ঢাকা শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

চুলের সৌন্দর্য চর্চায় ইসলামের নির্দেশনা

শরিফ আহমাদ
চুলের সৌন্দর্য চর্চায় ইসলামের নির্দেশনা

ইসলাম নারীর সৌন্দর্য চর্চাকে নিষিদ্ধ করেনি বরং শালীনতা, পর্দা এবং সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছে। চুলের যত্ন ও সাজসজ্জার অনুমোদনে ইসলামের নির্দেশনা নারীর ব্যক্তিত্ব ও সৌন্দর্যের প্রতি যত্নবান হতে উদ্বুদ্ধ করে। এর পাশাপাশি ধর্মীয় আদর্শ বজায় রাখতে সহায়ক হয়।

চুল সৌন্দর্যের প্রতীক : চুল মানব দেহে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। বিশেষ করে এটা নারীদের আত্মবিশ্বাস ও সৌন্দর্যের প্রতীক। উম্মুল মোমিনদের লম্বা লম্বা চুল ছিল। সঙ্গত কারণেই ইসলাম নারীদের মাথা মুণ্ডানো বা চুল ছাঁটাকে হারাম করেছে। হজ-উমরার মৌসুমেও মহিলাদের জন্য মাথা মুণ্ডন করার নির্দেশ দেয়া হয়নি। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, স্ত্রীলোকদের জন্য মাথা মুণ্ডনের দরকার নেই, বরং তারা (এক আঙুল পরিমাণ চুল) কর্তন করবে। (আবু দাউদ : ১৯৮১)।

চুল কাটার বিধান : নারীদের চুল বড় আর পুরুষের চুল ছোট থাকবে এটাই স্বাভাবিক। ছোট মেয়ে ছাড়া বড় মেয়েদের চুল কাটার কোনো প্রশ্নই আসে না। তবে অসুস্থতার কারণে চিকিৎসার প্রয়োজনে চুল ছোট করা, এমনকি কামানোর অনুমতি রয়েছে। চুল বেশি বড় থাকলে যেমন কোমর সমান চুল থাকলে চার আঙুলের বেশি পিঠের মাঝামাঝি করে কাটা কিংবা প্রয়োজনে চুলের সামনে ও পেছনের থেকে এলোমেলো অংশ ছেটে সোজা করা জায়েজ।

এক্ষেত্রে শর্ত হলো এক. বিজাতীয় ফ্যাশনের অনুকরণ করা যাবে না। ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের অনুসরণ-অনুকরণ করবে, সে তাদের দলভুক্ত হবে। (আবু দাউদ : ৩৯৮৯)। দুই. পুরুষের সাদৃশ্য গ্রহণ করা যাবে না। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। নারীর সাদৃশ্য গ্রহণকারী পুরুষদের উপর এবং পুরুষের সাদৃশ্য গ্রহণকারী নারীদের উপর রাসুলুল্লাহ (সা.) অভিসম্পাত করেছেন। (বোখারি : ৫৮৮৫)।

চুলের পরিচর্যা করা : রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে চুলের পরিচর্যা করতেন এবং অন্যদের চুল পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি রাখার নির্দেশ দিতেন। জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের কাছে এসে এক ব্যক্তির মাথার চুল আলুথালু দেখে বলেন, এ ব্যক্তির কি চুল আঁচড়ানোর মতো কিছু নেই। অপর এক ব্যক্তির পরিধানে ময়লা কাপড় দেখে বলেন, সে কি তার কাপড় ধোয়ার জন্য পানি পায় না? (আবু দাউদ : ৪০১৮)।

অধিকাংশ নারী চুলের যত্নে সচেতন। চুল বাধার বিভিন্ন স্টাইল তার সাক্ষ্য দেয়। তারা চুলের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ঘরোয়া উপাদানের পাশাপাশি বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন ব্রান্ডের তেল ব্যবহার করে। মহিলাদের পাকা চুলে কলপ ব্যবহার করার অনুমতি আছে। তবে কালো রঙের কলপ ব্যবহার করা হারাম। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, শেষ যুগে এমন সম্প্রদায়ের আভির্ভাব হবে যারা কবুতরের সিনার মতো কালো রংয়ের খেজাব লাগাবে। তারা জান্নাতের খোশবুও পাবে না। ( আবু দাউদ : ৪১৬৪)। চুলের সৌন্দর্য ধরে রাখতে অতিরিক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার না করে পুষ্টিকর ও প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা উচিত। এতে চুল ঝলমলে সুন্দর ও দীর্ঘস্থায়ী হয়।

পরচুলা ব্যবহার প্রতারণা : বর্তমানে কৃত্রিম চুল সংযোজন ব্যাপকভাবে প্রচলিত। এটি মূলত মানুষের প্রকৃত সৌন্দর্য পরিবর্তনের প্রচেষ্টা। আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে পরিবর্তনের শামিল। তাই পরচুলা ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সাঈদ ইবনে মুসায়?্যাব (রহ.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মুআবিয়া (রা.) শেষ বারের মতো যখন মদিনায় আসেন, তখন তিনি আমাদের সামনে ভাষণ দেন। তিনি এক গোছা চুল বের করে বললেন, আমি ইহুদি ছাড়া অন্য কাউকে এ জিনিস ব্যবহার করতে দেখিনি। রাসুল (সা.) একে অর্থাৎ পরচুলা ব্যবহারকারী নারীকে প্রতারক বলেছেন। (বোখারি : ৫৫১৩)।

নারীদের ধ্বংসের কারণ : মুআবিয়া (রা.) মসজিদের মিম্বারে বসে নারীদের পরচুলা ব্যবহারের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন। বনী ইসরাইলের নারীরা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য এবং এ ধরনের আচরণের কারণে ধ্বংস হয়েছিল। হুমায়দ ইবনে আব্দুর রহমান (রহ.) থেকে বর্ণিত। তিনি মুআবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (রা.)-কে বলতে শুনেছেন যে, হজ পালনের বছর মিম্বরে নববীতে উপবিষ্ট অবস্থায় তার দেহরক্ষীদের নিকট হতে মহিলাদের একগুচ্ছ কেশ নিজ হাতে নিয়ে তিনি বলেন যে, হে মদিনাবাসী! কোথায় তোমাদের আলেম সমাজ? আমি নবী কারিম (সা.)- কে এ জাতীয় পরচুলা ব্যবহার থেকে নিষেধ করতে শুনেছি। তিনি বলেছেন, বনী ইসরাঈল তখনই ধ্বংস প্রাপ্ত হয়, যখন তাদের মহিলাগণ এ জাতীয় পরচুলা ব্যবহার করতে আরম্ভ করে। (বোখারি : ৩৪৬৮)। পরচুলা ব্যবহার করার কারণে অভিশাপ নেমে আসে। ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ ঐ নারীর উপর অভিশাপ বর্ষণ করেন, যে পরচুলা লাগায়, আর অপরকে পরচুলা লাগিয়ে দেয়। আর যে নারী উল্কি উৎকীর্ণ করে এবং যে তা করায়। (বোখারি : ৫৫১২)।

চুল ঢাকা অপরিহার্য : নারীর চুল সতরের অন্তর্ভুক্ত। পরপুরুষকে দেখানো হারাম। নামাজের সময় মহিলাদের পুরো মাথার চুল ঢেকে নামাজ আদায় করতে হয়। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, আর মোমিন নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে আর তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে তবে যা সাধারণত প্রকাশ হয়ে থাকে আর তারা তাদের গলা ও বুক যেন মাথার কাপড় দ্বারা ঢেকে রাখে?। (সুরা নুর : ৩১)। জাহেলি যুগের নারীরা মাথায় এক ধরনের আঁটসাঁট বাঁধন দিত। মাথার পেছনে চুলের খোঁপার সাথে এর গিরো বাঁধা থাকত। সামনের দিকে বুকের একটি অংশ খোলা থাকত। সেখানে গলা ও বুকের উপরের দিকের অংশটি পরিষ্কার দেখা যেত। তাই মুসলিম নারীদের আদেশ করা হয়েছে, তারা যেন এরূপ না করে বরং ওড়নার উভয় প্রান্ত পরস্পর উল্টিয়ে রাখে, এতে করে যেন সকল অঙ্গ আবৃত হয়ে পড়ে। মোমিন মহিলারা কোরআনের এ হুকুমটি শোনার সাথে সাথে যেভাবে একে কার্যকর করে আয়েশা (রা.) তার প্রশংসা করে বলেন, সুরা নুর নাজিল হলে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মুখে উক্ত আয়াত শোনার পর তারা নিজের কোমরে বাঁধা কাপড় খুলে নিয়ে, আবার অনেকে চাদর তুলে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই ওড়না বানিয়ে ফেলল এবং তা দিয়ে শরীর ঢেকে ফেলল। (বোখারি : ৪৭৫৯)।

চুল প্রদর্শনের শাস্তি : গ্রাম শহরের অধিকাংশ নারী আলেমণ্ডওলামা দেখলে মাথায় কাপড় দেয়। মনে করে এটাই নিয়ম। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আলেম হোক কিংবা সাধারণ মানুষ হোক পরপুরুষকে স্বীয় চুল দেখানো যায় না। কারণ চুল প্রদর্শনকারী নারীরা জাহান্নামে যাবে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জাহান্নামবাসী দুধরনের লোক এমন আছে যাদের আমি (এখনো) দেখতে পাইনি। একদল লোক, যাদের সাথে গরুর লেজের ন্যায় চাবুক থাকবে, তা দিয়ে তারা লোকজনকে পিটাবে। আর এক দল স্ত্রীলোক, যারা বস্ত্র পরিহিত হয়েও বিবস্ত্র, (সুখ সম্পদ ভোগকারিনী হয়েও অকৃতজ্ঞ) যারা অন্যদের আকর্ষণকারিণী ও আকৃষ্টা, তাদের মাথার চুলের অবস্থা উটের হেলে পড়া কুঁজের ন্যায়। ওরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, এমনকি তার খুশবুও পাবে না। অথচ এত এত দূর থেকে তার খুশবু পাওয়া যায়। (মুসলিম : ৫৩৯৭)।

চুল বিক্রি নিষেধ : কাটা চুল মাটির নিচে দাফন করে দেয়া উত্তম। কোনো ভালো জায়গায় ফেলে দেয়াও জায়েজ আছে, কিন্তু নাপাক ও খারাপ স্থানে ফেলা ঠিক নয়। এমনিভাবে এমন স্থানেও ফেলা উচিত না, যেখানে তা কোনো গায়ের মাহরামের নজরে পড়তে পারে। গ্রামে-গঞ্জে ফেরিওয়ালাদের কাছে চুল বিক্রি করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এটা নাজায়েয কাজ। এ থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত