সুর্নিদিষ্ট সময়সীমা ঘোষিত না হলেও ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের পুরোপরি প্রস্তুতি নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ লক্ষ্যে সংসদ ভোটের কেনাকাটা, সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও আইন সংশোধনের কাজ করছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। সাম্প্রতি রাজনৈতিক মহলে স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হলেও ইসির তা নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই। তারা আসন্ন সংসদ ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ইসি সূত্র জানায়, প্রথমে ডিসেম্বরকে সামনে রেখে সংসদ ভোটের কার্যক্রম শুরু করলেও বর্তমানে ইসির প্রস্তুতি আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলকে সামনে রেখে। এ সময়ের মধ্যে যে কোনো সময় সরকার থেকে সিগন্যাল পেলে ভোট করবে ইসি। এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন জানিয়েছেন, নির্বাচনের জন্য ফুল গিয়ারে প্রস্তুতি চলছে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তিনি বলেন, আমাদের প্রস্তুতি এই মুহূর্তে জাতীয় নির্বাচন ঘিরেই। স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে আমাদের প্রস্তুতি নেই। আমাদের ফোকাস জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনের সম্ভাবনা সময় নিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনের তারিখ নিয়ে এখনও কোনো আলোচনা হয়নি। সময় আসলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হবে। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল সময় ধরে নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে।
নির্বাচন কমিশন সচিব আখতার আহমেদ জানিয়েছেন, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ এবং পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিক নীতিমালা সংশোধনের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে। অনলাইন বা পোস্টাল ভোটের বিষয়টি চূড়ান্ত না হলেও প্রবাসীদের নিবন্ধনের প্ল্যাটফর্ম তৈরির কাজও দ্রুত হচ্ছে।
গত ৬ জুন জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা দেন, আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধে হতে পারে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন। তবে ১৩ জুন লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকে, সংস্কার ও বিচারের অগ্রগতি সাপেক্ষে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সম্ভাবনার কথাও বলেন প্রধান উপদেষ্টা। সে হিসাবে, নির্বাচন কমিশনের হাতে আছে ৭ থেকে ৯ মাস। জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে আগেভাগেই শেষ করতে হয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ। নির্বাচনি রোডম্যাপে থাকে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা। অতীতে সাধারণত প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের অন্তত দেড় বছর আগে রোডম্যাপ প্রকাশ করেছে ইসি। ভোটের আগে দল নিবন্ধন, সীমানা পুনর্নির্ধারণ, ভোটার তালিকা প্রকাশ, বিধি সংস্কারসহ বিশাল কর্মযজ্ঞ শেষ করতে হবে কমিশনকে। তাই নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় ঘোষিত না হলেও অত্যাবশ্যক সব কাজই এগিয়ে রাখা হচ্ছে। যৌক্তিক বিবেচনায় ভোটার করার সুযোগ রাখতে সংশোধন করা হচ্ছে আইন।
ইসি সচিব আখতার আহমেদ আরও বলেন, ব্যালট পেপার-বাক্স-সিল-বস্তা-অমোচনীয় কালি ইত্যাদি সংগ্রহের কাজ ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ করতে চায় কমিশন। তবে আচরণবিধির খসড়া চূড়ান্ত হলেও ধীরে এগোচ্ছে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের কাজ। আখতার আহমেদ বলেন, সময়সীমা বলা যাচ্ছে না, কারণ রাজনৈতিক ঐকমত্যের সঙ্গে আরপিওর বিষয় সম্পর্কিত। ঐকমত্যের পর সংশোধনীর প্রস্তাব আরও কয়েকটি ধাপ আছে। তিনি জানান, দল নিবন্ধনের বিষয়টি সময়সাপেক্ষ। কারণ, এবার ১৪৭টি আবেদন জমা পড়েছে, যা প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি।
লন্ডনের বৈঠকের পর বিএনপির পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, যেহেতু ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোট করার কথা সরকার বলেছে, তাই এখনই রোডম্যাপ ঘোষণা করা উচিত। নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের ধারণা, যেহেতু বিশেষ পরিস্থিতিতে এবার নির্বাচন, তাই জুলাই সনদের ওপর সবকিছু নির্ভর করছে। ইসিও দেখতে চায়, জুলাই সনদ অনুসারে কী কী সংস্কার করতে হবে এবং কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে। এসব দেখার পর সেভাবেই রোডম্যাপ ঘোষণা করবে। চলতি সপ্তাহে শুরু হচ্ছে জুলাই মাস। তাই খুব শিগগিরই নির্বাচনি রোডম্যাপ বা ইসির কর্মপরিকল্পনা পাওয়া যাবে- এমন ধারণা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এই বাস্তবতায় গত বৃহস্পতিবার বিকালে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন। প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় দুজনের মধ্যে ওয়ান টু ওয়ান বৈঠক হয়েছে। সেই বৈঠকের পর সরকার বা নির্বাচন কমিশন কোনো পক্ষই কিছু বলেনি।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. মো. আব্দুল আলীম গণমাধ্যমকে বলেছেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। সেখানে নির্বাচন নিয়েই আলোচনা হওয়া উচিত; তাই হয়তো হয়েছে। এই সাক্ষাৎকারে কমিশন তাদের কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরতে পারেন। সরকারের পক্ষ থেকেও ইসির প্রস্তুতি জানতে চাওয়া হতে পারে।
যেহেতু একান্ত বৈঠক হয়েছে, তাই কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, সেটা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও ধারণা করা যায়, নির্বাচন নিয়েই আলোচনা হয়েছে। ইসি চাইলে কালকেও রোডম্যপ ঘোষণা করতে পারে। তিনি বলেন, এরই মধ্যে ইসি তাদের কাজ শুরু করছে। ভোটার তালিকা প্রস্তুত, সীমানা পুনর্নির্ধারণ, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, কেন্দ্র প্রস্তুতি এবং নির্বাচনি সরঞ্জাম কেনাকাটার কাজও হাতে নিয়েছে। তাই ধরেই নেওয়া যায়, নির্বাচন প্রস্তুতি পুরোদমে শুরু করেছে ইসি। যদিও পরে গত মঙ্গলবার সিইসি জানিয়েছে ভোটের প্রস্তুতি নিলেও ভোট নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তাদের আলাপ হয়নি।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর সিইসি এএমএম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বে পুনর্গঠিত কমিশন শুরু থেকেই নির্বাচন নিয়ে কাজ করছে। ইসির প্রধান এজেন্ডা এখন নির্বাচন। তাই ইসির সব দাপ্তরিক কার্যক্রমও নির্বাচনকেন্দ্রিক বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির সচিব। জাতীয় নির্বাচনের আগে হালনাগাদ পূর্ণাঙ্গ ভোটার তালিকা, ভোটকেন্দ্রের প্রস্তুতি, নির্বাচনিসামগ্রী কেনাকাটা, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, সীমানা পুনর্নির্ধারণ এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মতো বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে ইসি। এর মধ্যে অধিকাংশ কাজই চলমান, কোনটি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, ব্যালট পেপারে প্রার্থীদের নাম ও প্রতীক থাকে, যা নির্বাচন কমিশনের সময়সূচি ঘোষণার পরপরই তালিকা অনুযায়ী ছাপাতে হয়। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই বিপুল পরিমাণ ব্যালট পেপার মুদ্রণ করে মাঠপর্যায়ের কার্যালয়গুলোতে পাঠানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। ইসি সূত্র জানায়, অন্যান্য ফরম, প্যাকেট, পরিচয়পত্র, আচরণবিধি, প্রতীকের পোস্টার, ম্যানুয়েল ও নির্দেশিকা সেপ্টেম্বরের মধ্যেই মুদ্রণ করে সংরক্ষণ করতে হবে। এদিকে স্থানীয় নির্বাচন আগে চেয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদের নেতারা। সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন চেয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপিসহ কয়েকটিদল সংসদ নির্বাচন চেয়েছে। তবে ইসি এখন স্থানীয় নির্বাচনের কোনো প্রস্তুতি নিচ্ছে না। সংসদ নিয়ে প্রস্তুতি চলছে।