ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ইসরায়েলি হুমকি উড়িয়ে দিল হামাস-হুথি

যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় পর্যায় শুরু না করলে মুক্তি পাবেন না ইসরায়েলিরা
ইসরায়েলি হুমকি উড়িয়ে দিল হামাস-হুথি

গাজা উপত্যকায় আবার আগ্রাসন শুরু করার ইসরায়েলি হুমকির তীব্র নিন্দা জানিয়ে হামাস বলেছে, গাজা থেকে অবশিষ্ট ইসরায়েলি পণবন্দিদের উদ্ধার করার একমাত্র উপায় যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করা। হামাসের সিনিয়র নেতা ওসামা হামদান এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে গত সোমবার বলেছেন, অবশিষ্ট পণবন্দিদের মুক্ত করে নিতে চাইলে তেলআবিবকে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় পর্যায় বাস্তবায়নের ব্যাপারে আলোচনায় বসতে হবে এবং যুদ্ধবিরতির সব বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে হবে। হামদান আরও বলেন, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ভণ্ডুল করে সবকিছুকে আবার আগের অবস্থায় নিয়ে যেতে চায়। এজন্য তারা দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রবেশ না করে ‘প্রথম পর্যায়ের মেয়াদ বৃদ্ধি’ অথবা ‘অন্তর্বর্তী পর্যায়’ নামক একটি বিকল্প ধাপ সৃষ্টি করতে চায়। এসব করে কোনো লাভ হবে না বলে তিনি দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। লেবানন প্রবাসী হামাসের এই সিনিয়র নেতা বলেন, যুদ্ধবিরতি চুক্তির অচলাবস্থার সব দায় ইহুদিবাদী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে নিতে হবে। তিনি যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও গাজায় আবার আগ্রাসন শুরু করতে চান। গাজায় গত ১৯ জানুয়ারি শুরু হওয়া ৪২ দিনব্যাপী যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্যায় ১ মার্চ শেষ হয়েছে। কিন্তু তিন পর্যায়ে বাস্তবায়নযোগ্য যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় পর্যায় ইসরায়েলের গড়িমসির কারণে এখনও শুরু করা সম্ভব হয়নি। এরইমধ্যে ইসরায়েল গাজা অভিমুখী সকল ত্রাণবাহী ট্রাক আটকে দিয়েছে। মিসরের রাফাহ ক্রসিংয়ে ত্রাণবাহী শত শত ট্রাক আটকা পড়েছে। এছাড়া, ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলো মাঝেমধ্যেই গাজার বিভিন্ন স্থানে বোমাবর্ষণ করে যাচ্ছে।

এদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে হামাসের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি হুমকি দিয়ে বলেছেন, হামাস অবশিষ্ট ইসরায়েলি পণবন্দিদের মুক্তি না দিলে ‘অতিরিক্ত ব্যবস্থা’ নেবে তেলআবিব। সোমবার প্রকাশিত এক ভিডিও বার্তায় নেতানিয়াহু গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার দাবিকে ‘সম্পূর্ণ অগ্রণযোগ্য’ বলে উল্লেখ করেন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী দাবি করেন, মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক মার্কিন প্রতিনিধি স্টিভ উইটকফ গাজা পরিস্থিতি নিয়ে যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা তেলআবিব মেনে নিয়েছে।

ওই প্রস্তাবে গাজায় আটক সব বন্দির মুক্তির বিনিময়ে ৫০ দিনের যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। তবে হামাস ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে, কারণ, তিন ধাপে বাস্তবায়নযোগ্য যুদ্ধবিরতির মূল পরিকল্পনায় এমন কোনো কথা ছিল না। মূল পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল, তিন ধাপেই অল্প অল্প করে পণবন্দি মুক্তি পাবে এবং ইসরায়েল ধাপে ধাপে গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেবে। তৃতীয় পর্যায় বাস্তবায়িত হলে গাজা যুদ্ধ স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাবে।

এই উত্তেজনার মধ্যে ইসরায়েলের হাইফা শহরের একটি পরিবহন স্টেশনে সোমবার ছুরিকাঘাতে এক ইসরায়েলি নিহত ও কয়েকজন আহত হয়েছেন। এছাড়া হামলাকারীও নিহত হয়েছেন জানিয়ে ইসরায়েলি পুলিশ এ ঘটনাকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ বলে চিহ্নিত করেছে। হামাস এবং ইসলামিক জিহাদ আন্দোলন এই হামলাকে ‘বীরত্বপূর্ণ অভিযান’ হিসেবে অভিহিত করে বলেছে, গাজা, পশ্চিমতীর ও আল-কুদসে আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি বাহিনীর চলমান ‘অপরাধের’ বিরুদ্ধে একটি সাধারণ প্রতিক্রিয়া। হামাস বলেছে, ফিলিস্তিন এবং এর পবিত্র স্থানগুলো মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত, ফিলিস্তিন থেকে দখলদারদের বিতাড়িত করে আল-কুদসকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ অব্যাহত থাকবে। ইসরায়েলি পুলিশ এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘একজন সন্ত্রাসী একটি বাস থেকে নেমে একাধিক নাগরিককে ছুরিকাঘাত করে এবং পরে নিরাপত্তাকর্মী ও একজন সাধারণ নাগরিক তাকে ঘটনাস্থলেই হত্যা করে। এতে বলা হয়, হামলাকারী ইসরায়েলের আরব ভাষাভাষী সংখ্যালঘু দ্রুজ সম্প্রদায়ের সদস্য, যিনি শফারাম শহরের বাসিন্দা এবং কয়েক মাস বিদেশে থাকার পর গত সপ্তাহে ইসরায়েলে ফিরে আসেন। হামলাটি হাইফা শহরের একটি বাস ও ট্রেন স্টেশনে ঘটে, যা উত্তর ইসরায়েলের একটি বড় উপকূলীয় শহর এবং ইহুদি ও আরব জনগণের মিশ্র আবাসস্থল। ১৯ জানুয়ারি গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর ইসরায়েলে প্রথম প্রাণঘাতী হামলা এটি। দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি আলোচনায় স্থবিরতার মধ্যে এই ঘটনা ঘটল। ইসরায়েলের জরুরি সেবা সংস্থা ম্যাগেন ডেভিড অ্যাডম জানিয়েছে, ৭০ বছর বয়সি এক পুরুষকে মৃত ঘোষণা করা হয়েছে এবং চারজন আহত ব্যক্তির চিকিৎসা চলছে। ত্রিশোর্ধ্ব এক পুরুষ ও নারী এবং ১৫ বছর বয়সি এক ছেলের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

গাজা উপত্যকায় আবার মার্কিন-সমর্থিত ইসরায়েলি সামরিক আগ্রাসনের ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে ইয়েমেনের হুথি আনসার-আল্লাহ আন্দোলন। সংগঠনটি বলেছে, পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থগুলোতে আঘাত হানার জন্য ইয়েমেন সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। আনসার-আল্লাহর পলিটব্যুরো নেতা হাজেম আল-আসাদ সোমবার এক বক্তৃতায় বলেন, গাজায় আবার আগাসন শুরু হলে মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন টার্গেটগুলো লক্ষ্য করে ব্যাপকভিত্তিক যুদ্ধ শুরু করা হবে। তিনি গাজা উপত্যকা অথবা ইয়েমেনকে লক্ষ্য করে ইসরায়েলের যে কোনো হামলায় সহযোগিতা বা তেলআবিবকে রক্ষা করার যে কোনো প্রচেষ্টার ব্যাপারে মার্কিন সরকারকে সতর্ক করে দেন। একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন হুথি আনসার-আল্লাহ আন্দোলনের অপর নেতা নাসের আল-দিন আমির।

তিনি বলেছেন, ‘আমাদের চোখগুলো গাজা উপত্যকার দিকে এবং আমাদের আঙুলগুলো বন্দুকের ট্রিগারে রয়েছে।’ ইয়েমেনের সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনসহ সকল সামরিক ইউনিট সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এর আগের পরীক্ষায় আমরা নিশ্চিতভাবে নিজেদের প্রমাণ করেছি।’ ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েল গাজায় আগ্রাসন শুরু করার পরপরই লোহিত সাগরে ইসরায়েল অভিমুখী বাণিজ্যিক জাহাজগুলোতে হামলা চালিয়ে গাজাযুদ্ধে ঘোষণা দিয়ে অংশগ্রহণ করে ইয়েমেন। পরে ওই হামলা শুধু ইসরায়েলি জাহাজে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং ইসরায়েলের মূল ভূখণ্ড লক্ষ্য করে অসংখ্য ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছেন তারা। এমনকি, লোহিত সাগরে মোতায়েন মার্কিন বিমানবাহী রণতরীতে পর্যন্ত হামলা চালিয়েছে ইয়েমেন। তবে গত ১৯ জানুয়ারি গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সব ধরনের হামলা বন্ধ রেখেছে সানা।

গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলি বাহিনী ৯০০ বারেরও বেশি যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে। এসব হামলায় শত শত ফিলিস্তিনি নিহত ও আহত হয়েছেন। গাজার মিডিয়া অফিসের মহাপরিচালক ইসমাইল আল-থাওয়াবতা বলেন, ‘এই লঙ্ঘনগুলোর মধ্যে রয়েছে বিমানহামলা, গোলাবর্ষণ, ব্যাপক ড্রোন তৎপরতা, মানবিক সহায়তা প্রবেশে বাধা, সাধারণ নাগরিকদের ওপর গুলি চালানো, ঘরবাড়ি ধ্বংস এবং গাড়ি লক্ষ্য করে হামলা।’ তিনি আরও জানান, ইসরায়েল গাজায় জ্বালানি প্রবেশে বাধা দিয়েছে, উদ্ধারকাজের জন্য প্রয়োজনীয় গাড়ি ও ভারী যন্ত্রপাতি আটকে দিয়েছে এবং ২ লাখ ৬০ হাজার তাঁবু ও অস্থায়ী আবাসন সরঞ্জাম প্রবেশেও বাধা দিয়েছে। আল-থাওয়াবতা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও মধ্যস্থতাকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যেন তারা ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় এবং যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত বাস্তবায়নে চাপ প্রয়োগ করে।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলি হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১১৬ জনে পৌঁছেছে এবং অন্তত ৪৯০ জন আহত হয়েছেন। এদিকে, ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশে বাধা দেওয়ার মাধ্যমে ইসরায়েল ভয়াবহ মানবিক সংকট সৃষ্টি করছে। গাজায় ত্রাণ প্রবেশে ইসরায়েলি নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে দেশটির ভেতরেও সমালোচনা বাড়ছে। বন্দিদের পরিবারের পাশাপাশি রাজনীতিবিদরাও এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। বিরোধীদল ডেমোক্র্যাটস পার্টির নেতা ইয়াইর গোলান বলেন, ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থি সরকার যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ ও বন্দিবিনিময় আলোচনা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে, যা কাম্য হতে পারে না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত