প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে বিক্ষোভ মিছিলের ওপর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) নিষেধাজ্ঞা থাকলেও গতকাল টানা চতুর্থ দিনের মতো সচিবালয়ের ভেতরে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন সরকারি কর্মচারীরা। গতকাল মঙ্গলবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্যেই সচিবালয়ের ভেতরে বিক্ষোভ করেন তারা। তবে, কয়েকজন সচিবের সঙ্গে বৈঠকের পর আশ্বাস পেয়ে বুধবারের জন্য আন্দোলন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সরকারি কর্মচারীরা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ প্রত্যাহারের দাবিতে গতকাল বেলা ১১টার পর সচিবালয়ের ভেতরে বিক্ষোভ করেন কর্মচারীরা। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া কেউ ঢুকতে পারেনি। দুপুরের পর সাংবাদিকদের সচিবালয়ে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়।
এদিকে ভূমি মন্ত্রণালয়ে এক বৈঠকের পর আন্দোলনকারীদের অন্যতম নেতা নুরুল ইসলাম বলেন, আমরা আইনের কোনো সংশোধন চাই না। পুরোপুরি বাতিল চাই। গতকাল বৈঠকের মাধ্যমে সরকারকে সেই বার্তা দেয়। পাশাপাশি সরকারের সিদ্ধান্তের জন্য বুধবার কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করা হয়। সরকার সিদ্ধান্ত জানানোর পর আন্দোলন বিষয়ে পরবর্তী ঘোষণা দেওয়া হবে।
বৈঠক শেষে ভূমি সচিব এ এস এম সালেহ আহমেদ বলেন, সচিবালয়ের কর্মচারীরা সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ সম্পূর্ণভাবে বাতিল চেয়েছেন। এই তথ্য কেবিনেট সচিবকে জানানো হবে। এরপর সরকার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে।
সচিবালয়ে কর্মচারীদের লাগাতার আন্দোলনের মধ্যে গতকাল মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশিদ বেশ কয়েকজন সচিবকে নিয়ে জরুরি সভা করেন। ওই সভায় অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত হয়। পরে দুপুর ২টায় ভূমি সচিব, গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব, পরিসংখ্যান সচিব, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব ও যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। প্রায় দুই ঘণ্টা বৈঠকের পর ভূমি সচিব বলেন, সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে কয়েকদিন ধরে আন্দোলন হচ্ছে। তার পরিপেক্ষিতে গতকাল সকালে মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ কয়েকজন সচিবকে নিয়ে একটি মিটিং করে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত দেয়। বৈঠকের মাধ্যমে আন্দোলনকারীরা কী চান সেই বিষয়টি আমরা তাদের কাছ থেকে জানতে চেয়েছি। আন্দোলনকারীরা পুরো আইনটি বাতিল চেয়েছে। তারা মনে করে এটি মিসইউজ হতে পারে।
সালেহ আহমেদ বলেন, আজ বৈঠকের বিষয়ে বুধবার সকাল ১০টায় সকল সচিব মিলে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে বিষয়টি অবহিত করা হবে। এরপর সরকার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে এবং সেটি জানানো হবে। ততক্ষণ আন্দোলনকারীরা তাদের আন্দোলন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সচিবালয়ে কঠোর নিরাপত্তা : সচিবালয় ঘিরে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের পাশাপাশি সোয়াট ও বিজিবির অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়। সচিবালয়ে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছাড়া আর অন্য কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল মঙ্গলবার সচিবালয়ের দর্শনার্থীদের প্রবেশ বন্ধ থাকবে। গেটে কর্মরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানান, সরকারি কর্মচারী অধ্যাদেশ ঘিরে গত তিন দিন ধরে সচিবালয়ের ভেতরে বিক্ষোভ করে আসছেন সরকারি কর্মচারীরা। বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিক্ষোভ মিছিলে প্রতিদিনই উত্তাল থাকছে সচিবালয়। সেজন্য গতকাল সচিবালয় ঘিরে বাড়তি নিরাপত্তা সদস্য মোতায়েন করা হয়।
প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদ সরকারি চাকরি আইন সংশোধন করে অধ্যাদেশ আকারে জারি করার প্রস্তাবে সায় দেয়। এর প্রতিবাদে শনিবার সকাল থেকে দিনভর সচিবালয়ে বিক্ষোভ করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের আপত্তির মধ্যেই রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে রোববার রাতে অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এতে পুরোনো আইনের সঙ্গে ’৩৭ক’ নামের আরেকটি ধারা সংযোজন করা হয়। নতুন ধারায় একজন কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে দুই দফায় সাত দিন করে নোটিসের পর দায়ী হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা রাখার বিধান রাখা হয়েছে।
অধ্যাদেশে ‘আচরণ বা দণ্ড সংক্রান্ত’ বিশেষ বিধানে বলা হয়েছে- কেউ যদি এমন কাজ করে যা অনানুগত্যের সামিল এবং যা অন্য কর্মচারীদের মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি করতে পারে বা শৃঙ্খলা বিঘ্ন ঘটাতে পারে বা অন্যের কর্তব্য পালনে বাধার সৃষ্টি করতে পারে, এককভাবে বা সম্মিলিতভাবে ছুটি ব্যতীত কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে। কাউকে কর্মবিরতিতে বাধ্য বা উস্কানি দেওয়া, অন্য কর্মচারীকে কাজে বাধা দেওয়া হলে, কোনো কর্মচারীকে তার কর্মস্থলে আসতে বা কাজ করতে বাধা দেওয়া হলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ হবে, এসব অপরাধের শাস্তি হিসেবে পদাবনতি বা গ্রেড অবনতি, চাকরি থেকে অপসারণ কিংবা চাকরি থেকে বরখাস্ত করার বিধান রাখা হয়েছে। এসব অসদাচরণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অভিযোগ গঠন, সাত দিনের সময় দিয়ে কারণ দর্শানোর নোটিস, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কারণ জানিয়ে জবাব না দিলে আবার সাত দিনের নোটিস দেওয়ার পর তা বিবেচনা করে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে। তবে অভিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীর আপিল রাখার সুযোগ রয়েছে। দণ্ডের নোটিস হাতে পাওয়ার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে আপিল করা যাবে।
আন্দোলন দেশজুড়ে ছড়ানোর হুমকি : ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ বাতিল না করা হলে আন্দোলন সারা দেশে সরকারি দপ্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের একাংশের সভাপতি মুহা. নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত এই অধ্যাদেশ বাতিল করা হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত আন্দোলন প্রত্যাহার করার কোনো সুযোগ নেই। বরং ভবিষ্যতে তা আরও তীব্র হবে। প্রয়োজনে এই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে।