ঢাকা শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের অবহেলিত সুন্নাত

কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের অবহেলিত সুন্নাত

হিজরত ইসলামের ইতিহাসের যুগান্তকারী ঘটনা। চল্লিশ বছর বয়সে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুয়াত লাভ করেন। এর তের বছর পর তিনি জন্মভূমি মক্কা ত্যাগ করে স্থায়ীভাবে মদীনায় চলে যান। এর নাম হিজরত। মক্কার কুরাইশ কাফেররা তাকে হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করলে আল্লাহর নির্দেশে তিনি হিজরত করেন। মক্কা ত্যাগের সময় কুরাইশ মুশরিকদের চোখ ফাঁকি দেয়ার জন্য তিন দিন একটি গুহায় আত্মগোপন করেছিলেন। গুহাটি ছিল ছৌর পর্বতে।

বিচক্ষণ কুরাইশরা নবীজিকে ধরার জন্য ব্যাপক তল্লাশি চালায়। এমনকি সৌর পর্বতের গুহার মুখ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তারা দেখে গুহার মুখে মাকড়শা জাল বুনেছে। পাশে কবুতর বাসা বেঁধেছে। তারা মনে মনে বলে, গুহার ভেতরে মানুষ ঢুকলে মাকড়শার জাল থাকত না। এতো নিকটে কবুতর বাসা বুনত না। তারা ফিরে যায়। এসবই ছিল আল্লাহর কুদরত, নবীজির হেফাজতের জন্য অলৌকিক আয়োজন।

আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করলে আল্লাহই সব ব্যবস্থা করেন, সবকিছুর হেফাজত করেন। ইতিহাসের এই পাঠ আমরা পড়েছি, শুনে আসছি জীবনভর। কিন্তু আল্লাহর নবী মুশরিকদের চক্রান্তজাল ব্যর্থ করে দেয়া, নিজের নিরাপত্তা ও হিজরত নির্বিঘ্ন হওয়ার জন্য যে পরিকল্পনা করেছিলেন, তার আলোচনা খুব একটা হয় না। নবীজি শিক্ষা দিয়েছেন, মুমিনের সব কাজ হতে হবে বস্তুগত সহায় সামগ্রি কাজে লাগিয়ে, দূরদর্শী চিন্তা ও প্লান-পরিকল্পনা নিয়ে। এসব ব্যবস্থা গ্রহণের পরই আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করতে হবে। আগে সিদ্ধান্ত, তারপর তাওয়াক্কুল। আল্লাহর উপর ভরসার নামে হাতপা ঘুটিয়ে বসে থাকার নাম তাওয়াক্কুল নয়।

কুরাইশ কাফেরদের অত্যাচার নিপীড়ন মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে নবীজি অপেক্ষায় থাকেন, যে কোনো সময় হিজরতের নির্দেশ আসতে পারে। প্রায় প্রতিদিন আবু বকর (রা) এর ঘরে যান, উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। বন্ধু আবু বকরও প্রস্তুতি নেন, অপেক্ষায় থাকেন।

নির্দিষ্ট দিন ভর দুপুরে নবীজি আবু বকর (রা) এর বাড়িতে আসেন। কামরা থেকে অন্যদের বের করে দিয়ে হিজরতের আদেশের কথা তাকে জানান। কুরাইশদের নজরদারি এড়ানোর জন্য ঘরের পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে উভয়ে আশ্রয় নেন ছৌর পর্বতের গুহায়।

আবু বকর (রা) আগে থেকে দুটি উট প্রস্তুত রাখেন বাহন হিসেবে। আবদুল্লাহ ইবনে উরাইকিত নামে একজনকে নির্দিষ্ট মজুরীতে নিয়োগ দেন গাইড হিসেবে। সে ছিল মুশরিক, কুরাইশদের ধর্মমতে বিশ্বাসী। তবুও তাকে পথের দিশারী হিসেবে নিয়োগ দিলেন। বলতে পারতেন, আমরা আল্লাহর পথে বের হয়েছি, আল্লাহই পথ দেখাবেন। পথ দেখানোর জন্য কোনো মুশরিককে নিযুক্ত করার দরকার কী। ফেরেশতা জিব্রাঈলই তো আমার গাইড হতে পারে। কিন্তু তিনি সে কাজ করেননি। পক্ষান্তরে যে কয়দিন গুহায় থাকতে হবে তার পরিকল্পনা করলেন। ছেলে আবদুল্লাহ বিন আবু বকরকে নিযুক্ত করেন গোয়েন্দা রিপোর্ট সংগ্রহের জন্য।

আবদুল্লাহ বিন আবু বকর সারা দিনমান মক্কার মুশরিকদের মাঝে বিচরণ করেন। সন্ধ্যায় গুহায় গিয়ে সংবাদগুলো জানিয়ে দেন নবীজি ও আবু বকরের কাছে। আবু বকর (রা) এর গোলাম আমের ইবনে ফুহাইরা দিনের বেলা মেষ চরায় মাঠে। সন্ধ্যা নামলে ভেড়াগুলো গুহার কাছে নিয়ে যায়। আবু বকর রাতের খাবারের দুধ সংগ্রহ করেন, দুম্বা জবাই করে আহারের ব্যবস্থা করেন। ফেরার সময় তার প্রতি নির্দেশ, আবদুল্লাহ ইবনে আবি বকর যে পথ দিয়ে ফিরে গেছে সেই পথের উপর দিয়ে ভেড়ার পাল নিয়ে যাবে, যাতে আবদুল্লাহর পায়ের ছাপ মুছে যায়, কাফেররা গুহায় কেউ লুকিয়ে আছে, এমন কোনো আলামত দেখতে না পায়। ঘরে দুই কন্যা আয়েশা ও আসমা বাকি কাজ যোগান দিত হিজরতের সফর সহজ হওয়ার জন্য। মুশরিক গাইড মক্কায় ফিরে আসার পর আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকর জানান দিলেন, নবীজি ও আবু বকর মদীনায় গিয়ে পৌঁছেছেন।

হিজরতের এই বর্ণনা ইতিহাসের সব আকর গ্রন্থে বর্ণিত। এর মধ্যে উম্মাহর জন্য যে নির্দেশনা আছে, আগে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তারপরে তাওয়াক্কুল। ‘ফাইযা আযামতা ফাতাওয়াক্কাল আলাল্লাহ’ আপনি যখন সিদ্ধান্ত নিবেন তারপর আল্লাহর উপর ভরসা করুন।’

মুমিন জীবনে নিয়ত, সংকল্প ও পরিকল্পনার গুরুত্ব অপরিসীম। তাতে কাজ না করেও সওয়াব বরাদ্দ আছে। পবিত্র মাহে রমজানের এবং রমজান-পরবর্তী সময়ের জন্য এ ধরনের সৎ চিন্তা ও সৎ পরিকল্পনার সওয়াবের মাত্রা বুঝা যাবে নি¤েœাক্ত হাদিসের মাধ্যমে।

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা যখন কোনো সৎকাজ করার ইচ্ছা করে আমি তার জন্য একটি সওয়াব লিখে রাখি, যতক্ষণ সে কাজটি না করে। যখন সে কাজটি করে তখন আমি তার দশগুণ সওয়াব লিখে দেই। আর যখন সে কোনো পাপ কাজ করার ইচ্ছা করে আমি তার দিকে ক্ষমার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি যতক্ষণ সে কাজটি না করে। অতপর যখন সে কাজটি করে তখন আমি পাপ কাজটির সমান একটি গুনাহ লিখি। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ফেরেশতারা জানতে চায়, হে আমাদের রব! আপনার এ বান্দা পাপকাজ করার ইচ্ছা করেছে, -যদিও আল্লাহ সে সম্পর্কে বেশি জানেন- আল্লাহ তখন বলেন, তাকে পর্যবেক্ষণ করতে থাক, যদি সে কাজটি করে তার জন্য সমান পাপ লিখ, যদি সে কাজটি না করে তার জন্য তা সওয়াব হিসেবে লিখ। কারণ আমার জন্যই সে তা ত্যাগ করেছে। (মুসলিম)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত