দেশ ছাড়ার আগেই মনে হয়েছিল এবার কিছু একটা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফটবল দল। তেমন প্রতিশ্রুতিই দিয়েছিলেন লাল সবুজের কন্যারা। তবে কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। কারণ এএফসি নারী এশিয়ান কাপের বাছাই পর্বে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ অনেক শক্তিশালী।
ফিফা র্যাংকিংয়ে তাদের চেয়ে যোজন যোজন পিছিয়ে আফঈদারা। প্রথম ম্যাচে ৩৬ ধাপ উপরে থাকা বাহরাইকে যখন ৭-০ গোলে উড়িয়ে দিল বাংলাদেশ। তখন মনে হল সত্যি এবার কিছু একটা হবে এবং শেষ পর্যন্ত তাই হতে চলেছে। গতকাল বুধবার ইয়াংগুনে এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে ঋতুপর্ণা চাকমারা ২-১ গোলে হারিয়েছে শক্তিশালী মিয়ানমারকে। ৭ বছর আগে ইয়াঙ্গুনে অলিম্পিক বাছাই ফুটবলে বাংলাদেশের জালে গুনেগুনে ৫ গোল দিয়েছিল মিয়ানমারের মেয়েরা। অতীত রেকর্ডে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে দলটি।সেই মিয়ানমারকে তাদেরই মাটিতে হারিয়ে ইতিহাসের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। আর একটি ম্যাচ জিতলেই ষোলকলা পূর্ণ হবে।
গতকালই সুখবরটা পেয়েছে বাংলাদেশের মেয়েরা। র্যাঙ্কিংয়ে ৭৩ ধাপ এগিয়ে থাকা মিয়ানমারকে হারিয়ে উৎসবের উপলক্ষটা আগেই সাজিয়ে রেখেছিল বাংলাদেশ। অপেক্ষা ছিল বাহরাইন বনাম তুর্কমেনিস্তান ম্যাচের ফলাফলে। তুর্কমেনিস্তান পয়েন্ট হারানোয় এশিয়ান কাপের টিকিট মিলেছে বাংলাদেশের মেয়েদের। তাতে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে পিটার বাটলারের শিষ্যরা। ইয়াঙ্গুনের থুয়ান্না স্টেডিয়ামে বাছাইপর্বের ‘সি’ গ্রুপের ম্যাচে বাহরাইনের সঙ্গে ২-২ গোলে ড্র করেছে তুর্কমেনিস্তান। দুইবার এগিয়ে থেকেও যোগ করা সময়ের শেষ মুহূর্তে গোল হজম করে সুযোগ হারায় দলটি। এদিকে দুই ম্যাচে পূর্ণ ৬ পয়েন্ট নিয়ে এশিয়ান কাপ নিশ্চিত হয়েছে বাংলাদেশের। নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবার এশিয়া কাপের মঞ্চে জায়গা করে নিয়েছে তারা। বাইলজ অনুযায়ী, দুই কিংবা তার বেশি দলের পয়েন্ট সমান হলে তখন দেখা হবে হেড টু হেড ব্যবধান। যেখানে মিয়ানমার ও বাহরাইন দুই দলকেই হারিয়েছে বাংলাদেশ। তাই এ দুই দলের কোনো সম্ভাবনাই নেই পরবর্তী রাউন্ডে যাওয়ার। তবে বাহরাইনকে হারিয়ে শেষ ম্যাচে বাংলাদেশকে হারাতে পারলে সুযোগ ছিল তুর্কমেনিস্তানের। কিন্তু সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি দলটি।
শেষ ম্যাচে এখন তুর্কমেনিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচটি এখন নিছক আনুষ্ঠানিকতার। তবে সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে জয় তুলে নিতেই মরিয়া থাকবেন লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা।
তবে উদযাপনের জন্য আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে বাংলাদেশকে। ম্যাচশেষে এই তারকা আসল উদযাপনটা তুলে রাখার কথাই শেনালেন জয়ের নায়িকা ঋতুপর্ণা চাকমা। মানে মূল পর্বে উঠতে পারলেই উৎসব করার ইঙ্গিত দিলেন, ‘বাংলাদেশে যেহেতু আমরা কষ্ট করে সারা বছর এত অনুশীলন করি, তাই লক্ষ্য ছিল ম্যাচ বাই ম্যাচ জিতে কোয়ালিফাই করা। এখনও আমাদের একটা ম্যাচ আছে। সেই ম্যাচে যদি আমরা ভালো ফল আনতে পারি, তাহলে অবশ্যই উদযাপন করবো।’ ইংলিশ কোচ পিটার বাটলার আরও সাবধানী, ‘টেকনিকেলি তাদের কিছু ভালো খেলোয়াড় আছে। তবে আমার মনে হয়েছে আমাদের কৌশলে ফাটল ধরাতে কিংবা মনোবল ভাঙতে হিমশিম খেতে হয়েছে তাদের এবং তারা হতাশ হয়ে পড়েছিল। আমাদের বিনয়ী হওয়াটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। কারণ কাজ এখন অর্ধেক শেষ হয়েছে, পুরোটা নয়। আমাদের পরের প্রতিপক্ষকে (তুর্কমেনিস্তান) সম্মান জানাতে হবে। বাহরাইন-মিয়ানমারের বিপক্ষে যেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি, ঠিক সেভাবেই প্রস্তুতি নেবো।’
প্রতিপক্ষ মিয়ানমার নিয়ে বাটলারের আরও কথা, ‘যারা আমাকে জানে, তারা জানে মিয়ানমারে খুবই সুন্দর স্মৃতি আছে আমার। এখানে একটি বছর কাটিয়েছি। এখানকার লোকেরা খুবই অতিথিপরায়ণ ও বন্ধুসুলভ। এই দেশ থেকে আমি সবচেয়ে বড় যে জিনিসটা শিখেছি, সেটা বিনয়। আমাদের এখনও কাজ করা বাকি। সেজন্য প্রস্তুত হতে হবে।’
ঋতুপর্ণার প্রশংসা করে বাটলার বললেন, ‘এই মেয়ের (ঋতুপর্ণা) আরও উচ্চমানের লিগে খেলার সামর্থ্য আছে। সবাই সেটা জানে বলে আমি মনে করি। দুর্ভাগ্যজনক যে বাংলাদেশে লিগ হয় না, সেজন্য ভুটানে লিগে গিয়ে খেলতে হয়েছে তাকে। তবে তার সৌদি আরব, মধ্যপ্রাচ্য কিংবা অন্য কোথাও ভালো মানের লিগে খেলা উচিত। সে সাহসী ও কঠিন এক মেয়ে। এখনও তরুণ। তার সামনে সম্ভাবনার বিশাল এক জগত খোলা আছে। আমি চাই সে সামনে এগিয়ে যাক, আরও বড় পর্যায়ে খেলুক, কারণ সে এটার যোগ্য।’
খেলোয়াড়দের ম্যাচে কৃতিত্ব দিয়ে বাটলার বিস্তারিত জানিয়ে বললেন, ‘অফিসিয়ালরা যেভাবে ম্যাচটি সামলেছে তা দুর্দান্ত। মিয়ানমারের খেলোয়াড়দের দ্বারা প্রভাবিত হয়নি। আমরা চাই সঠিক চেতনা নিয়ে খেলতে। আমি চাই না আমার খেলোয়াড়েরা অযাচিতভাবে পেনাল্টি আদায়ের চেষ্টা করুক। আমি সেভাবে কাজ করি না। সেদিক থেকে রেফারিরা দুর্দান্ত ছিল। লাইন্সম্যানরাও ঠিক কাজ করেছে। সব সিদ্ধান্ত সবসময় সঠিক হবে না। তবে এর মধ্যে একটিও পেনাল্টি ছিল বলে আমার মনে হয় না।’ তিনি আরও বললেন, ‘আমাদের একটি পরিকল্পনা ছিল এবং সেজন্য নিখুঁতভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি। জানতাম যে ম্যাচটি দেখতে সুন্দর লাগবে না। তবে আমরা যেভাবে খেলেছি, যেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি, তারা তাদের পাসিং ফুটবলটা মেলে ধরতে পারেনি। তাদের টেকনিকেলি ভালো খেলোয়াড় থাকলেও কেবল এক-দুইবার আমাদের সমস্যায় ফেলতে পেরেছে। সত্যি বলতে আমার খেলোয়াড়দের পুরো কৃতিত্ব দিতে হবে। রক্ষণে তারা বেশ ভালোভাবে সামাল দিয়েছে এবং খেলার সবচেয়ে কঠিন ও পরিশ্রমী কাজটি করেছে। তারা খুবই ভালো খেলেছে।’