ঢাকা সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মুসলিম ঐক্যে বাধা কোথায়

আসাদ পারভেজ
মুসলিম ঐক্যে বাধা কোথায়

গত শতাব্দীজুড়ে মুসলিমরা বিশ্বে পদদলিত, অবহেলিত, নির্যাতিত ও নিপিড়িত। মুসলিম জাতি যেন আজ অবক্ষয় ও অধঃপতনের পথে। কিন্তু কেন আজ ইসলামের এ দূরাবস্থা? যে ধর্ম পুরো বিশ্বে আলো, ন্যায় ও শান্তির পথ দেখিয়েছে এবং সহিংসতা, অন্যায় ও বিশৃঙ্খলাকে পুরোপুরিই বাধা দিয়েছে; যার ফলে ইসলাম পৃথিবীর কোণায় কোণায় পৌঁছেছে। অথচ সেই ধর্মই আজ অবক্ষয়ের পথে। এ অধঃপতনের মূল কারণ অনৈক্য। এ জন্যই বিজ্ঞানী জর্জ বার্নার্ড শ বলেছেন, ‘ইসলাম হলো সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম; কিন্তু মুসলিমরা হলো নিকৃষ্ট অনুসরণকারী।’

ঐক্যের ঈমানি প্রয়োজন : মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঐক্য সর্বদা শক্তি ও অগ্রগতির প্রতীক। বিশেষ করে, ইসলাম ধর্মে ঐক্যের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা; যার মূলভিত্তি হলো ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব। এটি একটি বিশ্বজনীন ধর্ম; যার মৌলিক বার্তা ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও ন্যায়পরায়ণতা। মহানবী (সা.)-এর মদিনা সনদ মানব ইতিহাসের প্রথম লিখিত সংবিধান; যেখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে একতার বন্ধনে আবদ্ধ করা হয়েছিল। নিঃসন্দেহে ইসলাম এমন একটি ধর্ম, যা উম্মাহকে এক দেহ ও পরিবার হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর রশি (কোরআন ও সুন্নাহ) দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিভক্ত হয়ো না।’ (সুরা আলে ইমরান : ১০৩)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘নিশ্চয় মুসলমানরা একে অপরের ভাই।’ (সুরা হুজুরাত : ১০)। এতে বোঝা যাচ্ছে, মুসলমানদের ঐক্য শুধু সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক প্রয়োজনে নয়; বরং ঈমানি দায়িত্ব।

উত্তরণের সুনির্দিষ্ট পথ খোঁজা দরকার : ইসলামি ঐক্য পুরো বিশ্বকে একক পরিবারে দেখে, যা পৃথিবীজুড়ে প্রশান্তি বিতরণে এক মহান স্তম্ভ। যেমন- ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে রচিত মদিনা সনদ মুসলিম ও অমুসলিম বিশ্বকে ‘একক উম্মাহ’ ঘোষণা করেছিল। বাস্তবে আজকের মুসলিম বিশ্ব রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, সাংস্কৃতিকভাবে পিছিয়ে পড়েছে ও নানা সমস্যায় জর্জরিত। পরাশক্তির করুণায় নির্ভরশীল। ফলে ইসলামি ঐক্য প্রশ্নটি শুধু আবেগ নয়, বরং টেকসই উন্নয়ন, আত্মমর্যাদা ও বৈশ্বিক নেতৃত্ব পুনরুদ্ধারের শর্তে পরিণত হয়েছে। অতএব, আমাদের একান্ত অতীব জরুরি, ইসলামি ঐক্যের অপরিহার্যতা, ঐক্য তৈরিতে বাধা কোথায় এবং এ সব বাধাগুলো চিহিৃত করে উত্তরণের সুনির্দিষ্ট পথ খুঁজে বের করা।

ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব :

উম্মাহ তথা জাতির মর্যাদা রক্ষা : মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা টিকিয়ে রাখতে ঐক্যের প্রয়োজন।

রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা : বিশ্ব নিয়ন্ত্রণে রাজনীতির বিকল্প নেই। মুসলিম বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ হলে বৈশ্বিক রাজনীতিতে বড় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারবে। যেমন- ঐক্যের কারণেই ৬৩২-৬৬১ সালে মুসলিম উম্মাহ রোম ও পারস্যের মতো পরাশক্তিকে পরাজিত করে। উমাইয়া ও আব্বাসীয় খেলাফতের সময় বাগদাদ, দামেস্ক ও আন্দালুসে জ্ঞানচর্চা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির স্বর্ণযুগ ছিল ঐক্যের ফসল। অটোমান সাম্রাজ্য ১২৯৯-১৯২৪ পর্যন্ত প্রায় ৬ শতাব্দী ধরে মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব ও বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে টিকেছিল নিশ্চয় ঐক্যের কারণে। এ মুসলিম উম্মাহ অনৈক্যের কারণে ১৯২৪ সালে খেলাফত (অটোমান) হারিয়েছে।

বাহ্যিক শত্রুর মোকাবিলা : ইসলামবিরোধী শক্তি সবসময় বিভাজন সৃষ্টি করে। বিভক্তির কারণে মুসলিম জাতি অপমানিত ও নিপীড়িত হচ্ছে বিশ্বে। ঐক্য এসব প্রতিরোধের একমাত্র উপায়।

আত্মমর্যাদা, স্বাতন্ত্র্য ও বৈশ্বিক নেতৃত্ব পুনরুদ্ধার : ঐক্য মুসলমানদের আত্মমর্যাদা, স্বাতন্ত্র্য ও বৈশ্বিক নেতৃত্ব পুনরুদ্ধারের একমাত্র উপায়। তাছাড়া মুসলিম উম্মাহকে একসূত্রে বাঁধা কোরআন ও সুন্নাহর শিক্ষা। ঐক্য ইসলামি শরিয়তের একটি মৌলিক শিক্ষা। ভ্রাতৃত্ব ছাড়া পূর্ণাঙ্গ ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয় না।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা : মুসলিম বিশ্বে রয়েছে রবের দেওয়া অফুরন্ত তেল, গ্যাস, খনিজ ও কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান। ঐক্যবদ্ধভাবে এগুলো ব্যবহার করলে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব।

দাওয়াতের বিস্তার : একক কণ্ঠে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে পারলেই অধিকতর কাজ সমাধান সম্ভব।

ঐক্যের পথে বাধাগুলো :

সাম্প্রদায়িক বিভাজন : শিয়া-সুন্নি, মাজহাবভিত্তিক মতপার্থক্য ও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব।

রাজনৈতিক স্বার্থবাদিতা : মুসলিম দেশগুলোর শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব। যেমন- মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক সংঘাত।

উপনিবেশবাদ ও পরাশক্তির প্রভাব : মুসলিম ঐক্যকে দুর্বল করা বৈদেশিক শক্তির স্থায়ী ষড়যন্ত্র। তারা আমাদের ওপর জেঁকে বসে বিভক্ত শাসন নীতি প্রয়োগ করছে।

অজ্ঞতা ও শিক্ষার অভাব : ইসলামের মূলনীতি থেকে দূরে সরে যাওয়া তথা কোরআন-সুন্নাহভিত্তিক প্রকৃত শিক্ষার অপ্রতুলতা।

অর্থনৈতিক নির্ভরতা : নিজেদের অফুরন্ত সম্পদ থাকার পরও অজ্ঞতার কারণে পরনির্ভরশীলতা এদেরকে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে দেয় না। ওপেক-এর শক্তি থাকলেও মুসলিম দেশগুলো পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষায় নির্ভরশীল।

জাতীয়তাবাদ, ভূরাজনীতি ও ভৌগোলিক সীমারেখা : জাতীয় স্বার্থকে ইসলামি ভ্রাতৃত্বের চেয়ে প্রাধ্যন্য দেওয়া। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সাইকস-পিকো চুক্তি (১৯১৬) আরব বিশ্বকে কৃত্রিম সীমারেখায় ভাগ করে নেয়।

বিভক্তি থেকে উত্তরণের উপায় :

কোরআন-সুন্নাহর আলোকে ঐক্যের রূপরেখা তথা ইসলামি শাসনতন্ত্র ও শরিয়াভিত্তিক নীতিকে কেন্দ্র করে ইসলামি বিশ্বের মিলন হলেই নানা অপকৌশল থেকে আমরা মুক্তি পাব।

আকিদাগত ঐক্য : মৌলিক ঈমানি বিশ্বাসে ঐক্য গড়ে তোলা এবং গৌণ বিষয়ে সহনশীলতা অর্জন। তারপর তাওহিদের পতাকার নিচে সমবেত হলেই বিভক্তি দূর হবে।

সংলাপ ও সহমর্মিতা : মতপ্রার্থক্যকে বিদ্বেষ নয়, বরং পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান। ভিন্ন মতালম্বীদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তোলা। তা ছাড়া মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের নিয়মিত সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমে দ্বন্দ্ব নিরসন করা চাই।

শিক্ষা ও জ্ঞানার্জন : মুসলিম যুব সমাজকে আধুনিক বিজ্ঞান ও ইসলামি জ্ঞানে সমৃদ্ধ করা। বিশেষ করে, কোরআন-সুন্নাহভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে মুসলিম তরুণ প্রজন্মকে ঐক্যবদ্ধ করা।

সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিরোধ : মিডিয়া, সাহিত্য ও শিল্পকলায় ইসলামি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা। ইসলামি ইতিহাস, সভ্যতা ও ভাষাগত বৈচিত্র্যের মধ্যে একাত্মতা জোরদার করা।

সম্মিলিত অর্থনৈতিক সহযোগিতা : মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য, প্রযুক্তি ও সম্পদে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে ঐক্যের বাস্তব রূপ দেওয়া। বিশেষ করে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো ইসলামি অর্থনৈতিক ব্লক গঠন করে বাণিজ্য ও সম্পদে স্বনির্ভরতা অর্জন। মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মুহাম্মদ বহুবার বলেছেন, ইসলামি স্বর্ণদিনের মতো মুসলিম দেশগুলোকে ‘ইসলামিক গোল্ড দিনার’ চালু করতে হবে।

দৃঢ় নেতৃত্বে গ্লোবাল প্ল্যাটফর্ম ও কূটনীতি : মুসলিম বিশ্বে এমন নেতৃত্ব দরকার, যারা ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে উম্মাহর কল্যাণে কাজ করে। বিশেষ করে, ওআইসি’র মতো সংগঠনকে শক্তিশালী ও কার্যকর ভূমিকা পালনে সক্ষম করা।

রাজনৈতিক সদিচ্ছা : মুসলিম রাষ্ট্রনেতাদের ইসলামি ভ্রাতৃত্বকে জাতীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে।

শেষ কথা :

ইসলামের শিক্ষায় স্পষ্ট- ঐক্য হলো- একপ্রকারের শক্তি, আর বিভেদ হলো দুর্বলতা। ইসলামি ঐক্য শুধু একটি স্বপ্ন নয়; এটি মুসলিম উম্মাহর পুনর্জাগরণের পূর্বশর্ত। আজ মুসলিম উম্মাহর রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক মুক্তি ও সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের জন্য ঐক্য অপরিহার্য। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মুসলমানরা যখন ঐক্যবদ্ধ ছিল, তখন তারাই বিশ্বের নেতৃত্ব দিয়েছে; আর বিভক্ত তাদেরকে দুর্বল থেকে অপমানিত করেছে। পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিন, ভূস্বর্গ কাশ্মীর, আরাকানের রোহিঙ্গা, চায়নার উইঘুর আর সিরিয়ার সংকট এরই জ্বলন্ত প্রমাণ। যদি আমরা পরস্পরের প্রতি ভেদাভেদ ও বিদ্বেষ ভুলে আল্লাহর রশি দৃঢ়ভাবে ধারণ করি এবং ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও সহনশীলতার মাধ্যমে জাতি হিসেবে দাঁড়াতে পারি, তবে আবারও মুসলিম উম্মাহ বিশ্বসভায় নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে। আল্লাহ তো বলেছেন, ‘আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।’ (সুরা রাদ : ১১)। মুসলিম বিশ্বের স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনতে ঐক্য নামক যে পুনর্জাগরণের প্রয়োজন, তা অর্জনের মধ্য দিয়ে বিশ্বশাসকে পরিণত হওয়ার বিকল্প নেই।

লেখক : গবেষক ও রাষ্ট্রচিন্তক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত