ঢাকা রোববার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ঈমান ও সৎকর্ম চর্চার মৌসুম

ঈমান ও সৎকর্ম চর্চার মৌসুম

আমাদের ষড়ঋতুর দেশে ধান-পাটের চাষাবাদ হয় বর্ষাকালে। একই সাথে মৎস্য প্রজননের ভরা মৌসুম বর্ষা। বর্ষাকালে এ দুয়ের ফলন প্রজনন এমন হয়, যা অন্য মৌসুমে আশা করা যায় না। গ্রীষ্মের তাপদাহের পর কৃষকের মনে কর্মময় সুখ ও আনন্দের ঝিলিক লাগে বর্ষায়। ঠিক একই ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়, শীতকালে শাকসবজি, ফলমূল রবিশস্যের জন্য। শীতের মৌসুম ছাড়া এসব রবিশস্যের ফলন অন্য সময়ে আশা করা যায় না। বর্ষায় ধান ও মাছের কোলাহল, শীতে রবিশস্যের ফুলেল বাহার আর গ্রীষ্মে আমলিচু কাঠালের উৎসবে আমরা প্রকৃতির নানারূপ মিতালি দেখতে পাই। এই মিতালির পেছনে সক্রিয় থাকে সূর্যের তাপ ও রাশিচক্রের কারুকাজ।

দৃশ্যমান ঋতুচক্রের মতো আরেকটি আধ্যাত্মিক ঋতুচক্র আছে, বিশ্বপরিক্রমায়। ঋতুচক্রের সম্পর্ক যেখানে সূর্যের সাথে সেখানে আধ্যাত্মিক ঋতুচক্রের সংযোগ থাকে চাঁদের পরিক্রমণের সাথে। চাঁদের পরিক্রমনে আল্লাহর রহমত, বরকত ও মহিমা প্রকাশের একটি মৌসুম পবিত্র রমজান মাস। রমজানের রহমত বরকত ও মাগফিরাত আমরা চোখে দেখি না। তবে অন্তরের চোখ দিয়ে দেখা যায়। যেমন সারাবছর ধর্মকর্মের প্রতি যারা উদাসীন থাকে তারাও মসজিদমুখি হয়। বর্ষায় খালবিল নদীনালায় মাছের উৎসবের মতো রমজানে মসজিদগুলো ভরে উঠে মুসল্লিদের প্রাণবন্ত উপস্থিতিতে। তারাবি, তাহাজ্জুদ ও সাহরির ধুমধামে রাতজাগার উৎসব চলে এক মাসব্যাপী। মাস শেষে আসে ঈদের অনাবিল আনন্দ। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, আরবি মাসগুলো যদি সূর্যকেন্দ্রিক গণনা হত, তাহলে রমজান, হজ ইত্যাদি ইবাদত ও উপলক্ষ শীত, বসন্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষায় ঘুরে ঘুরে আসত না, কমবেশি হত না। সৌরপঞ্জির মাসগুলো স্থির থাকায় সবকিছুর হিসাব মিলানো সহজ। কিন্তু চাঁদের পরিক্রমণের সাথে যুক্ত ইসলামী বর্ষপঞ্জি কেমন যেন এলোমেলো। এই প্রশ্নের জবাবে বলতে হয়, রোজা ও হজের মতো ইবাদতগুলোর দিনক্ষণ চাঁদের সাথে যুক্ত হওয়ায় ঘুরে ঘুরে সারা বছর ইবাদতের আনন্দ পাওয়া যায়। সূর্যের গতিপথ দেখে মাসের দিন তারিখ ঠিক করা সাধারণ মানুষের জন্য সহজ নয়, অথচ চাঁদের হ্রাসবৃদ্ধি দেখে তারিখ গণনা গ্রামের, পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের পক্ষেও সহজ। সবচে বড় কথা, বিশ্বপ্রকৃতিতে মৌলিক পরিবর্তনের বিরাট সংযোগ থাকে চাঁদের পরিক্রমণের সঙ্গে। মাতৃগর্ভে শুক্রবিন্দু, জমাট রক্ত, অস্থিমজ্জা প্রভৃতির বিবর্তন, পরিগঠন ও শিশুর জন্মগ্রহণের নিখর্ঁুত কাজটি সম্পন্ন হয় চাঁদের তিথি ও মাস গণনার হিসেব মোতাবেক। সমুদ্রের যে জোয়ার-ভাটার উপর গোটা বিশ্বের অস্তিত্বনির্ভর করে, সেই জোয়ার-ভাটা আসে চাঁদের আকর্ষণ বিকর্ষণ মেপে মেপে। কাজেই সৌরপঞ্জির চেয়ে চান্দ্রবর্ষপঞ্জি অনেক যৌক্তিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক। এই ভূমিকাটি সামনে রাখলে রমজানে আল্লাহর অফুরান রহমত, অগণন বরকত, নেয়ামত ও নাজাতের মহিমা অনুধাবন করা সহজ। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, কোরআন নাজিল হওয়ার কারণে রমজানের এত মহিমা। কোরআন মজিদের মর্যাদা ও মহিমা বুঝার, বুঝানোর জন্য এ কথা আমিও বলেছি, লিখেছি। কিন্তু তাফসিরে মাইবেদীর একটি ভাষ্য পড়ার পর আমার ধারণা পাল্টে গেছে। বলা হয়েছে, রমজান মাসের অনন্ত মহিমার কারণেই এ মাসে কোরআন নাজিল করা হয়েছে। কোরআন নাজিল হওয়ার কারণে রমজান মহিমান্বিত- এ কথার চেয়ে রমজানের নিজস্ব মহিমার কারণে এই মাসে কোরআন নাজিল হয়েছে কথাটি নিশ্চয়ই অনেক বেশি দামি। কোরআন মজিদে বলা হয়েছে, ‘রমজান সেই মাস, যে মাসে কোরআন নাজিল করা হয়েছে।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-১৮৫)।

মহিমান্বিত রজনী লাইলাতুল কদর আধ্যাত্মিক গুপ্তধন হিসেবে লুকিয়ে রাখা হয়েছে রমজান মাসের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোর কোনো একটিতে। শুধু কি কোরআন; অন্যান্য আসমানী কিতাবও নাজিল হয়েছে রমজানে। এক রেওয়ায়েত অনুযায়ী হযরত মূসার (আ.) উপর তাওরাত নাজিল হয় ৬ রমজান। ১২ রমজান ইঞ্জিল কিতাব নাজিল হয় ঈসার (আ.) উপর। রমজানের ১৮ তারিখ দাউদ (আ.)-এর প্রতি যবুর কিতাব নাজিল হয় । অপর এক রেওয়ায়াত অনুযায়ী ১লা রমজান সহিফা নাজিল হয় ইব্রাহীম (আ.)-এর প্রতি। আর ইদ্রিস (আ.) এর উপর সহিফা নাজিল হয় ৬ রমজান তারিখে।

বোঝা গেল, পবিত্র রমজান অফুরন্ত রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও নাজাতের মৌসুম। অদৃশ্য জগতের দয়া ও নেয়ামতের মোসলধারে বৃষ্টি নামে এই মাসে। ফলে এই মাসে ইবাদত বন্দেগী, সৎকাজের, দান-দক্ষিণার ফলন হয় বহুগুণ। অনেকটা বর্ষাকালে ধান-পাটের চাষাবাদ আর মৎস্য প্রজনন এবং শীতকালে রবিশষ্যের ফলনের মতো। হাদিস শরিফে এ কথাই বলা হয়েছে-

‘যে ব্যক্তি রমজানে কোনো সৎকাজ আঞ্জাম দেবে, তার সওয়াব হবে অন্য সময়ে কোনো ফরজ কাজ আঞ্জাম দেয়ার সমান। আর যে ব্যক্তি রমজানে কোনো ফরজ কাজ সম্পাদন করবে, তার সওয়াব হবে অন্য সময়ে ৭০টি ফরজ আদায় করার সমান। অর্থাৎ ১:৭০। এ কাজ যতবেশি ঈমানী চেতনা ও জাগ্রত অন্তরে ইহতিসাব সহকারে হবে, সওয়াবের অনুপাত তত বৃদ্ধি পবে।

সত্যিই সৎকর্ম চর্চার এমন একটি মৌসুম ভাগ্যে জুটার পরও যে নিজেকে শুধরে নিতে পারল না, সৎকর্মের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারল না, তার চেয়ে হতভাগা আর কে হতে পারে। আল্লাহ! দয়া করে আমাদের ঈমান ও ইবাদতের হেফাজত কর, বরকত দান কর।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত