স্কুল বা মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাবর্ষিকী, নানা আয়োজনে পালিত হবে। এর মধ্যে প্রধান আকর্ষণ উদ্বোধনী, আলোচনা সভা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
পবিত্র মাহে রমজান, সারা বছরে এক মাসব্যাপী এই আয়োজনেরও আনুষ্ঠানিকতা থাকে। রমজান পালনে দুটি আনুষ্ঠানিকতার নাম তারাবিহ আর সাহরি। রমজান ছাড়া বাকি এগারো মাসে তারাবিহ নামাজ নেই। শেষ রাতের সর্বজনীন সাহরিও রমজানের জন্য খাস।
তারাবিহর শাব্দিক অর্থ বিশ্রাম বিরতি। রমজানে রাতে ইশার নামাজের পর এই নামাজ পড়া হয় বিশ রাকাত। মাঝখানে বিশ্রামের ব্যবস্থা থাকে বিধায় এর নাম সালাতুত তারাবিহ, বিশ্রামসহ নামাজ। শুনেছি আরব মুল্লুকে চার রাকাত তারাবিহ পড়ার পর চা-পানি খাওয়ার রেওয়াজ আছে। আমাদের বাংলাদেশে এমন রেওয়াজের কথা শুনিনি। এখানে চার রাকাতের পরপর বসার সময়টা তুলনামূলক লম্বা। এ সময় একটি দোয়া পড়া হয়, তারপর মোনাজাত। কেউ কেউ চার রাকাত পরপর মোনাজাত বেদাত সন্দেহে আল্লাহর কাছে কিছু না চেয়েই উঠে দাঁড়ায় বাকি তারাবিহর জন্য। কিছুলোক তো বিশ রাকাত তারাবিহতেও বেদাত খুঁজে পান। তারা বলতে চান তারাবিহ ২০ রাকাত নয়, ৮ রাকাত। তাতেও সমস্যা ছিল না, কিন্তু যখন বিশ রাকাত তারাবিহ বেদাত, নাজায়েয বলেন, তখন বিপত্তি দেখা দেয়, আমাদের বিশ্বাস ও ধর্মীয় অনুভূতি আহত হয়, অনৈক্যের বীজ বপিত হয়।
বিতর্কে যাওয়া মানে ইবাদতের স্বাদ ও মজা হারিয়ে যাওয়া। শুরু থেকেই আসি। নবী করিম রমজান মাসে অতিরিক্ত নামাজ পড়ছেন দেখে সাহাবিগণ তার পেছনে সারিবদ্ধ হন। প্রতিদিন মুসল্লির সংখ্যা বাড়ছে দেখে তিনি আশঙ্কা করলেন, তারাবিহ নামাজ ফরজ হয়ে যেতে পারে। তখন উম্মতের জন্য কষ্টকর হবে। তাই তিনি তারাবিহর জন্য ঘর থেকে বের হননি।
প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা)-এর পর হযরত উমর (রা) এর খেলাফতকাল। তিনি লক্ষ্য করলেন রমজানে লোকেরা মসজিদে একাকী তারাবিহ পড়ছে। তিনি উবাই ইবনে কাবকে ইমাম নিযুক্ত করে সবাইকে তার পেছনে তারাবিহ পড়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। আরেকদিন তারাবিহর সুন্দর জামাত দেখে মন্তব্য করেন, ‘কী সুন্দর বেদাআত এটি।’ রাসুল (সা.) এর জামানায় এভাবে তারাবিহর জামাতের প্রচলন ছিল না, তাই বেদাত বলে আখ্যায়িত করলেন উমর (রা)। বুঝা গেল, সব বেদাত মন্দ নয়। রাসুলে পাকের হাদিসেও এর পক্ষে সমর্থন আছে। তিনি বেদাতে হাসানাহ সুন্দর বেদাত এবং বেদাতে সাইয়েআ বা মন্দ বেদাত নামে দুই প্রকার বেদাতের নির্দেশনা দিয়েছেন। হযরত উমর (রা.) এর এই সিদ্ধান্ত সাহাবায়ে কেরাম একবাক্যে মেনে নেন। সেই থেকে ২০ রাকাত তারাবিহতে এক মাসে একবার কোরআন খতমের রেওয়াজ চলে আসছে দীর্ঘ দেড় হাজার বছর ধরে।
কোরআন মজিদ ত্রিশ পারা। পারা শব্দটি ফারসি, অর্থ টুকরা, অংশ। আরবিতে বলা হয় জুয। বর্তমান ইরানে কোরআনের পারা বুঝানোর জন্য ফারসির পরিবর্তে আরবি প্রচলিত। বলা হয় জুয। অথচ ফারসির পরিভাষা পারা ব্যবহৃত হয় আমাদের দেশে। পুরো কোরআন ত্রিশ পারায় বিন্যস্ত। প্রত্যেক পারার পৃষ্ঠা সংখ্যা বিশ। প্রতিরাতে বিশ রাকাতে বিশ পৃষ্ঠা পড়লে একমাসে এক খতম কোরআন শেষ হয়। কোরআন খতমের এই রেওয়াজের উৎস কোথায় তা জানা যায় এক হাদিস থেকে। আল্লাহর কাছ থেকে নবী করিম (সা.) এর কাছে কোরআন নিয়ে আসেন হযরত জিব্রাঈল ফেরেশতা। জিব্রাঈল (আ.) রমজানে নবী করিম (সা.) এর কাছে আসতেন আর সে পর্যন্ত নাজিলকৃত কোরআন নবীজি (সা.) জিব্রাঈলকে পড়ে শোনাতেন। একে কোরআন নাজিলের উদযাপনি মনে করা হতে পারে।
কোরআন নাজিল হয়েছিল রমজান মাসে। কোন সময় তাও সুনির্দিষ্ট করে বলছে কোরআন। অর্থাৎ কদরের রাতে। এখন কোরআন নাজিলের উদযাপনীটা কত সুন্দরভাবে অনুষ্ঠিত হয় চিন্তা করুন। নবীজি জিব্রাইলের কাছে কোরআন শুনিয়ে সে আনুষ্ঠানিকতা পালন করেন। যে বছর তিনি ইহজগত ত্যাগ করবেন সে বছর রমজানে দুইবার তেলাওয়াত করে শোনান পুরো কোরআন। উমর (রা.) এর জমানায় তারাবিহর জামাত চালু হওয়ার পর থেকে নামাজে এক খতম কোরআন তেলাওয়াতের আয়োজন চলে আসছে মুসলিম জাহানে। এই উদযাপন কীভাবে সুবিন্যস্ত হয় তারও বিবরণ আছে ঐতিহাসিক বাস্তবতায়।
কোরআন মজিদে ৪৫০টি রুকু আছে। তারাবিহ নামাজের এক রাকাতে যেটুকু তেলাওয়াতের পর রুকুতে যায়, রাকাত শেষ করে সেটুকুতে চিহ্ণ আছে কোরআন মজিদের পাতায়, টীকায়। এভাবে বিশ রাকাতে যদি বিশ রুকু করে পড়া হয়, তাহলে সাতাশ দিনে ৫৪০ রুকু অর্থাৎ সাতাশে রমজান এক খতম কোরআন পড়া শেষ হয়ে যায়। কোরআন মজিদ লেখার পৃষ্ঠা ও রুকুর সংখ্যা প্রমাণ করে ঐতিহ্যগতভাবে তারাবিহ বিশ রাকাত। প্রতিদিন বিশ রাকাতের কম পড়া হলে পুরো রমজানে এক খতম কোরআন শেষ করা অসম্ভব কিংবা মুসল্লিদের জন্য অনেক কষ্টকর হবে।
যারা বিশ রাকাত তারাবিহ পড়বেন তারা প্রফুল্ল মনে ভাবতে পারেন, আল্লাহর রাসুলের সুন্নাত, সাহাবায়ে কেরামের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত , গোটা উম্মাহর ঐতিহ্য ও আচরিত নিয়মের উপর আমল করছেন। আলহামদু লিল্লাহ, আল্লাহ পাকে উম্মতকে সব বিচ্যুতি ও অশুভ প্রচারণা থেকে হেফাযত করুন।