
জাতির মেরুদণ্ড গঠনে গোড়ায় চরম গলদ তৈরি হয়েছে। কোমলপতি শিশুদের শিক্ষার প্রথম ধাপ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার মান নিম্নমুখী। অথচ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য বিনামূল্যে বই, উপবৃত্তি, শিক্ষকদের বেতন প্রত্যেক বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে সরকার, ব্যবস্থা চালু রাখা হয়েছে। কিন্তু সেই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ‘পড়ালেখা মানহীন’ হওয়ায় অভিভাবকরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। বাধ্য হয়ে সন্তানদের বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বা কিন্ডারগার্টেনে পড়াচ্ছেন।
জানা গেছে, সারা দেশে মোট ৬৫ হাজার ৫৬৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে, শিক্ষক রয়েছেন প্রায় সাড়ে ৩ লাখ। যাদের টিএ (ভ্রমণ ভাতা) এবং ডিএ (দৈনিক ভাতা) সহ মাসে ২৩ হাজার কোটি টাকা দিতে হয় সরকারকে। সারা দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার মানোন্নয়নে নজর দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রতি মাসে ৮০০ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম সার্ভে করছে। শিক্ষার্থীর লেখাপড়া মানের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে। সেই প্রতিবেদনে গত জুলাই মাসে দেখা গেছে, তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে শতকরা ৬৫ শতাংশ ‘বাংলা’ রিডিং পারে, চতুর্থ শ্রেণিতে শতকরা ৫০ শতাংশ গণিতে ‘ভাগ’ করতে পারে। আর পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে শতকরা ৫০ শতাংশ ইংরেজি রিডিং পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সারা দেশে জেলায় জেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম সার্ভে করা হচ্ছে। কোন স্কুলে শিক্ষার মান তলানিতে গিয়ে ঠেকলে শিক্ষকদের শোকজ করছে মন্ত্রণালয়। শিক্ষকদের শোকজ করার কিছুদিন পরে ওই স্কুলে ফের সার্ভে চালালে দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার গুণগত মান ভালো হয়েছে। প্রত্যেক দিন বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বই দশ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়াতে হবে। বাংলা, ইংরেজি ও গণিতের প্রতিটি বইয়ের জন্য ৫০ মিনিট করে ক্লাস নিতে হবে শিক্ষকদের।
শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন সঠিক পরিকল্পনার ঘাটতির কারণে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। কোমলমতি শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করা হলেও শিক্ষার মানের ওপর কোনো জোর দেওয়া হয়নি। ফলে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়লেও পড়ার মান নিম্নমুখী হয়েছে। আশা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকার এসে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়নে জোরেসোরে কাজ করবে; কিন্তু সেখানেও গাফলতি রয়েছে। মাঠপর্যায়ে মনিটরিং সিস্টেম, সেখানেও শিক্ষার্থীরা কতটা শিখছে বা দক্ষতা অর্জন করছে, সে বিষয়ে মনিটরিং নেই। মনিটরিং আছে ক্লাসে উপস্থিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও বেঞ্চ নিয়ে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, বর্তমানে সচেতন অভিভাবকরা ভাবছেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার গুণগত মান খারাপ, সেজন্য বাধ্য হয়ে বেসরকারি বিদ্যালয়ে সন্তানদের পাঠাচ্ছেন। আর ব্যয়ের কারণে যারা বেসরকারি বিদ্যালয়ে সন্তানদের পড়াতে পারছেন না, তারা সরকারি বিদ্যালয়ে পাঠানো হচ্ছেন। এমনকি বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও তাদের সন্তানকে কিন্ডারগার্টেন পড়াচ্ছেন। প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থী পাস মার্ক পেয়ে ঠিকই পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণ হচ্ছে; কিন্তু অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী শ্রেণি অনুযায়ী উপযুক্ত দক্ষতা নেই। সব মিলিয়ে শিক্ষায় যে প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছিল, তার কোনোটিতেই শিক্ষামানের উন্নয়নে কার্যকর পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ ছিল না।’
শিক্ষকরা বলছেন, শিক্ষার্থী মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এ মানের অবনমনের অন্যতম কারণ প্রাথমিকে নানা ধারার শিক্ষাব্যবস্থা। আবার শিক্ষকদের বেতন-ভাতা কম হওয়ার বিষয়টিরও এখানে বড় প্রভাব রয়েছে। এই সার্ভের ফল আমাদের দেশের শিক্ষার মানের একটি হতাশাজনক চিত্র উঠে এসেছে। শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্টরা দীর্ঘদিন ধরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়নে কথা বললেও কিছুই পরিবর্তন হয়নি। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের অভাব, শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যার অনুপাত কম, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মধ্যে সম্পর্কের দূরত্ব রয়েছে।
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বিশ্বের বহু দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ক্লাসে পড়ানো হয়, বাড়িতে গিয়ে পড়তে হয় না। কিন্তু আমাদের দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাসের লেখাপড়া বাড়িতে গিয়ে পড়তে হয়। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া হয় না, বা তাদের বাড়িতে পড়ানোর মতো মানুষ থাকে না। অন্যদিকে শহরের উচ্চবৃত্ত এবং মধ্যবিত্ত অভিভাবক সন্তানদের কিন্ডারগার্টেনে পড়ান।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার মান খারাপ হলে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকদের চাকরি হারানোর ভয় থাকে, সেজন্য যত্ন সহকারে ক্লাসে পড়ান। আর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একবার চাকরি পেলে আর চাকরি হারানোর ভয় থাকে না, সেজন্য কিছু কিছু শিক্ষক ক্লাসে ঠিকভাবে পড়ান না। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার মান খারাপ হওয়ায় শিক্ষার্থীর একটি বড় অংশ কিন্ডারগার্টেন ও মাদ্রাসামুখী হয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণিত ও ইংরেজি শিক্ষায় অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়।
দেশে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ মানসম্পন্ন নয়। শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখন পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে কয়েকটি প্রকল্প নেওয়া হলেও তা কাজে আসছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতামত থেকে জানা যায়, প্রশিক্ষণের সিলেবাসের কারণে প্রশিক্ষণার্থীরা প্রকৃত জ্ঞান আহরণে বঞ্চিত হতে পারেন। সর্বোপরি প্রাথমিক শিক্ষকদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গত ২২ মার্চ ময়মনসিংহের টাউন হলের তারেক স্মৃতি অডিটরিয়ামে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার সরকারি সব ধরনের সহযোগিতা ও দৃশ্যমান অবকাঠামো উন্নয়নের পরও দেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান না বাড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন দৃশ্যমান। তবে সে অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষার মান বাড়ছে না। বিষয়টি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।
ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে প্রাথমিক স্কুল ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়া সম্ভব ছিল না। এখন কিন্ডারগার্টেন, মাদ্রাসা হয়েছে। মানুষ স্বাধীন, তারা কিন্ডারগার্টেন ও মাদ্রাসায় শিশুদের পড়াচ্ছেন। প্রাথমিকে বিনা বেতনে আমরা পড়াচ্ছি, বিনামূল্যে পাঠ্যবই দিচ্ছি, উপবৃত্তি দিচ্ছি; তারপরও অভিভাবকরা তাদের শিশুদের পয়সা খরচ করে অন্যখানে কেন পড়াচ্ছেন? তিনি বলেন, আমাদের প্রাথমিকের শিক্ষার অবকাঠামো ভালো, শিক্ষকরা মানসম্পন্ন, পড়াশোনায় অগ্রসর, বেতন কাঠামো মোটামুটি ভালো, চাকরির নিশ্চয়তা আছে। অন্যসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসব সুযোগ-সুবিধা তুলনামূলকভাবে কম। তারপরও অভিভাবকরা কেন তাদের শিশুদের অন্য বিদ্যালয়ে পড়াবেন? প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সমস্যা কোথায়? কীভাবে উন্নয়ন করতে পারি, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট মতামত আশা করছি।
উপদেষ্টা বলেন, মানসম্মত শিক্ষা সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমাদের লক্ষ্য শিশুদের সক্ষম করে তোলা। শিক্ষকরা শিশুদের মুখস্থ না করিয়ে তারা যেন মাতৃভাষায় বলতে, পড়তে, লিখতে ও গণিত করতে সে বিষয়টি নিশ্চিত করবেন। যদি শিশুরা পারে তাহলে বুঝবেন আপনি সর্বোচ্চ করে দিয়েছেন। এরপর সে নিজে নিজেই সর্বোচ্চ পর্যায়ে লেখাপড়া করতে পারবে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে সরকারের উদ্যোগের বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মো: মাসুদ রানার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ ও মোবাইল ফোনে কল করা হলে বক্তব্য পাওয়া যায়নি।