ঢাকা শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

শোক ও গৌরবের জুলাই

বিক্ষোভে পুলিশের বাধা, ধস্তাধস্তি

৩২ জুলাই ২০২৪
বিক্ষোভে পুলিশের বাধা, ধস্তাধস্তি

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচিতে ২০২৪ সালের ১ আগস্টের এই দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাধা দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং গাইবান্ধা ও কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি উপেক্ষা করে আন্দোলনকারীরা জড়ো হয়, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে তাদের ধস্তাধস্তি হয়। নারায়ণগঞ্জে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করে পুলিশ।

কুড়িগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মুখে লাল কাপড় বেঁধে জেলার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। সংহতি জানিয়ে যশোরে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন সংস্কৃতিকর্মী ও আইনজীবীরা। ছাত্র-জনতা নিহতের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি জানায় এবং লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষক শেহরীন আমিনের ওপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে সমাবেশ করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ কর্মসূচি ঘিরে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে গণহারে গ্রেপ্তার, মামলা ও নির্যাতনের প্রতিবাদ জানায় শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাজ। মৌন মিছিল শেষে শিক্ষকরা উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সারাদেশে ‘প্রার্থনা ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ কর্মসূচি পালন করে।

ঢাবিতে তিন সমাবেশ, নীল দলের ব্রিফিং: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকপ্রশাসন, অর্থনীতি বিভাগ এবং নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাবেশের ব্যানারে পৃথক সমাবেশ হয়। বৃষ্টির মধ্যে শিক্ষকরা শুরুতে ছাতা নিয়ে দাঁড়ান। তবে এক শিক্ষক যখন বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের রক্তের কাছে এ বৃষ্টি কিছুই না’ তখন সবাই ছাতা গুটিয়ে ফেলেন। লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ৯ দফার সঙ্গে সংহতি জানিয়ে শহীদ মিনার থেকে মিছিল নিয়ে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে সমাবেশ করেন। নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাবেশে আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছিলেন, ‘সরকার হত্যাকাণ্ডের বিচার করবে না। কারণ তারা নিজেরাই খুনি। পৃথিবীতে গণহত্যার পর লাশের সংখ্যা ধামাচাপার চেষ্টা হয়। কিন্তু বর্তমান সরকার গণহত্যা করে ভুক্তভোগীদের গণহত্যার জন্য দায়ী করে গ্রেপ্তার করছে।’ তিনি বলেন, ‘ছাত্রদের অনিরাপদ রেখে আমরা শান্তিতে বসে থাকব না। বাংলাদেশের বুকে গুলি করা হয়েছে। তরুণরা হচ্ছে বাংলাদেশের হৃদয়। সে হৃদয়ে আঘাতের পর আমরা চুপচাপ মেনে নেব– সরকার যেন তা না ভাবে। খুনের বিচার করতে না পারলে, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে না পারলে সরকারকে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে।’

সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান, অধ্যাপক মইনুল ইসলাম, অধ্যাপক নাজনীন ইসলাম, অধ্যাপক ফেরদৌস আরফিনা ওসমান, অধ্যাপক সাদিক হাসান, অধ্যাপক এম এম আকাশ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাসিরউদ্দিন আহমেদ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বায়েজিদ ইসলাম কিশোর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মোশরেফা অদিতি হক প্রমুখ।

রাবিতে শিক্ষক-সাংবাদিককে হেনস্তা: মুখে লাল কাপড় বেঁধে মৌন মিছিল করে ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক’। এতে বিশ্ববিদ্যালয় ও নগরীর বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেন। আন্দোলনকারীরা জানান, কর্মসূচি শেষে সাদা পোশাকের পুলিশ সদস্যরা কয়েক শিক্ষার্থীকে টেনে-হিঁচড়ে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করে। শিক্ষকরা তা প্রতিহত করে নিরাপত্তা দিয়ে শিক্ষার্থীদের গন্তব্যে পৌঁছে দেন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে শিক্ষকদের ধস্তাধস্তি হয়। এর পরও আরবি বিভাগের ছাত্র আশিকুর রহমানকে আটক করা হয়। মতিহার থানার ওসি শেখ মোবারক পারভেজ জানান, সন্দেহজনক মনে হওয়ায় তাকে আটক করা হয়।

বারীন্দ্র মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী লাবণ্য বলেন, ‘সিভিল ড্রেসে থাকা কয়েকজন আমাদের আঘাত করেন। ভাইদের তুলে নেওয়ার চেষ্টা করেন।’ রাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘কোনো ছাত্রের গায়ে হাত কিংবা সহকর্মীকে আঘাত করা হলে মেনে নেব না। ক্যাম্পাস থেকে পুলিশ শিক্ষার্থীকে এভাবে তুলে নিতে পারে না।’ এদিকে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সমকালের বিশ্ববিদ্যালয় এবং দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের রাজশাহী প্রতিনিধিকে হেনস্তা করে পুলিশ। ভুক্তভোগী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের রাজশাহী প্রতিনিধি আমজাদ হোসেন বলেন, পুলিশ আমার ওপর চড়াও হয়। মোবাইল কেড়ে নিয়ে কিল-ঘুসি মারে।

‘গণঅভ্যুত্থানেই সরকারের পতন’: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার চত্বরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে প্রতিবাদী গানের মিছিল ও সমাবেশ করেন শিক্ষকরা। এতে সংহতি জানান সাভারের বেসরকারি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষকরাও। শহীদ মিনার থেকে শিক্ষকদের একটি মিছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে সমাবেশ করে। পরে সেখানে পারফরম্যান্স আর্ট পরিবেশন করেন চারুকলা এবং নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীরা।

সমাবেশে অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, ‘মানুষ, ছাত্র-জনতা এখন বুলেটের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে জানে। সবাই জেগে উঠেছে। ভয়-সন্ত্রাসকে জয় করে এ গণঅভ্যুত্থান নিশ্চয়ই জুলুমবাজ সরকারের পতন ঘটাবে।’ পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জামাল উদ্দিন বলেন, ‘এভাবে আন্দোলনকারীদের জেলে নিতে থাকলে আমরাও স্বেচ্ছায় কারাবরণ করব।’ সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক কামরুল আহসান, অধ্যাপক শামছুল আলম, অধ্যাপক মোহাম্মদ মাফরুহী সাত্তার, অধ্যাপক শওকত হোসেন, সহযোগী অধ্যাপক মাসুদা পারভীন, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক নাহিদ কায়সার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জাবি শাখার সমন্বয়ক আবদুর রশিদ, আহসান লাবিব প্রমুখ। নারায়ণগঞ্জে শিখা প্রজ্বালনে বাধা, শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা: ছাত্র আন্দোলনে হতাহতদের স্মরণে সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জ শহরে ‘মোমশিখা প্রজ্বালন’ কর্মসূচি পুলিশি বাধায় প- হয়ে গেছে। এ সময় পুলিশ লাঠিচার্জ করলে অন্তত ১০ শিক্ষার্থী আহত হন।

এ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা জানান, তারা শান্তিপূর্ণভাবে শহীদ মিনারে মোম হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কর্মসূচি শুরুর আগেই পুলিশ বাধা দেয় ও বেধড়ক লাঠিচার্জ করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পরে আশপাশের সড়কে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু একাধিকবার পুলিশ তাদের ধাওয়া করে সরিয়ে দেয়। এ সময় দুই কলেজছাত্রী পরস্পর হাতে হাত রেখে সড়কে দাঁড়িয়ে স্লোগান দেন। পরে আরও শিক্ষার্থী জড়ো হলে পুলিশ তিনজনকে আটক করে। সদর মডেল থানার ওসি শাহাদাত হোসেন জানান, অনুমতি ছাড়া কর্মসূচি করতে চাওয়ায় শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দেওয়া হয়। কোনো লাঠিচার্জের ঘটনা ঘটেনি।

বরিশালে ১২ শিক্ষার্থীকে তুলে নেয় পুলিশ: বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের বাধায় হয়নি ‘ছাত্র-শিক্ষক সংহতি সমাবেশ’। কর্মসূচি শুরুর আগেই দুপুর ১২টার দিকে পুলিশ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ববি সমন্বয়ক সুজয় শুভসহ ১২ শিক্ষার্থীকে তুলে নিয়ে যায়। যদিও বিকেলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোরে ছিল ছাত্র-শিক্ষক সংহতি সমাবেশ। সকাল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক আটকে অবস্থান নেয় বিপুল সংখ্যক পুলিশ। ভারী বৃষ্টি উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা প্রধান ফটকের সামনে জড়ো হন। এ সময় ১২ জনকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে আর হয়নি সমাবেশ। বন্দর থানার ওসি আব্দুর রহমান মুকুল জানান, ক্যাম্পাসে অস্থিতিশীল পরিবেশের আশঙ্কা থেকে ১২ আন্দোলনকারীকে থানায় আনা হয়। বিকেলে তাদের শিক্ষকদের জিম্মায় দেওয়া হয়।

আবু সাঈদসহ সব হত্যার বিচার দাবি: কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনে নিহত আবু সাঈদসহ সব হত্যাকাণ্ডের বিচার, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশের দাবি জানায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। মৌন মিছিল শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ রাসেল মিডিয়া চত্বরে সমাবেশে এ দাবি জানান তারা। এ সময় বক্তব্য রাখেন বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ, ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক মতিউর রহমান, শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আসাদুজ্জামান মণ্ডল আসাদ প্রমুখ। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এবং খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষকরা বৃষ্টির মধ্যে পৃথকভাবে ক্যাম্পাসে মৌন মিছিল করেছেন। এ সময় তারা আন্দোলনে নিহতের বিচার ও শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়নের বিচার দাবি করেন। এসব কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন কুয়েটের অধ্যাপক হেলাল-আন-নাহিয়ান, অধ্যাপক মুহাম্মদ শাহজাহান আলী, অধ্যাপক রাজিয়া খাতুন, সহযোগী অধ্যাপক মীর আব্দুল কুদ্দুস, অধ্যাপক শেখ শরিফুল আলম প্রমুখ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত