ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আছে তুমুল বিতর্ক। এই তিনটি নির্বাচনে ভোটের নামে প্রহসন হয়েছে, হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে, যা আমাদের দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করেছে। দীর্ঘমেয়াদে গণতন্ত্র হুমকিতে পড়েছে বলে অনেকের মত। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন কেএম নূরুল হুদা। ওই নির্বাচনের পর তার বিরুদ্ধে দিনের ভোট রাতে করার অভিযোগ এসেছিল। এবার সেই কথা স্বীকার করেছেন নূরুল হুদা। একইসঙ্গে নিজের অপারগতার কথাও জানিয়েছেন।
গতকাল বুধবার এ তথ্য জানিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক সাজেদুর রহমান। তিনি বলেন, গতকাল (১ জুলাই) নূরুল হুদা প্রহসনের নির্বাচন ও রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় ১৬৪ ধারায় দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিতে রাজি হওয়ায় আদালতে জবানবন্দি রেকর্ডের আবেদন করি। পরে বিকাল ৩টা থেকে সাড়ে ৫টা পর্যন্ত আড়াই ঘণ্টা জবানবন্দি চলে। জবানবন্দিতে তিনি সেই নির্বাচনে কারসাজির সব কথাই স্বীকার করেছেন। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, তৎকালীন সরকারের চাপের মুখে ২০১৮ সালে প্রহসনের নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছেন। সে সময় সরকার দলের নেতাকর্মী, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা, রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসাররা মিলে দিনের ভোট রাতেই করে ফেলেন। বিষয়টি যখন জানতে পারি, তখনই সব শেষ হয়ে গেছে। নির্বাচনের সময় পার হওয়ার পর জানতে পারি, কিছু কিছু কেন্দ্রে ৯০ থেকে ১০০ শতাংশ ভোট পড়েছে। তখন আমি বুঝতে পারি দিনের ভোট রাতেই হয়েছে। আমাদের অন্ধকারে রেখে এমন অরাজকতা পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ভোটে অনিয়ম করা হয়েছে। এই বিষয়ে আমি অনুতপ্ত ছিলাম। যেহেতু গেজেট প্রকাশ হয়ে গেছে, তখন আমি নির্বাচন বাতিল করতে পারি না। তখন আমার হাতে ক্ষমতাও নেই।
নূরুল হুদা বলেন, নির্বাচন কমিশনারকে অন্ধকারে রেখে পুরো প্রক্রিয়াটা শেষ করে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। আর গোয়েন্দা সংস্থা আগেই ফিল্ড দখল করে দিনের ভোট রাতে করতে সহযোগিতা করেছে। নির্বাচনের সময় মাঠ পর্যায়ের সব কর্মকর্তা তৎকালীন ইসি সচিব হেলালুদ্দীনের অধীনে ছিলেন। তিনি তৎকালীন সরকারের হয়ে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেন। আমার একার পক্ষে কিছুই করার ছিল না। এর আগে গত ২২ জুন সন্ধ্যায় রাজধানীর উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টরে নূরুল হুদার বাড়িতে গিয়ে ‘স্থানীয় জনতা’ তাকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। পরদিন প্রভাব খাটিয়ে প্রহসনের নির্বাচন করার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় তার চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকার সিএমএম আদালত। চার দিনের রিমান্ড শেষে আরও চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গত ১ জুলাই এ মামলায় নূরুল হুদা দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। আদালত সেটি মঞ্জুর করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, ওই তিন নির্বাচনে ‘গায়েবি মামলা, অপহরণ, গুম খুন ও নির্যাতনের’ ভয় দেখিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের ‘গণগ্রেপ্তার’ করে নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখা হয়।
সাবেক সিইসি নুরুল হুদার জামিন আবেদন নামঞ্জুর
এদিকে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেছেন আদালত। জাতীয় নির্বাচনে অনিয়ম ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় গতকাল বুধবার বিকালে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. সেফাতুল্লাহ এ আদেশ দেন। আসামিপক্ষের আইনজীবী ওবায়দুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এর আগে গত মঙ্গলবার তার জামিন আবেদন করেছিলেন আইনজীবী। ৪ দিনের রিমান্ড শেষে গতকাল সাবেক সিইসি নুরুল হুদাকে আদালতে হাজির করা হলে, তিনি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
এর আগে, গত ২২ জুন রাজধানীর উত্তরা এলাকায় নিজ বাসভবনে জনরোষের মুখে পড়েন নুরুল হুদা। পরে তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ২৩ জুন আদালত তাকে চারদিনের রিমান্ডে পাঠান। এরপর ২৭ জুন আবারও আদালত তার চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন খান ২২ জুন শেরেবাংলা নগর থানায় এ মামলা দায়ের করেন। মামলায় সাবেক তিন সিইসি কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ, কেএম নুরুল হুদা ও কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ ২৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। বিএনপির অভিযোগ, ২০১৪ সালের দশম, ২০১৮ সালে একাদশ এবং ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের নেতাসমর্থকদের মিথ্যা মামলা, অপহরণ ও হুমকি দিয়ে টার্গেট করা হয়েছে। এতে বলা হয়, নির্বাচনে যাতে অংশ নিতে না পারে, সেজন্য অনেককে গ্রেপ্তার বা হয়রানি করা হয়েছে।
বিএনপির ভাষ্য, এই মামলার আসামিরা তিনটি জাতীয় নির্বাচনে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নামও রয়েছে। মামলার আসামিদের মধ্যে আরও রয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার, জাবেদ পাটোয়ারী ও শহিদুল হক, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার বেনজীর আহমেদ, স্পেশাল ব্রাঞ্চের সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম। একইসঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সাবেক প্রধানকেও মামলায় আসামি করা হয়েছে। বিএনপি বলেছে, এই ব্যক্তিরা ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কারচুপির জন্য দায়ী।