কাপড়-চোপড় অপরিষ্কার হলো। প্রতিকারের জন্য কী ব্যবস্থা নিতে হবে। সবাই জানি, পানি আর সাবান ব্যবহার করতে হবে। শরীর, বাসন, পেয়ালা- সবকিছুর ময়লা ধোয়ার মাধ্যম পানি আর সাবান।
মানুষের অভ্যন্তরে যে অন্তর আছে, নির্মল আয়নার সাথে তার তুলনা করা যায়। যদি কলব বা অন্তরের আয়না অপরিচ্ছন্ন হয় তা পরিষ্কার করার জন্যও সাবান পানি আছে। সাবান হল তওবা। জীবনযাত্রায় কোনো ভুল, অপরাধ বা পাপ হয়ে থাকলে তার জন্য মনে মনে লজ্জিত হওয়া, কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে মাফ চাওয়া এবং ভাবিষ্যতে কাজটি কখনো করব না মর্মে সংকল্প করার নাম তওবা। এই তওবার সাথে যদি চোখের পানি মিশ্রিত করা যায়, তাহলে আল্লাহর হক নষ্ট করা জনিত গোনাহ মাফ হয়ে যাবে। তবে বান্দার বা অন্য মানুষের হক নষ্ট করা, তার অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করা, জুলুম, আত্মসাৎ, দুর্নীতি প্রভৃতির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে, নচেত আল্লাহতায়ালা ক্ষমা করবেন না। এটিই আল্লাহর শাশ্বত বিধান।
এই ভূমিকার পর একটি প্রশ্ন সামনে আনতে চাই, তাহল, ধন-সম্পদের ভেতর যদি কোনো আবর্জনা ঢুকে থাকে তা পরিষ্কার করার উপায় কী। কালো টাকা সাদা করা বলে একটি কথা আছে। নির্দিষ্ট পরিমাণ টেক্স দিলে অবৈধ টাকা বৈধ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ইসলামের বিধান হলো, উপার্জিত টাকাগুলো বৈধপন্থায় উপার্জিত হালাল কিনা প্রথমে দেখতে হবে। হালাল হলেও বণ্টন ব্যবস্থার অসঙ্গতির কারণে এদিক-ওদিক থেকে আবর্জনা জমতে পারে সঞ্চিত সম্পদের গায়ে। কীভাবে বুঝব এই অসংগতি ও শোষণজনিত আবর্জনা। যদি সম্পদ এমনভাবে বৃদ্ধি পায়, যা জাকাতের নেসাব পরিমান এবং দীর্ঘ এক বছর নিজের কাছে জমা থাকে তাহলে বুঝতে হবে, ধন-সম্পদে আবর্জনা এসে অন্যের হক ও পাওনা জমা হয়েছে। এই আবর্জনা পরিষ্কার করার উপায় কী?
এই উপায় বাতলানো হয়েছে ইসলামে, কোরআনে। সেই উপায় ও প্রক্রিয়া হল জাকাত প্রদান। জাকাত শব্দের অর্থ পবিত্রতা। অতিরিক্ত সম্পদের শরীয়ত নির্ধারিত একটি অংশ সমাজের অসহায় জীবনযুদ্ধে পিছিয়ে পড়া লোকদের সহায়তার উদ্দেশ্যে প্রদান করার নাম জাকাত।
সমাজে কোনো ব্যক্তি যখন অর্থশালী হয়, তার প্রতি মানুষের মনে ঈর্ষা ও হিংসা জন্মে, এটাই স্বাভাবিক। যদি এমন হয় যে, ধনী লোকটির কারণে কোনো ব্যক্তি বা শ্রেণি বঞ্চিত হয়েছে, কিংবা সমাজ তার দ্বারা উপকৃত হচ্ছে না, তাহলে তার প্রতি মানুষের ঈর্ষা হিংসা ও বিদ্বেষে রূপান্তরিত হয়। এখান থেকেই জন্ম নেয় শ্রেণিবৈষম্য, ধনীর প্রতি অসহায় গরিব মানুষের শত্রুতা। সমাজতন্ত্রের জন্মের পেছনে ছিল সমাজের এই বাস্তবচিত্র।
ধনী, অর্থশালী বা পুঁজিপতি লোকটি যদি বছর শেষে হিসাব করে জাকাত দেয়, যেকোনো দুর্যোগ দুর্দিনে সমাজের সেবায় এগিয়ে আসে, তখন তা সমাজের বঞ্চিত শ্রেণির মন থেকে ধনীর প্রতি হিংসা-ক্ষোভ ও শত্রুতা দূর করে দেয়, সাধারণ মানুষের মন ও সামাজিক সম্পর্কে পবিত্রতার বাতাবরণ তৈরি করে। ধনীর জন্য সত্যিকারের শ্রদ্ধার আসন মানুষের মনের সিংহাসনে তৈরি হয়। সম্পদের আবর্জনা পরিষ্কারকারী হিসেবে জাকাতের এই ভূমিকা নিয়ে আশাকরি সমাজ বিজ্ঞানীরা চিন্তা করবেন।
জাকাত দ্বারা সমাজের উপকার হয়, অর্থনীতির চাকা দ্রুত ঘূর্ণীয়মান হয়, গরিব-দুঃখী মানুষের উপকার হয়, তা আমরা সহজে বুঝি। জাকাত দ্বারা ধন সম্পদের ময়লা-আবর্জনা কীভাবে দূর হয় তাও আমরা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু জাকাত দ্বারা যে স্বয়ং জাকাতদাতার উপকার হয়, তা খুব কম লোকই চিন্তা করি। জাকাত দান মানে তো সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে নিজের সম্পদ অন্যকে দিয়ে দেওয়া, বৈষয়িক বিবেচনায় তার দ্বারা তো নিজেরই ক্ষতি, নিজের সম্পদ বেহাত হওয়া। গভীরভাবে চিন্তা করলে এখানেও পবিত্রতার অর্থে জাকাতের তাৎপর্য উদ্ভাসিত হয়। মানুষ মাত্রই মনের মধ্যে সম্পদের প্রতি আগ্রহ ও লোভ আছে। এই আগ্রহ না থাকলে মানুষ অর্থসম্পদ কামানোর জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা চালাতো না, জীবন ও জগত অচল হয়ে যেত। কিন্তু সম্পদের আগ্রহ যখন অতিরিক্ত লোভের পর্যায়ে পৌঁছে তখন নিজের ও সমাজের জন্য কী বিপদ ঢেকে আনে তা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে বলার দরকার হয় না। কাজেই সমাজকে অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন ধনীর মনোরোগের চিকিৎসা। ধনীর মনকে হিংসা, লোভ ও ‘আরো পাই আরো খাই’ মনোভাব থেকে মুক্ত করা। এই চিকিৎসার সবচে কার্যকর হাতিয়ার দান সদকা জাকাত প্রদান।
মানুষ যখন আল্লাহর হুকুম পালন করতে গিয়ে সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে অসহায় মানুষের জন্য নিজের কষ্টাজির্ ত অর্থ ব্যয় করে তখন মনের মধ্যে এক অনাবিল তৃপ্তি ও শান্তি অনুভব করে, যার সাথে পাঁচতারা হোটেলের দামি খাবারের তৃপ্তির তুলনা করা যাবে না। মন লোভ মোহ আগ্রাসী চিন্তা থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র হবে। বুঝা গেল, জাকাত দ্বারা শুধু সমাজের নয়, ব্যক্তির নিজেরও উপকার হয়। মনের জমিনে অনাবিল শান্তি, তৃপ্তি ও প্রফুল্লতার বিস্তার হয়। কোরআন মজিদের একটি আয়াত এখানে প্রণিধানযোগ্য।
‘তাদের সম্পদ হতে আপনি ‘সদকা’ গ্রহণ করবেন। এর দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র করবেন, তাদেরকে পরিশোধিত করবেন। আর তাদের জন্য দোয়া করবেন। আপনার দোয়া তাদের অন্তরে প্রশান্তিদায়ক। আল্লাহ আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। -(সূরা তাওবা, আয়াত-১০৩)