প্রত্যেক বছরের মতো এবারও পবিত্র রমজান মাস ঘিরে অধিক মুনাফা লাভের আশায় বড় বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সিন্ডিকেট করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছিলেন, কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের কঠোর নজরদারিতে সিন্ডিকেট কারবারিদের সেই পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। পাইকারি বাজার দৈনিক নজরদারি করা হচ্ছে। এতে খুচরা বাজারে নিত্যপণ্যের দাম কমেছে। যার ফলে স্বস্তিতে আছেন ক্রেতারা।
সরেজমিন কয়েকদিন রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, আদাবর, যাত্রাবাড়ী এবং শনিরআখড়াসহ বেশকিছু খুচরা বাজার ঘুরে ক্রেতাদের মাঝে স্বস্তি দেখা গেছে। ক্রেতারা বলছেন, রজমান এলেই পাইকারি বাজারে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায়, যা খুচরা বাজারে প্রভাব পড়ে। এবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নজরদারিতে বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম কমেছে। আলু, পেঁয়াজ, ডাল, লবণ, চিনি, মুরগি ও মাংসের দাম বাড়েনি। সবজির দামও নাগালের ভেতর। তবে সয়াবিন তেলের দাম কমলে মানুষের বহুলাংশে দুশ্চিন্তা দূর হবে। আদাবর কাঁচাবাজারে বাজার করতে আসেন আহসান হাবিব নামে এক ক্রেতা। তিনি বলেন, রমজানকে ঘিরে সিন্ডিকেট করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর নজির হরহামেশা দেখা ও শোনা গেলেও এবারের রমজানে সেটি নেই, সেজন্য নিত্যপণ্যের দাম ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে আছে।
সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কঠোর বাজার তদারকিতে চিনি, ডাল, খেজুর, পেঁয়াজ, শসা, আলু, টমেটো, ডিম, রসুন, কাঁচা মরিচ, শুকনো মরিচ, আদা ও ইসবগুলসহ বেশিরভাগ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ২০২৪ সালের রমজানের তুলনায় কম দামে বিক্রি হচ্ছে। রমজান মাসে পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বেশকিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করেছে। তালিকাভুক্ত পণ্যের মধ্যে আছে- সরিষার তেল, ময়দা, সুজি, মসুর ডাল, এলপিজি, বিস্কুট, লবণ ও গরম মসলা। এসব পণ্য উৎপাদন পর্যায়ে এবং কিছু ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক পর্যায়ে ভ্যাট রেয়াত দেয়া হয়েছে। রাজস্ব বোর্ড খেজুর, চাল, ডাল, চিনি ও তেলের মতো প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি শুল্ক শূন্যে নামিয়ে এনেছে। তবে বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট রয়েছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সয়াবিন তেল বোতলের মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত মুদি দোকান ও মুরগির মার্কেট থেকে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) তথ্য সংগ্রহ করেছে। সেই পরিসংখ্যান নিত্যপণ্যের দাম বহুলাংশ কমেছে।
পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, গত পাঁচ মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বহুলাংশে কমেছে। গত বছরের নভেম্বরের তুলনায় মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকার চাল (নাজিরশাইল, মিনিকেট, বিআর২৮, গুটি ও পাইজাম) এবং গমের (লুজ আটা, প্যাকেটজাত আটা, লুজ ময়দা ও প্যাকেটজাত ময়দা) দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। যদিও গত বছরের রমজানের তুলনায় চালের দাম কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও গমের দাম (আটা ও ময়দা লুজ প্যাকেটজাত) কমেছে।
রমজানকে কেন্দ্র করে অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ প্রশংসা করে রায়েরবাগের বাসিন্দা মহসিন আলী বলেন, কৃষিপণ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকায় দাম সন্তোষজনক। গত কয়েক বছরের তুলনায় এই রমজানে সবজির দাম কম। মাছ, মাংস ও মুরগির দাম স্থিতিশীল রয়েছে। শহরের বিভিন্ন বাজার পরিদর্শনকালে দেখা গেছে, ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৮০-১৯০ টাকা, সোনালী ৩০০-৩১০ টাকা ও দেশি মুরগি ৫৫০-৫৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে- যা গত বছরের তুলনায় যথাক্রমে ১০-৩০ টাকা কম। গত বছর চিনির কেজি ১৪৫-১৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, এবার সেই চিনির কেজি ১২০-১২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গরুর মাংসের কেজি ছিল ৭৮০ টাকা, এবার ৭৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খাসি (মাংস) প্রতি কেজি প্রায় ১১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে- যা আগের বছরের তুলনায় ৩০-৫০ টাকা কম। অন্যদিকে, সাধারণ খেজুরের দাম ২২০-২৫০ টাকা থেকে কমে ১৮০-২০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
অন্যদিকে মাঝারি মানের ও প্রিমিয়াম মানের খেজুর যথাক্রমে ৪৫০-৮০০ টাকা ও ১,০০০-১,৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে- যা গত বছরের তুলনায় ৩০-২০০ টাকা কম। স্থানীয় পেঁয়াজ এখন ৪০-৪৫ টাকায় প্রতি কেজি পাওয়া যাচ্ছে- যা গত বছরের ১০০-১২০ টাকার তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। আলু ২০-৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে- যা গত বছর ছিল ২৫-৩৫ টাকা। গত বছর ডিমের ডজন ১৪০ টাকা ছিল যা এবার ১২০-১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও শীতকালীন সবজির দাম গত রমজানের তুলনায় ৫-২০ টাকা কেজি কমেছে।
মোহাম্মদপুর কাঁচাবাজারে একযুগ ধরে মুরগি বিক্রি করে আসছেন আকরাম হোসেন। তিনি বলেন, প্রত্যেক বছরে রমজানের আগে সিন্ডিকেট করে পাইকারি বাজারে মুরগির দাম বাড়ানো হয়, কিন্তু এবার সেই সিন্ডিকেট নেই। পাইকারি মুরগি কিনে স্বল্প লাভে খুচরা বাজারে মুরগি বিক্রি করছি। এখানে খুব বেশি লাভ করার সুযোগ নেই।
মূলত, বড় সিন্ডিকেট মুরগির ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। যারা দিন বয়সি বাচ্চা উৎপাদন করে ও মুরগির খাবার দেয়, তারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। সরকার যদি সিন্ডিকেটগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাহলে মুরগির দাম আরও কমার সুযোগ রয়েছে। লেবুর সঙ্গে শসা, বেগুনের দামও বেড়েছিল পাল্লা দিয়ে। গতকাল কেজিপ্রতি ১০ টাকা কমে বিক্রি হয়েছে সেই শসা। আগে দাম ছিল ৫০-৬০ টাকা। অন্যদিকে লম্বা বেগুন ৬০-৮০ টাকা থেকে কমে বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকা দরে।
স্থানীয় রুই (১.৫ থেকে ২ কেজি জীবিত) ৩০০-৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে আমদানি করা রুই (২ থেকে ৩ কেজি) ৩০০-৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফকিরাপুল বাজারের মাছ ব্যবসায়ী রফিক মিয়া বলেন, বাজারে মাছের সরবরাহ স্বাভাবিক। তবে রমজান আসার সাথে সাথে মাছের চাহিদা বেড়েছে। তালতলা বাজারে সেনবাগ স্টোরের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ তারেক বলেন, সরবরাহ প্রচুর হওয়ায় বেশিরভাগ মুদি পণ্যের দাম সন্তোষজনক। মতিঝিল এলাকার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, এ বছর পেঁয়াজ, আলু, টমেটো, কাঁচা মরিচ ও ডিমের দাম ন্যায্য ও যুক্তিসঙ্গত। সরকারের কঠোর নজরদারি পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল করতে ভূমিকা রেখেছে বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।
আমদানিকারকরা বলছেন, রোজার মাস ছাড়া অন্য মাসগুলোতে দেশে প্রতি মাসে গড়ে ১০ হাজার টন ছোলার চাহিদা থাকে। সেই হিসাবে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি, এই তিন মাসের ৩০ হাজার টন চাহিদা বাদ দিলেও আমদানি করা আরও ১ লাখ ৩০ হাজার টন ছোলার সরবরাহের জন্য অবশিষ্ট থাকবে। ছোলার দাম আগের তুলনায় কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা করে কমেছে। গত সপ্তাহে ৯৮ থেকে ৯৯ টাকায় বিক্রি হলেও গতকাল বৃহস্পতিবার ৯৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ গত বছরের রমজানে দেশের বাজারে প্রতি কেজি ছোলা ১০৭ থেকে ১১৫ টাকা হয়েছে।