয়েছে, সরকার প্রতিবছর ২৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘জাতীয় শহিদ সেনা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং ওইদিন ‘জাতীয় শহিদ সেনা দিবস’ (সরকারি ছুটি ব্যতীত) পালনের জন্য ‘গ’ শ্রেণিভুক্ত দিবস হিসেবে অন্তর্ভুক্তকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই সিদ্ধান্ত যথাযথভাবে প্রতিপালনের জন্য সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাকে অনুরোধ করা হয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, বাংলাদেশের ওপর আধিপত্যবাদী শক্তির দখলদারিত্ব কায়েমের জন্য আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল পিলখানা হত্যাকাণ্ড। তিনি বলেন, এটি কোনো বিদ্রোহ ছিল না, ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। পিলখানা হত্যাকাণ্ডে আমরা জাতির সূর্য সন্তানদের হারিয়েছি। যার মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ভিতকে আঘাত করা হয়েছে। ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের কবর রচনা করে নৈরাজ্যবাদের জন্ম দিয়েছিল পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা বিডিআরের পোশাক পরে পিলখানা হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ডদের অনেকেই এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। তাদের বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। বহুল আলোচিত পিলখানা ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। এর মধ্যে হত্যা মামলায় ৮৫০ জনের বিচার শেষ হয় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর। দেশের বিচারিক ইতিহাসে কোনো মামলায় বহু আসামি নিয়ে এটিই একমাত্র মামলা। রাজধানীর পুরাণ ঢাকায় আলীয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী আদালতে হত্যা মামলাটির বিচার সম্পন্ন হয়। বিচারিক আদালত ওই মামলায় ১৫২ জনের ফাঁসি, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করে। খালাস পান ২৭৮ জন। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর সেই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায়ও হয়ে যায় হাইকোর্টে। তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত একটি লার্জার বেঞ্চে হাইকোর্টে মামলায় ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর রায় হয়। উচ্চ আদালতের রায়ে ১৩৯ আসামির ফাঁসির রায় বহাল রাখা হয়। যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয় ১৮৫ জনকে। আরো ২২৮ জনকে দেয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা। খালাস পান ২৮৩ জন। হাইকোর্টের রায়ের আগে ১৫ জনসহ সব মিলিয়ে ৫৪ জন আসামি মারা গেছেন। হত্যা মামলায় হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে ২২৬ জন আসামি আপিল বিভাগে আবেদন করেছেন। অন্যদিকে, হাইকোর্টে ৮৩ জন আসামির খালাস এবং সাজা কমানোর রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এসব আবেদন এখন শুনানির অপেক্ষায়।
বিস্ফোরক আইনের মামলা : ওই ঘটনায় বিস্ফোরক আইনের মামলায় ৮৩৪ আসামির বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম চলছে। বিস্ফোরক আইনের মামলা পরিচালনার জন্য এরইমধ্যে ২০ জন স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর নিয়োগ দিয়েছে সরকার। নিয়োগপ্রাপ্তরা হলেন- অ্যাডভোকেট মো. বোরহান উদ্দিন, ফরহাদ নিয়ন, জাকির হোসেন ভূঁইয়া, মোসাম্মৎ রোভানা নাসরিন শেফালী, মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন, মো. মহিউদ্দিন চৌধুরী, মো. শফিউল বশর সজল, গোলাম মোক্তাদির উজ্জ্বল, হান্নান ভূঁইয়া, মো. আব্দুল লতিফ, মো. মেহেদী হাসান জুয়েল, মো. হেলাল উদ্দিন, গাজী মাশকুরুল আলম সৌরভ, মো. জিল্লুর রহমান, মাহফুজার রহমান ইলিয়াস, মো. মিজানুর রহমান চৌধুরী, মো. মেহেবুব হোসেন, মো. মিজানুর রহমান শিহাব, মো. খুরশিদ আলম ও আজগর হোছাইন।
তাদের নিয়োগাদেশে বলা হয়, ‘লালবাগ (ডিএমপি) থানার মামলা নম্বর ৬৫, তারিখ ২৮/০২/২০০৯ থেকে উদ্ধৃত বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) বিস্ফোরক দ্রব্য মামলা পরিচালনা করার জন্য ২০ জন আইনজীবীকে পুনরাদেশ না দেয়া পর্যন্ত নিয়োগ করা হলো।’ বিস্ফোরক আইনের মামলাটি বর্তমানে সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে। কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর অস্থায়ী আদালতে ঢাকার বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক মো. ইব্রাহিম মিয়ার আদালতে মামলার বিচার কার্যক্রম চলছে। হত্যা মামলাটিতে খালাস ও জামিনপ্রাপ্ত আসামিরা এ আদালত থেকে বিস্ফোরক আইনের মামলায় জামিন পেয়ে চলতি মাসে কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার দীর্ঘ প্রায় সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরশাসন ও ফ্যাসিবাদের পতন হয়। পতন হয় ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের। ওইদিন দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার তদন্ত পুনরায় শুরুর দাবি ওঠে। গত ১৯ ডিসেম্বর অভিযোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যান শহিদ পরিবারের সদস্যরা। ওই হত্যাকাণ্ড পুনঃতদন্তের জন্য গত ২৪ ডিসেম্বর আ ল ম ফজলুর রহমানকে প্রধান করে ৭ সদস্যের একটি কমিশন গঠন করে ৯০ দিনের সময় বেঁধে দিয়েছে সরকার।