সম্প্রতি সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বৈঠক শেষে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে, এমনটা ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচনের মাঠ তৈরিতে মনোযোগ দিয়েছে। এরমধ্যেই জাতীয় নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর বিবেদ সৃষ্টি হয়েছে। দিনে দিনে সেই বিবেদ চরমে পৌঁছে যাচ্ছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা পিআর পদ্ধতি ছাড়া নির্বাচন হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। জবাবে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো বলছে, বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্বাচনকে বিলম্বিত করার জন্য এই ইস্যুকে ইচ্ছাকৃতভাবে সামনে আনা হচ্ছে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এমন পদ্ধতিতে নির্বাচন কতটা সম্ভব তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন দলটির শীর্ষ নেতারা।
গত মঙ্গলবার জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান পিআর পদ্ধতিতে ভোটে ঐক্য বিনষ্ট হওয়ার শঙ্কার কথা জানিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা দেশে ঐক্যের পরিবর্তে বিভক্তি সৃষ্টি করতে পারে।’ পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের উপযোগিতা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে সতর্ক করেন তারেক রহমান। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনি ব্যবস্থার দাবি প্রসঙ্গে তারেক রহমান দেশের বাস্তবতায় এই পদ্ধতিতে ভোট করা কতটা উপযোগী তা নিয়েও চিন্তা করার কথা বলেছেন।
এর আগে গত শনিবার সংস্কার, বিচার এবং পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসমাবেশে যোগ দিয়ে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদের নেতারা পিআর ভোটের পক্ষে কথা বলেছেন। সমাবেশ থেকে পিআর ছাড়া নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনকে জনগণের দাবি উল্লেখ করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেন, ‘আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। সংসদের প্রস্তাবিত উভয় কক্ষেই এ পদ্ধতিতে নির্বাচন হতে হবে। এটি হলে কোনো দল জালেম হওয়ার সুযোগ পাবে না।’ একই অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি ছাড়া বাংলার মানুষ কোনো নির্বাচন গ্রহণ করবে না বলেও সাফ জানিয়ে দেন। যেখানে একই সূরে কথা বলেছে এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টিসহ আরও কয়েকটি দল।
এই সমাবেশের মধ্যদিয়ে পিআর পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা জোরদার হয়েছে। যদিও বিএনপি পিআর পদ্ধতিতে ভোট দাবির পেছনে নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র দেখছে। দলটির নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, নির্বাচন নিয়ে নতুন নতুন ইস্যু সামনে নিয়ে আসলে পতিত সরকার আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। নির্বাচন নিয়ে যখন ইতিবাচক কথাবার্তা হচ্ছে, তখন নতুন একটি ভোটের পদ্ধতি সামনে এনে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
বিএনপির নেতারা বলছেন, নির্বাচন নিয়ে যখন ইতিবাচক কথাবার্তা হচ্ছে তখন নতুন একটি ভোটের পদ্ধতি সামনে এনে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা আসলে নির্বাচনকে পিছিয়ে দেয়ার চেষ্টা। কারণ যারা এই দাবি তুলছেন তাদের অনেকে সারাদেশে প্রার্থীও দিতে পারেননি অতীতে। এমন হলে তো দেশ আবার অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে।
এদিকে ইসলামী আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব ও দলের মুখপাত্র গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘গণহত্যার বিচার ও প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর তারা পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন চান। আওয়ামী লীগের মতো ভবিষ্যতে অন্য কেউ যাতে এক নায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে না পারে সেজন্য এই পদ্ধতির বিকল্প নেই।’
যদিও নির্বাচন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থায় নির্বাচনে ভোটারদের জনমতের প্রতিফলন ঘটে। তবে রাজনৈতিক দলের ঐক্যমত ছাড়া এটি বাস্তবায়ন করা কঠিন বলেও মনে করেন তারা। বিশেষ করে বড় রাজনৈতিক দলের আপত্তির মুখে এই পদ্ধতি বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব হবে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, পিআর পদ্ধতির খারাপ-ভালো দুটো দিকই রয়েছে। এ পদ্ধতি অবলম্বন করলে ছোট ছোট দলগুলো গুরুত্ব পাবে। সংসদে আসন পাবে, তাদের দর কষাকষির সুযোগ বাড়বে। দেশে আওয়ামী লীগের ভোট আছে-খারাপ অবস্থায়ও এ পদ্ধতিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে বেশকিছু আসনে জয়লাভ করতে পারে। যার মাধ্যমে ফ্যাসিবাদকে আবার সুযোগ দেওয়া হবে। ফ্যাসিবাদ শেষ হয়ে গেলে এ পদ্ধতি চালু হলে ঠিক ছিল। এটা এখনই করতে গেলে সমস্যা বাড়বে। তিনি আরও মনে করেন, এ পদ্ধতিতে ভোট হলে এক একটা দল ৫টা, ১০টা করে আসন পাবে। তখন দেখা যাবে বহির্বিশ্বও তাদের স্বার্থে এদের কাজে লাগাবে। যেটি রাজনীতিকে আরও অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। এটি তখনই ফলপ্রসূ হবে, যখন আমাদের দেশের গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হবে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের একজন প্রফেসর বলেছেন, এটি করার মতো অবস্থা এদেশে এখন নেই। এখনই এ পদ্ধতিতে গেলে বাংলাদেশে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে। এটি হলে সরকারের স্থায়িত্ব নিয়েও আশঙ্কা থাকে। সরকার বারবার ভেঙে পড়তে পারে। ভালো দিক হচ্ছে, সবার অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়বে রাজনীতিতে। ছোট ছোট দল রাজনীতিতে গুরুত্ব পাবে। এ পদ্ধতিতে বিরোধীদলকে অবহেলার সুযোগ নেই। তার মতে এ পদ্ধতিতে আওয়ামী লীগ ফিরে আসার সুযোগ তৈরি হবে।
আনুপাতিক পদ্ধতি আর বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থায় পার্থক্য কী : দেশের বর্তমান সংসদীয় নির্বাচন ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো ৩০০টি আসনে আলাদা আলাদা প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। পিআর হচ্ছে নির্বাচনি ব্যবস্থার এমন একটি পদ্ধতি যেখানে আসন বণ্টন হবে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে। অর্থাৎ যদি কোনো দল মোট ভোটের শতকরা ১০ শতাংশ পায়, তাহলে সেই দল আনুপাতিক হারে সংসদের ১০ শতাংশ বা ৩০টি আসন পাবেন। বিদ্যমান পদ্ধতিতে এক আসনে চার প্রার্থীর মধ্যে বেশি ভোট যিনি পাবেন তিনিই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অন্য তিন প্রার্থী যত ভোট পান না কেন, তা কোনো কাজে আসে না। কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে ভোটের আগে প্রতিটি দল ক্রমভিত্তিতে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করবে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল তার প্রাপ্ত ভোটের হার অনুসারে আসন সংখ্যা পাবে। তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১৭০টি দেশের মধ্যে ৯১টি দেশে এই পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থা চালু রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ, ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে আনুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশেও নির্বাচন নিয়ে কাজ করেন, এমন বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময় আনুপাতিক হারে নির্বাচন পদ্ধতি চালুর সুপারিশ করেছিলেন। তবে তা কখনও আলোর মুখ দেখেনি। এবার জোরালো আলোচনা হচ্ছে।