ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

হতাশা কাটছে না বিএনপির

* সরকারের বক্তব্যে সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপের ঘোষণা না থাকায় আমরা হতাশ হয়েছি- সংবাদ সম্মেলনে বললেন খন্দকার মোশাররফ * ফের অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি
হতাশা কাটছে না বিএনপির

দীর্ঘ দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে আছে বিএনপি। প্রায় ১৬ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মামলা-হামলায় কোণঠাসা ছিল দলটি। সেই দীর্ঘ সময় নানা হতাশায় দিন কাটাতে হয়েছে দলটির নেতাকর্মীদের। গত বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনেকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি। তবে এখনও দলটির হতাশা কাটেনি। আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঝে নতুন করে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে বারবার ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসলেও এখন পর্যন্ত সেই রোডম্যাপ ঘোষণা না করায় নতুন করে দলটির নেতাকর্মীরা আবার হতাশ হচ্ছে। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন হতাশা ব্যক্ত করে বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার আলোচনা প্রসঙ্গে তার প্রেস সচিবের মাধ্যমে সরকারের যে বক্তব্য পাওয়া গেছে, তাতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো রোডম্যাপের ঘোষণা না থাকায় আমরা হতাশ হয়েছি।’

সূত্রমতে, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর দায়িত্ব নেয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসা বিএনপি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছে। সবশেষ গত শনিবার রাতে একই দাবিতে বৈঠক করে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল। এ দাবির সঙ্গে আরও একটি দাবি যোগ হয়েছে তা হলো- তিন উপদেষ্টার পদত্যাগ। এসব দাবি আদায়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো আশ্বাস পায়নি বিএনপি। এতে দলটির নেতাকর্মীরা অনেকটা হতাশ। ওইদিন বৈঠক শেষে খন্দকার মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের আলোচনার মধ্যে আসছে সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন। আমরা বলেছি, একটার সঙ্গে আরেকটার সম্পর্ক নেই।’ তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচরের জন্য দ্রুত রোডম্যাপ প্রণয়নের দাবি আমরা জানিয়েছি। বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল দায়িত্ব হচ্ছে একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে গণতন্ত্র উত্তরণের প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যে কোনো উছিলায় নির্বাচন যত বিলম্ব করা হবে আমরা মনে করি জাতির কাছে আবার স্বৈরাচার ফিরে আসার ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে। এর দায় দায়িত্ব বর্তমান সরকার ও তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ওপরে বর্তাবে।’

বৈঠকের তিন দিন পর গতকাল মঙ্গলবার বিকালে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি। মূল বক্তব্য দেন জাতীয় স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, গত ২৪ মে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির চার সদস্যের প্রতিনিধিদল বৈঠক করেন। ওই বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার পক্ষে প্রেস সচিব শফিকুল আলম সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন। সেখানে তার বক্তব্যে আগামী নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ না থাকায় হতাশ হয়েছে বিএনপি। তিনি বলেন, বিএনপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল কোনো সময়েই প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ চায়নি এবং এখনও চায় না। কিন্তু আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করে এসেছি।

সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, তাই সংস্কার ও নির্বাচন প্রক্রিয়া দুটোই একইসঙ্গে চলতে পারে বলে উল্লেখ করে বিএনপি এই নেতা বলেন, পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তির এবং ব্যক্তির অর্থাৎ দল এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার প্রক্রিয়া চলমান থাকবে।

বিএনপির এই নেতা বলেন, বিএনপির সঙ্গে বৈঠকের দিন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভা শেষে উপদেষ্টা পরিষদের বিবৃতিতে যে বক্তব্য জাতির সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর। সরকার পরিচালনায় নিরপেক্ষতার ঘাটতির কারণে এবং দুর্বলতার কারণে জনমনে সংশয় ও সন্দেহের উদয় হওয়া স্বাভাবিক। বিভিন্ন মহলের অযৌক্তিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দাবি-দাওয়া এবং ইখতিয়ার বহির্ভূত বক্তব্য সরকারের স্বাভাবিক কাজের পরিবেশ বিনষ্ট হওয়ার যে অভিযোগ সরকারের পক্ষ থেকে উত্থাপন করা হয়েছে, সেটা মূলত সরকারের নিজস্ব বক্তব্য।

খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘পরাজিত শক্তির ইন্ধনে এবং বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে সরকারের উপর দায়িত্ব পালনকে অসম্ভব করে তোলা হচ্ছে। আমরা বলতে চাই, যথাশীঘ্র একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমেই পরাজিত শক্তির ইন্ধন এবং বিদেশি ষড়যন্ত্র বন্ধ করা সম্ভব। সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য অবিলম্বে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ প্রদান করা জরুরি, এর কোনো বিকল্প নেই।’

মোশাররফ উল্লেখ করেন, দেশকে স্থিতিশীল রাখতে, নির্বাচন, বিচার ও সংস্কার কাজ এগিয়ে নিতে এবং চিরতরে এ দেশে স্বৈরাচারের আগমন প্রতিহত করতে ফ্যাসীবাদবিরোধী বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন। তিনি বলেন, জুলাই ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা এবং জনপ্রত্যাশাকে ধারণ করে অতিশীঘ্র রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা অতি জরুরি।

আমরা সরকারের নিরপেক্ষ ভূমিকা এবং চরিত্র বজায় রাখার স্বার্থে বিতর্কিত উপদেষ্টাদের অপসারণ চেয়েছি বলেও মন্তব্য করেন মোশাররফ।

মোশাররফ হোসেন বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে ইশরাক হোসেনের পক্ষে আদালতের রায় অনুযায়ী গেজেট নোটিফিকেশন হয়েছে, অথচ সরকার আজ পর্যন্ত তার শপথ গ্রহণের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আমরা আশা করি, কালবিলম্ব না করে সরকার তার শপথ গ্রহণের ব্যবস্থা নেবে।

লিখিত বক্তব্যে মোশাররফ আরও বলেন, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার, মানবাধিকারসহ ভোটাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যথাশীঘ্র সম্ভব জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করাই এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। তাই, আমরা একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ডিসেম্বরের মধ্যে একটি জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছি। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অ্যাজেন্ডা হওয়া উচিত বলে জনগণ মনে করে। এর অন্যথা হলে জনগণের দল হিসাবে বিএনপির পক্ষে এই সরকারের প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এসময় সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন- বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, সালাহউদ্দিন আহমেদ, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন।

বিএনপি নেতারা বলছেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে বিগত ১৭ বছর ধরে আন্দোলন করে আসছেন তারা। সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেশকে ফ্যাসিবাদমুক্ত করা হয়। তবে এখনও স্বস্তি মিলছে না, দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসেনি। দেশের মানুষের ভোটাধিকার ফিরে আসেনি। সেখানেও নানা বাধা-বিপত্তি আর প্রতিবন্ধকতা। একের পর এক ইস্যু সৃষ্টি করে নির্বাচনকে দূরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে আমরা হতাশ হচ্ছি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১১ সাল থেকে ‘সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা’, ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর ‘আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ’ এবং ২০১৮ সালের পর ‘খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা’ ছিল বিএনপির প্রধান দাবি। কিন্তু ৫ আগস্টের পর পাল্টে গেছে বিএনপির দাবি-দাওয়া। এখন বিএনপির একটাই দাবি, দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা’।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত