রমজান আত্মশুদ্ধির সাধনার মাস। মানুষ নিজের মনের জমিনকে পরিচ্ছন্ন করবে, কুধারণা কুভাবনার আগাছা, আবর্জনা সাফ করে পবিত্র চেতনা ও মনোবলে হৃদ্ধ হবে, এজন্যই এক মাসব্যাপী সিয়াম সাধনা। প্রশ্ন হলো, আত্মশুদ্ধি বা তাজকিয়ার বাইরে সমাজ জীবনের জন্য কী রমজানের কোনো অবদান আছে? হ্যাঁ, অবশ্যই আছে।
রমজানের সিয়াম সাধনায় ব্যক্তির মন ও চিন্তা যখন পরিশুদ্ধ হয়, তার প্রভাব অবশ্যই সমাজ জীবনে পড়ে এবং গোটা সমাজকে আল্লাহর রহমতের সয়লাবে প্লাবিত করে।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টধর্মে আত্মশুদ্ধির সাধনা হয় নির্জন নিরালায়, দেহকে চরমভাবে পিষ্ট করে; কিন্তু রমজানের সাধনা একাকীত্বে নয়, বরং সমাজকে নিয়ে ধনী গরিব একসঙ্গে একাকার হয়ে। ইসলামের আত্মশুদ্ধির সাধনা দেহকে নিষ্পেষণ করার পরিবর্তে নিয়ন্ত্রণ ও সংযমের মাধ্যমে। সমাজবদ্ধভাবে জামাতে নামাজ আদায়, তারাবির জামাতে দেড় দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোরআন তেলাওয়াত শ্রবণ, শেষ রাতে ইফতারের জন্য পাড়ায় মহল্লায় সাজসাজ অবস্থা, সন্ধ্যায় একত্রে ইফতার প্রভৃতি প্রতিটি পদক্ষেপই সমাজ জীবনে আল্লাহর রহমতের সওগাত বিলায়।
যারা জীবনে ক্ষুধার যন্ত্রণা সয়নি, দুঃখি মজলুম মানুষের দুঃখ দুর্দশার সম্মুখীন হয়নি, তারা রোজা রেখে বাস্তবে সেই উপলব্ধিতে হৃদ্ধ হয়, যার সৌরভে গোটা সমাজ আমোদিত হয়। গরিব অসহায় মানুষের জন্য ধনী ও সামর্থবানদের দিলের দরজা খুলে যায়। কোরআন মজীদে মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলা হয়েছে, ‘তারা সম্পদ ও খাবারের প্রতি চরম আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও নিঃস্ব, অনাথ, এতিম ও বন্দিদশায় জর্জরিত মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করে।’ (সুরা দাহর, আয়াত-৪) বস্তুত সামাজিক যাবতীয় সৎকর্মের চর্চা এবং সর্বস্তরে এই কালচার গড়ে তোলার বাস্তব অনুশীলন হয় রমজানে। রমজানের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য আল্লাহর ভয়ে ও ভালোবাসায় মনকে জাগ্রত করা। আল্লাহর ভয়ে সংযমী জীবন যাপনের যে চেতনা ও মনোবলের চর্চা রমজানে হয় অন্য কোনো ধর্মে বা আদর্শে তার জুড়ি নেই।
দুনিয়ার কোনো ক্ষমতাধর নির্দেশ দিয়ে রোজা পালনে বাধ্য করতে পারবে না মানুষকে। কিন্তু রোজাদার চরম পিপাসা ও ক্ষুধায় কাতর হলেও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও গোপনে এক চুমুক পানি কিংবা এক গ্রাস খাবার খায় না আল্লাহর ভয়ে। প্রিয়তমা স্ত্রীর একান্ত সান্নিধ্যও সে বর্জন করে চলে আল্লাহর আদেশ মানার প্রেরণায়। এ দিক থেকে চিন্তা করলে রোজা ঈমানের চরম পরীক্ষা। এমন পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা বাকি জীবনে আল্লাহর আদেশের বিপরীত কোনো কাজ করে না, করতে পারে না।
সমাজের সর্বত্র যদি আল্লাহর ভয়ের চেতনার জোয়ার সৃষ্টি হয়, অবশ্যই অপরাধ, পাপ দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ হবে। একজন সমাজ বিজ্ঞানী বলেন, পশ্চিমের তথাকথিত সভ্য ও ধনী দেশগুলোতে মানুষ কীভাবে লোভ ও যৌনতার মহামারিতে আক্রান্ত তার প্রমাণ পাওয়া যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপদ্রুত এলাকায় লুটপাট ও যৌন হয়রানির মারাত্মক সব দুর্ঘটনা দেখে। অথচ আমাদের দেশে মানুষ দুর্যোগ কবলিত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিয়ে আত্মিক প্রশান্তি পায়। তার বক্তব্য, আমাদের গরিব দেশে প্রচণ্ড ঘনবসতি আর দারিদ্র্যের কষাঘাতেও তুলনামূলক শান্তির যে সুবাতাস প্রবাহিত, তার পেছনে রয়েছে অসংখ্য মসজিদ মাহফিল ও ধর্মীয় চর্চার প্রভাব। সম্প্রতি আফগানিস্তানে, ইরাকে, সিরিয়ায় আমেরিকার সিরিজ আগ্রাসনের পর যখন শরণার্থীরা অথৈ পাথারে সাঁতার কেটে ইউরোপীয় দেশগুলোতে আশ্রয়ের আশায় সাগরে ভাসতে থাকে, তখন সম্পদশালী ওসব দেশ অসহায় আদম সন্তানদের তাদের দেশের মাটিতে নামতে দেয়নি যুদ্ধাস্ত্র তাক করে। যারা কোনমতে উঠেছে তারাও মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের বড় বড় সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্টে শরণার্থীবাহী জাহাজ ডুবানোসহ বহু লোমহর্ষক ঘটনার প্রতিবেদন বিশ্ববেককে প্রকম্পিত করেছে। অথচ বাংলাদেশের মতো গরিব দেশের জনগণ। পার্শ¦বর্তী আরাকানের অসহায় আদম সন্তান যখন মিয়ানমারের উগ্র বৌদ্ধ ও জান্তা সরকারের যৌথ আগ্রাসনের নির্মম শিকার হয়ে প্রাণ হাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করে, যখন সরকার বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়গুলো নির্বিকার ছিল, তখন বাংলাদেশের গণমানুষ ত্রাণ সাহায্য নিয়ে এগিয়ে যায়। তখনকার পরিস্থিতিতে আমার একটি লেখা ছাপা হয়েছিল দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদকীয় পাতায়। নাম ছিল ‘প্রাণের দুয়ার খুলে দিয়েছে বাংলাদেশ।’
বাংলাদেশের সমাজে ও জনমনে অসহায় মানুষের সহায়তায় এগিয়ে যাওয়ার এই প্রেরণা কোত্থেকে এলো। নিশ্চয়ই মদীনার আনসাররা মক্কার মুহাজিদের যেভাবে বরণ করেছিল, চৌদ্দশ বছর পর সেই শিক্ষার প্রতিফলন বাংলার জমিনে হয়েছে। বাংলাদেশের গণমানুষ সিয়াম সাধনার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে মদীনার আনসারদের সেই চরিত্রের উদ্ভাস ধারণ করেছে। মানুষের জীবনযাত্রা ও সমাজের প্রাণশক্তি অর্থনীতি। ধমনীতে রক্ত সঞ্চালনের মতো গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতি পূর্ণমাত্রায় সচল হয় রমজানে ও ঈদে। পুঁজিবাদের মূল থিম সঞ্চয় কর, ইসলামের মূল থিম ব্যয় কর। রমজানে সমাজে ব্যয়ের মহাধুম পড়ে যায়, ধনীরা গরীবদের মাঝে জাকাত ফিতরা ও দান দক্ষিণা বিলায়। তাতে গরিবদের জীবনে সচ্ছলতা আসে। তারাও কেনাকাটা করে, অর্থের সঞ্চালনা হয়, অর্থনীতি প্রাণবন্ত হয়, সমাজ উপকৃত হয়। সমাজের সর্বত্র সহযোগিতা, আত্মীয়তা, সহমর্মিতা, পবিত্র চেতনার মহা সমারোহ দেখা দেয়। তার পূর্ণ প্রদর্শনী হয় ঈদুল ফিতরে। ধনী-গরিব একই কাতারে দাঁড়িয়ে আল্লাহর সামনে একটি সুন্দর সমাজের কুচকাওয়াজ করে ঈদগাহে । রমজানে রোজাদারের প্রতিটি কাজ হয় আল্লাহর ভয়ে ও ভালোবাসায়। এই ভালোবাসা আল্লাহর রাসূলের প্রতি ভালোবাসায় মানুষের মন ও জীবনকে আপ্লুত করে এবং তারই ফল্গুধারার বসন্ত জাগে সমাজ জীবনে। রোজা প্রত্যেকের মনে একটি চিন্তা জাগ্রত করে, তা হলো, শুধু নিজেরা ভালো হলে চলবে না। অন্যের ভালো করার উদ্যোগ নিতে হবে। ফিলিস্তিনের অসহায় মানুষের প্রতি, আমাদের সমাজের প্রতি, বিশ্বমুসলিমের প্রতি আমাদের দায়িত্ব আছে। আমাদের সমাজের জালিম ও শয়তানের দোসরদের বর্জন করতে হবে। ভালোত্বের উজ্জীবন ঘটাতে হবে।