ঢাকা বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

রাজনীতিতে সক্রিয় খালেদা জিয়া, চাঙ্গা বিএনপি

রাজনীতিতে সক্রিয় খালেদা জিয়া, চাঙ্গা বিএনপি

বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। যিনি তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তার স্বামী জিয়াউর রহমান ছিলেন রাষ্ট্রপতি। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর বয়স এখন ৮২ বছর। যিনি আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের রোষানলের মামলায় দীর্ঘদিন কারাবরণ করেছেন এবং নানা শারীরিক অসুস্থতায় রাজনীতি থেকে দীর্ঘদিন বাইরে ছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মিথ্যা ও বানোয়াট সব মামলা থেকে রেহাই পেয়ে লন্ডনে উন্নত চিকিৎসার জন্য যান খালেদা জিয়া। সেখানে উন্নত চিকিৎসার পর গত কোরবানির ঈদের আগে দেশে ফিরেন তিনি। দেশে ফিরে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হতে শুরু করেছেন। এরইমধ্যে সমাবেশে ভার্চুয়ালি বক্তব্য রেখেছেন। ঈদে নেতাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেছেন। সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত জার্মানির বিদায়ী রাষ্ট্রদূত আখিম ট্রোসটার এর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎও করেছেন তিনি। বিশেষ করে- সম্প্রতি বিএনপির নেতাকর্মীদের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কোনো বিরোধে না জড়িয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের আহ্বান জানান। এরপরই রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়। খালেদা জিয়ার এমন আহ্বানকে সবাই সাধুবাদ জানায়। এর পরপরই লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা জানান রমজানের আগে ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচন হতে পারে। এরপরই সারা দেশে ভোটের হাওয়া শুরু হয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, লন্ডন বৈঠক, ভোটের পরিবেশ তৈরি এবং রাজনীতিতে একটা স্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি, এসবই সম্ভব হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আন্তরিক হস্তক্ষেপ ও যোগ্য নেতৃত্বে। আবার কেউ কেউ বলছেন, খালেদা জিয়া এখন অনেকটা সুস্থ হয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। তার আন্তরিক প্রচেষ্টায় বর্তমান রাজনীতিতে স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। শুধু তাই নয়, বেগম জিয়ার রাজনীতিতে সক্রিয়তায় বিএনপি এখন অনেকটাই চাঙ্গা।

বিএনপির নেতারা বলছেন, সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত জার্মানির বিদায়ী রাষ্ট্রদূত আখিম ট্রোসটার। এ সময় সঙ্গে ছিলেন তার সহধর্মিণীও। গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের বাসভবন ফিরোজায় এই সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় খালেদা জিয়া ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন- বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন ও চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব এ বি এম আব্দুস সাত্তার। এছাড়া ম্যাডাম সম্প্রতি সমাবেশে ভার্চুয়ালি বক্তব্যও রেখেছেন। গত ঈদে নেতাদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ও করেছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। তার রাজনীতিতে এমন সক্রিয়তা দলের নেতাকর্মীদের অনেক চাঙ্গা করে তুলেছে। আশা করছি, ম্যাডাম পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে দেশের রাজনীতি ও উন্নয়নে আরও ভূমিকা রাখবেন।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু আলোকিত বাংলাদেশকে বলেছেন, ম্যাডাম আগের চেয়ে এখন অনেকটা ভালো আছেন। তবে, এখনও পরিপূর্ণ সুস্থ হননি। তিনি হাসলে বাংলাদেশ হাসে। বিএনপি নেতাকর্মীদের আশার জায়গা ও বাতিঘর হচ্ছে বেগম খালেদা জিয়া। সম্প্রতি রাজনীতিতে তার কিছুটা সক্রিয়তায় নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে। আমাদের প্রত্যাশা তিনি আরও সক্রিয় হবেন এবং আগের মতো দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।

জানামতে, ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে যখন হত্যা করা হয়, তখন খালেদা জিয়া ছিলেন নিতান্তই একজন গৃহবধূ। দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে তখন ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থান করছিলেন খালেদা জিয়া। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি তখন বিপর্যস্ত এবং দিশাহারা। জিয়াউর রহমান পরবর্তী দলের হাল কে ধরবেন, সেটি নিয়ে নানা আলোচনা চলতে থাকে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যার পর ভাইস-প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন আব্দুস সাত্তারের বয়স আনুমানিক ৭৮ বছর। বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের বার্ধক্য এবং দল পরিচালনা নিয়ে অসন্তোষের কারণে তৎকালীন বিএনপির একাংশ খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আনার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু রাজনীতির প্রতি খালেদা জিয়ার তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। একপর্যায়ে দলের নেতাকর্মীরা রাজনীতিতে আসার জন্য দিনের পর দিন খালেদা জিয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। তিনি দলের হাল না ধরলে দল টিকবে না বলেও অনেকে বলেন।

তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে খালেদা জিয়া আত্মপ্রকাশ করেন।

সেদিন তিনি বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ লাভ করেন। একই বছর ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমানের সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে খালেদা জিয়া প্রথম বক্তব্য রাখেন। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে খালেদা জিয়া দলের সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান হন এবং এপ্রিল মাসের প্রথমে বিএনপির এক বর্ধিতসভায় তিনি ভাষণ দেন। সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের কয়েকমাস পরেই খালেদা জিয়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। এ সময় এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে উঠেন তিনি। এরপর ১৯৮৪ সালের ১০ মে খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

১৯৮০ দশকে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে দেশজুড়ে খালেদা জিয়ার ব্যাপক পরিচিত গড়ে উঠে। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে বিএনপি জয়লাভ করে। রাজনীতিতে আসার ১০ বছরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। শুধু তাই নয়, খালেদা জিয়া তার রাজনৈতিক জীবনে যতগুলো নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, তার সবগুলোতেই জয়লাভ করেছেন। ১৯৯৬ সালে আবার বিএনপি ক্ষমতায় আসলে খালেদা জিয়ার দ্বিতীযবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু সেবার আন্দোলনের মুখে বিএনপি বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসলে খালেদা জিয়া তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন।

২০০৮ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার দল বিএনপির ব্যাপক ভরাডুবি হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জনের পর বিএনপি রাজনৈতিকভাবে অনেকটা চাপে পড়ে যায়। খালেদা জিয়ার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এসে হাজির হয়, তার বিরুদ্ধে করা দুর্নীতির মামলা। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যান সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।

দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হওয়ার কারণে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে খালেদা জিয়া অংশ নিতে পারেননি। দেশে-বিদেশে সে নির্বাচন প্রবল বিতর্কের মুখে পড়ে। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ থেকে বেগম জিয়া সরকারের নির্বাহী আদেশে কারাগারের বাইরে ছিলেন। যদিও এজন্য তাকে নানা বিধিনিষেধ পালন করতে হয়। যার মধ্যে ছিল- রাজনীতিতে অংশ না নিতে পারা, কোনো ভাষণ বা বক্তব্য না দেওয়া, বিদেশ যেতে না পারা ইত্যাদি। এরপর গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরশাসক আওয়ামী লীগের পতনের পর মামলা থেকে খালাস পেয়ে লন্ডনে উন্নত চিকিৎসার জন্য যান। চিকিৎসা শেষে গত কোরবানির ঈদের আগে দেশে ফেরেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এরপরই রাজনীতিতে সক্রিয় হতে শুরু করেন তিনি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত