মহররম ফজিলতপূর্ণ মাস, কিন্তু একে কেন্দ্র করে সমাজে রয়েছে অসংখ্য বাড়াবাড়ি, ভুল ধারণা, কুসংস্কার ও মূর্খতা, যার ফিরিস্তি অনেক দীর্ঘ। অধিক প্রচলিত কিছু কুসংস্কার হলো-
আশুরার মর্যাদা প্রসঙ্গে ধারণা : অনেকে মনে করেন, আশুরা মানেই কারবালা; এ কারণেই মহররমের ১০ তারিখের এত গুরুত্ব ও মর্যাদা! অথচ আশুরার মর্যাদা ও ঐতিহ্য ইসলামপূর্ব যুগ থেকেই স্বীকৃত। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) হিজরত করে মদিনায় এলেন। তিনি মদিনার ইহুদিদের আশুরার দিন রোজা রাখতে দেখলেন। তাদের এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা বলল, ‘এটা সেই দিন, যেদিন আল্লাহ মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে মুক্তি দিয়েছেন; ফেরাউন ও তার জাতিকে ডুবিয়ে মেরেছেন। তার সম্মানার্থে আমরা রোজা রাখি।’ তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আমরা তোমাদের চেয়েও মুসা (আ.)-এর অধিক নিকটবর্তী।’ এরপর তিনি এ দিনে রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। (মুসলিম : ২৫৪৮)।
মিথ্যাচার ও অলীক কথাবার্তা : মহররমের গুরুত্ব বোঝাতে অনেকে ভিত্তিহীন নানা কথা বলেন। যেমন- এ মাসে ইউসুফ (আ.) জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন, ইয়াকুব (আ.) চোখের জ্যোতি ফিরে পেয়েছেন, ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছেন, ইদরিস (আ.)-কে আসমানে তুলে নেওয়া হয়। অনেকে বলেন, এ দিনেই কেয়ামত সংঘটিত হবে। এসব কথার কোনো ভিত্তি নেই। (আল-আসারুল মারফুআ, আবদুল হাই লাখনবি : ৬৪-১০০; মা সাবাতা বিস-সুন্নাহ ফি আয়্যামিস সানাহ, আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলবি : ২৫৩-২৫৭)।
খাবারে নিষেধাজ্ঞা : মহররম এলে অনেকে মাছ, শাক ও মিষ্টি জাতীয় খাবার খান না। এর কারণ কী, কেন খাচ্ছেন না? কোনো সদুত্তর নেই। অথচ ইসলামি শরিয়তে অন্যান্য মাসের মতো এ মাসেও কোনো হালাল খাদ্য হারাম নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বছরের সবসময়ই হালাল খাদ্য গ্রহণ করেছেন। কোনো কারণে মহররমেও তা বর্জন করেননি। কারণ, আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘হে মোমিনরা! আল্লাহ যেসব পবিত্র বস্তু তোমাদের জন্য হালাল করেছেন, তোমরা তা হারাম করো না এবং সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা মায়িদা : ৮৭)।
বিয়েশাদিতে কঠোরতা : অনেকে মনে করেন, এ মাসে বিয়ে করলে তা শুদ্ধ হবে না। কারণ, এতে ইমাম হুসাইন (রা.)-কে অপমান করা হয়। অথচ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর থেকে এ ধরনের কোনো নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে বিয়ে করল, সে তার অর্ধেক দীন পূর্ণ করল; বাকি অর্ধেক দীনের জন্য সে যেন তাকওয়া অবলম্বন করে।’ (শুআবুল ইমান লিল বাইহাকি : ৫৪৮৬; সহিহুল জামে : ৪৩০)। শায়খ আলবানি (রহ.)-এর মতে, ‘বিয়ের জন্য কোনো নির্দিষ্ট মাস বা সময়ের কথা বলা হয়নি।’ (সহিহুত তারগিব ওয়াত তারহিব : ১৯১৬-এর টিকা)।
ভিত্তিহীন কেচ্ছাকাহিনি : উড়িয়া যায় রে জোড়া কবুতর, ফাতেমা কেন্দে কয়-
আজ বুঝি কারবালার আগুন লেগেছে মোর কলিজায়।
মা ফাতেমার কান্দন শুনে আরশ থেকে আল্লাহ কয়-
যাও গো জিব্রিল বাতাস কর মা ফাতেমার কলিজায়,
পুত্রশোকে কলিজা জ্বলে বাতাসে কী ঠান্ডা হয়!
এ ধরনের মিথ্যা কথা ও কেচ্ছাকাহিনি কবিতা ও গানের সুরে সমাজে প্রচলিত আছে। এগুলো যে মিথ্যা, তার প্রমাণ হলো- ফাতেমা (রা.) মৃত্যুবরণ করেন ১১ হিজরিতে, আর হুসাইন (রা.) শহিদ হন ৬১ হিজরিতে। দুজনের মাঝে প্রায় ৫০ বছরের ব্যবধান। (আত-তবাকাতুল কুবরা, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত : ৮/২৩)।
উদ্ভট নামাজের রেওয়াজ : মহররমের ১০ তারিখে রোজা পালনের কথা হাদিসে এসেছে; কিন্তু ওদিন দিনে বা রাতে কোনো বিশেষ নামাজের বিধান নেই। অথচ অনেকে মনে করেন, যে ব্যক্তি আশুরার দিনে জোহর ও আসরের মধ্যবর্তী সময়ে অথবা রাতে এত রাকাত নামাজ অমুক অমুক সুরা এতবার করে পড়ে আদায় করবে, সে এত এত পুরস্কার লাভ করবে।
সরলপ্রাণ মুসলমানদের মন জয় করার জন্য তারা এসব কথার অবতারণা করে থাকেন। অথচ ইসলামে এ ধরনের কোনো আমলের ভিত্তি নেই। (মাওজুআত লি ইবনিল জাওজি : ২/৪৫-৪৬; লাআলি লিশ শায়খ জালালুদ্দিন সুয়ুতি : ২/৫৪; তানজিহ লি ইবনে আররাক : ২/৮৯; আল-ফাওয়াইদ লিশ শাওকানি : ১/৭৩; আল-আসার লি আবদিল হাই লাখনবি : ৯০ ও ১১০-১১১)।
মৃত্যুবার্ষিকী পালন : কোনো মুসলমান মারা গেলে তার মৃত্যুতে সর্বোচ্চ তিনদিন শোক পালন করা যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে স্ত্রীলোক আল্লাহ ও কেয়ামাত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে, তার পক্ষে স্বামী ছাড়া অন্য কোনো মৃত ব্যক্তির জন্য তিনদিনের বেশি শোক পালন করা বৈধ নয়। অবশ্য স্বামীর জন্য সে চার মাস দশদিন শোক পালন করবে।’ (বোখারি : ১২৮০; মুসলিম : ১৪৮৬)। তাই কোনো মুসলমান মৃত্যুবরণ বা শাহাদতবরণ করলে ইসলামে তার জন্য মৃত্যুবার্ষিকী পালনের বিধান নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবিরা কখনও কারো জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেননি। হুসাইন (রা.)-এর শাহাদতবরণের মর্মান্তিক ঘটনাটি মহররমের ১০ তারিখে ঘটেছিল; কিন্তু এর জন্য সেদিন শোক দিবস হিসেবে পালন করা শরিয়তসম্মত নয়। (আশুরায়ে মহররম ও আমাদের করণীয়, মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব : ১৬-১৭)।
শোকমাতম : আশুরার দিনকে কেন্দ্র করে অনেকে ‘হায় হুসাইন, হায় হুসাইন!’ বলে বিলাপ করেন, বুক চাপড়ান ও মাথায় কালো কাপড় বেঁধে শোক প্রকাশ করেন; যা সম্পূর্ণভাবে হারাম ও কবিরা গোনাহ। (আল-কাবায়ের, ইমাম জাহাবি : ৩৫৮)। আলেমরা একমত যে, আওয়াজ করে মৃত ব্যক্তির জন্য কান্নাকাটি করা বৈধ নয়। (ফিকহুস সুন্নাহ, বৈরুত : ১/৩৭১)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মানুষের মধ্যে দুটি আচরণ এমন পাওয়া যায়, যা তাদের ক্ষেত্রে কুফরিমূলক কর্ম- ১. বংশে খোঁটা দেওয়া ও ২. মৃতের জন্য মাতম করে কান্না করা।’ (মুসলিম : ৬৭; তিরমিজি : ১০০১; মুসনাদে আহমদ : ৭৮৪৮)। আবু বুরদা ইবনে আবু মুসা (রহ.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, একবার আমার বাবা অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। এতে আমার মা বিলাপ করতে লাগলেন। এরপর তিনি সংজ্ঞা ফিরে পেলেন। মাকে বললেন, ‘তুমি কী জানো না?’ তারপর তিনি একটি হাদিস বর্ণনা করলেন; রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি তার সঙ্গে সম্পর্কহীন, যে মাথার চুল ছিঁড়ে, উচ্চস্বরে বিলাপ করে এবং জামার গলা ফাঁড়ে।’ (মুসলিম : ১০৪; সুনানে নাসায়ি : ১৮৬৩; সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৫৮৬)।
শোক মিছিল : আশুরার দিন হুসাইন (রা.)-এর কাল্পনিক কবর তৈরি করে অনেকে তাজিয়া বা শোক মিছিল করেন। ওই কাল্পনিক কবরগুলোকে ‘আত্মাসমূহের অবতরণস্থল’ বলে ধারণা করেন। সেখানে হুসাইন (রা.)-এর আত্মা উপস্থিত হওয়ার ধারণায় তাকে সালাম দেন। তার সামনে মাথা ঝুঁকান। সেখানে সেজদা করেন। মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য প্রার্থনা করেন। এগুলো স্পষ্ট শিরক। (আশুরায়ে মহররম ও আমাদের করণীয়, মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব : ১০)। তাজিয়া-মাতম বর্জন করে তাদের জন্য দোয়া করা উচিত। (ইসলামী বিশ্বকোষ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ : ৩/৩৯০)।
সাহাবি ও তাবেয়িদের গালমন্দ : আশুরার দিন হাসান-হুসাইন (রা.)-কে মর্যাদা দিতে গিয়ে অনেকে কোনো কোনো সাহাবি-তাবেয়ি সম্পর্কে মন্দ ধারণা করে থাকেন। এমনকি তাদের গালমন্দও করেন। আয়েশা (রা.)-এর নামে একটি বকরি বেঁধে রেখে লাঠিপেটা ও অস্ত্রাঘাতে রক্তাক্ত করেন। এছাড়া মুআবিয়া (রা.) ও তার ছেলে ইয়াজিদকে কারবালার ঘটনার জন্য দায়ী করে গালিগালাজ করেন। অথচ সাহাবিদের গালি দেওয়া কবিরা গোনাহ। (আল-কাবায়ের, ইমাম জাহাবি : ৪১০)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা আমার সাহাবিদের গালমন্দ করো না। তোমাদের কেউ যদি উহুদ পর্বত পরিমাণ সোনা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় কর, তবুও তাদের এক মুদ বা অর্ধ মুদণ্ডএর সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করতে পারবে না।’ (বোখারি : ৩৬৭৩; মুসলিম : ২৫৪০)।
হক-বাতিলের লড়াই ভাবা : কারবালার ঘটনাকে অনেকে হক ও বাতিলের লড়াই বলে আখ্যায়িত করেন। তারা হুসাইন (রা.)-কে হক ও ইয়াজিদকে বাতিল বলে মনে করেন। এ বিশ্বাস ঠিক নয়। বিষয়টি ছিল ইজতিহাদি বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, হক-বাতিলের নয়। কারণ, হুসাইন (রা.)-কে হকপন্থী মনে করলেও ইয়াজিদকে বাতিল বলা যাবে না।
ইয়াজিদ মুআবিয়া (রা.)-এর যোগ্য সন্তান ছিলেন এবং মুআবিয়া (রা.)-এর পরে তাকে খলিফা বানানোর জন্য সব গভর্নর পরামর্শ দিয়েছিলেন। তৎকালে জীবিত ৬০জন সাহাবি ও ইসলামি বিশ্বের নেতাদের প্রায় সবাই তাকে মেনে নিয়েছিলেন ও তার বাইআত করেছিলেন। হুসাইন (রা.) নিহত হওয়ার পরও তার বিরুদ্ধে কোনোরূপ আন্দোলন গড়ে তোলেননি তারা।
আর তিনি প্রায় চার বছর (৬০-৬৪ হিজরি) মুসলিম সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন। প্রথমদিকে কেবল মদিনায় চারজন সাহাবি বাইআত নিতে বাকি ছিলেন- আবদুল্লাহ ইবনে ওমর, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের ও হুসাইন ইবনে আলী (রা.)। প্রথম দুজন পরে বাইআত করেন; শেষের দুজন গড়িমসি করলে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) তাদের বলেন, ‘আল্লাহকে ভয় করুন। মুসলিম জাতির মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি করবেন না।’ (আশুরায়ে মহররম ও আমাদের করণীয়, মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব : ১৮)।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক