জম্মু কাশ্মীরে পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৮ জন নিহতের ঘটনায় ভারত ও পাকিস্তানের উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। ক্রমবর্ধমান এই উত্তেজনা পরমাণু শক্তিধর দুই দেশকে শেষ পর্যন্ত সামরিক সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয় কি না তা নিয়ে ভাবছে পর্যবেক্ষকরা। কারণ, পেহেলগামের ঘটনার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই কাশ্মীর নিয়ন্ত্রণরেখায় (এলওসি) ভারত ও পাকিস্তানের সেনাদের মধ্যে গুলি বিনিময় হচ্ছে। গত শনিবার দিবাগত রাতে আবারও গোলাগুলি হয়েছে। এ নিয়ে ধারাবাহিকভাবে তৃতীয় রাতের মতো গোলাগুলি হলো। ভারতীয় সেনাবাহিনী গতকাল রোববার এ কথা জানিয়েছে।
প্রতিবেশী দেশ দুটির মধ্যকার সম্পর্ক গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে তলানিতে এসে ঠেকেছে। ভারতের অভিযোগ, পাকিস্তান আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন দিচ্ছে। তবে পাকিস্তান ওই হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে। এ নিয়ে ভারতের যে কোনো পদক্ষেপের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। পেহেলগামে হামলায় দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজতে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী বড় ধরনের অভিযান চালাচ্ছে। ভারতীয় পুলিশের দাবি, পলাতক বন্দুকধারীদের মধ্যে দুজন পাকিস্তানি নাগরিক। রোববার ভারতীয় সেনাবাহিনী দাবি করে, নিয়ন্ত্রণরেখায় পাকিস্তানি সেনারা বিনা উসকানিতে গুলি ছুড়েছেন। জবাবে ভারতীয় সেনারা পাল্টা গুলি ছুড়েছেন। পেহেলগামের ঘটনায় নয়াদিল্লি এরই মধ্যে দুই দেশের মধ্যকার ঐতিহাসিক সিন্ধু পানি বণ্টন চুক্তি স্থগিত করেছে, পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের প্রধান স্থলসীমা বন্ধ করে দিয়েছে, কূটনৈতিক সম্পর্ক কমিয়েছে ও পাকিস্তানিদের ভিসা প্রত্যাহার করেছে। জবাবে ইসলামাবাদ ভারতীয় কূটনীতিক ও সামরিক উপদেষ্টাদের বহিষ্কারের নির্দেশ দিয়েছে, ভারতীয় নাগরিকদের ভিসা বাতিল করেছে এবং নিজেদের অংশের প্রধান সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করে দিয়েছে। তবে শিখ তীর্থযাত্রীদের ভিসা বহাল রাখা হয়েছে।
এদিকে কাশ্মীরে ভয়াবহ হামলার পর ভারত উজানে সিন্ধুর পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছে। আবার বিপরিত চিত্রও দেখা গেল। পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের অন্যতম প্রধান নদী ঝিলামের পানির ছেড়ে দিয়েছে ভারত। যার ফলে মাঝারি মাত্রার বন্যা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সেখানকার বাসিন্দাদের সতর্ক থাকতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পাকিস্তানের কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফ্ফরাবাদের বিভাগীয় প্রশাসন গত শনিবার এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে জানিয়েছে, ভারত ঝিলাম নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছাড়ছে।
এতে করে সেখানে হঠাৎ করে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। বিবৃতিতে মুজাফ্ফরাবাদ প্রশাসনের মুখপাত্র বলেছেন, ‘ঝিলাম নদীতে ভারত স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পানি ছাড়ায় মাঝারি বন্যার সৃষ্টি হয়েছে।’ পাক সংবাদমাধ্যম দুনিয়া নিউজ জানিয়েছে, পাকিস্তানকে অবহিত না করেই নদীর পানি বেশি পরিমাণে ছাড়ছে ভারত। এরপর হু হু করে ঝিলাম নদীর পানি বেড়ে যায়। বন্যার বিষয়ে সতর্ক করতে মসজিদ থেকে স্থানীয়দের মাইকিং করতে শোনা গেছে। এতে করে নদীপাড়ের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এই পানি ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের অনন্তনাগ থেকে পাকিস্তানের চাকোঠি দিয়ে প্রবেশ করছে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে থাকা সিন্ধু নদের একটি উপনদী হলো ঝিলাম।
পাকিস্তানের সঙ্গে থাকা সিন্ধু নদের পানি চুক্ত স্থগিত করেছে নয়াদিল্লি। দেশটি হুমকি দিয়েছে পাকিস্তানকে সিন্ধু নদের এক ফোঁটা পানিও দেওয়া হবে না। অপরদিকে পাকিস্তান বলেছে, সিন্ধুর প্রবাহ আটকানোর চেষ্টা করা হলে এটিকে তারা যুদ্ধের কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা করবে। আর সেই অনুযায়ী (সামরিক) ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এর আগে শুক্রবার ভারতের জলশক্তিমন্ত্রী সিআর পাতিল জানান, পাকিস্তানে ভারত থেকে নদীর এক ফোঁটা পানিও যেন না যায় সেই ব্যবস্থা নিচ্ছেন তারা। তার এমন ঘোষণার পর শনিবার এক জনসভায় এমন হুমকি দিয়েছেন পাকিস্তান সরকারে থাকা বিলওয়াল ভুট্টো। তিনি বলেন, ‘সিন্ধু আমাদের আছে, সিন্ধু আমাদের থাকবে- হয় এটি দিয়ে আমাদের পানির স্রোত বইবে নয়তো তাদের (ভারতীয়) রক্ত বইবে।’
গত মঙ্গলবার ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলায় ২৬ জন নিহত হন। পরোক্ষভাবে পাকিস্তান এ হামলায় জড়িত এমন অভিযোগ তুলে বুধবার দেশটির সঙ্গে ১৯৬০ সালের সিন্ধু নদ পানি চুক্তি স্থগিত করে ভারত। যদিও এ মুহূর্তে সিন্ধু নদের পানি প্রবাহ আটকানোর মতো অবকাঠামো ভারতের নেই। তবে পানির প্রবাহ বন্ধ করতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন দেশটির জলশক্তিমন্ত্রী। তিনি এক্সে লেখেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠকে একটি রোপম্যাপ প্রস্তুত করা হয়েছে। বৈঠকে তিনটি অপশন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সরকার স্বল্পকালীন, মধ্যকালীন এবং দীর্ঘকালীন ব্যবস্থার ওপর কাজ করছে যেন পাকিস্তানে এক ফোঁটা পানিও না যায়। শিগগিরই নদীর প্রবাহ বন্ধ করতে ড্রেজিং কাজ সম্পন্ন হবে এবং প্রবাহ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হবে।’
এদিকে কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার মধ্যেই হামলার শিকার হয়েছে লন্ডনে অবস্থিত পাকিস্তানি হাইকমিশন। হামলার ফলে ভবনের জানালার কাচ ভেঙে যায় এবং সাদা দেয়ালে ও নামফলকে গেরুয়া রঙের পেইন্ট ছিটিয়ে দেওয়া হয়। লন্ডনে ঘটনাটি এমন সময়ে ঘটল, যার একদিন আগে শত শত ভারতীয় বিক্ষোভকারী পাকিস্তানি হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ করে। ওই বিক্ষোভ চলাকালে দুজনকে সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তারও করা হয়। এদিকে ভারতীয় বিক্ষোভকারীদের জবাবে পাকিস্তানের সমর্থনে পাল্টা বিক্ষোভকারীরাও ওই সময় উপস্থিত ছিলেন। পাল্টা বিক্ষোভকারীরা কাশ্মীরে ভারতের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন।
এছাড়া পাকিস্তানের হাতে ২০১৯ সালে আটক ভারতীয় বৈমানিক অভিনন্দন বর্তমানের ছবি এবং ‘চা ও কাপ’-এর প্রতীকী চিত্রও প্রদর্শিত হয়। এই চিত্র মূলত পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ‘অপারেশন সুইফট রিপোর্ট’-এর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ব্রিটেনে ভারতীয় ও পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত কমিউনিটি মূলত দীর্ঘদিন ধরেই নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক ইস্যুতে বিভক্ত। বিশেষ করে কাশ্মীর ইস্যু, সাম্প্রদায়িক সংঘাত নিয়ে। এছাড়া দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা যখন বাড়ে, তখন ব্রিটেনে বসবাসকারী দুই কমিউনিটির মধ্যেও তা ছায়া ফেলে। লন্ডনের এই সাম্প্রতিক ঘটনা দেখিয়েছে যে, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের টানাপোড়েন কেবল উপমহাদেশেই সীমাবদ্ধ নেই। বরং তা বিশ্বব্যাপী প্রবাসী কমিউনিটিগুলোর মধ্যেও তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এই উত্তেজনা সামাজিক অস্থিরতার ঝুঁকি তৈরি করছে। বিশেষ করে যেখানে দুপক্ষই নিজেদের বক্তব্য প্রকাশে রাজপথে নেমে আসে এবং তা কখনও কখনও সহিংসতায় রূপ নেয়। এদিকে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী লন্ডনে পাকিস্তান দূতাবাসের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
১৯৬১ সালের ‘Vienna Convention on Diplomatic Relations’ অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যের দায়িত্ব ছিল পাকিস্তান হাইকমিশনের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অর্থাৎ, মিশনের সম্মান রক্ষা এবং যে কোনো অনধিকার প্রবেশ বা ক্ষতি প্রতিরোধ করা হোস্ট দেশ তথা যুক্তরাজ্যের আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ ঘটনার মাধ্যমে প্রশ্ন উঠছে- ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কি যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েছিল? কেন বিক্ষোভের সময় সম্পত্তি নষ্ট হওয়ার সুযোগ তৈরি হলো? যুক্তরাজ্যের জন্য এটি শুধু পাকিস্তানের নয়, সব বিদেশি মিশনের নিরাপত্তা প্রশ্নেও এক বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এদিকে হামলার নিন্দা জানিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ ‘নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য’ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। সেইসঙ্গে তিনি এ ধরনের যে কোনো তদন্তে ইসলামাবাদের অংশগ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছেন। এর আগে গত শুক্রবার পাকিস্তানের সিনেট সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব পাস করে পেহেলগাঁও হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের যোগসূত্র আছে দাবি করে ভারতের যে অভিযোগ তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। একই সঙ্গে এসব অভিযোগকে ভিত্তিহীন এবং রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেও অভিহিত করা হয়েছে।
পারমাণবিক শক্তিধর দেশ দুটি এরইমধ্যে প্রতিশোধমূলক পাল্টপাল্টি বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এছাড়া দুই দেশই সীমান্তে বাড়াচ্ছে ব্যাপক সামরিক উপস্থিতি। এমনই এক উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থার মধ্যে বিস্ফোরক এক মন্তব্য করেছেন পাকিস্তানের রেলওয়েমন্ত্রী হানিফ আব্বাসী। তিনি বলেছেন, ভারতকে ঘায়েল করতে তার দেশ পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম শাহীন ও গজনবীর মতো ক্ষেপণাস্ত্রসহ ১৩০টি ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুত করে রেখেছে। হানিফ আব্বাসী আরও বলেছেন, ‘শাহীন ও গজনবী ক্ষেপণাস্ত্রগুলো আমরা আমাদের ঘাঁটিতে প্রস্তুত করে রেখেছি, সেগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে হিন্দুস্তানের জন্য। ১৩০টি ক্ষেপণাস্ত্র কেবলমাত্র নমুনা হিসেবে রাখা হয়নি, আপনাদের কোনো ধারণাই হবে না যে পাকিস্তানের কোথায় কোথায় সেগুলো মোতায়েন করা হয়েছে।’
ভারতীয় গণমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত থেকে পাকিস্তানি দূতাবাসের সামরিক কর্মকর্তাদের বহিষ্কারের মাধ্যমে দেশটির বিরুদ্ধে কূটনৈতিক ব্যবস্থা নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানি রেলমন্ত্রী এমন মন্তব্য করেছেন। হানিফ আব্বাসী বলেন, ‘এসব ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, এসব আমি আবারও বলছি এগুলো শোকেসে রাখা হয়নি, এগুলো তোমাদের দিকেই তাক করে রাখা হয়েছে, আর কারও দিকে নয়।’ হুঁশিয়ারি দিয়ে হানিফ আব্বাসী আরও বলেন, যদি ভারত ইন্দুস চুক্তি ভঙ্গ করে পাকিস্তানের নদীগুলোতে পানির প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তবে পাকিস্তান ‘পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের’ জন্য প্রস্তুত।