ঢাকা শনিবার, ৩১ মে ২০২৫, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কী লিখি, কেন লিখি

আনোয়ার কামাল
কী লিখি, কেন লিখি

কী লিখি, কেন লিখি প্রশ্নটা আমার মাথার মধ্যে মাঝেমধ্যে ঘুরে ফিরে কিছু প্রশ্নের উদ্রেক করে বৈকি। আসলে ঠিক কবে লেখালেখি শুরু করেছিলাম তার দিনক্ষণ এখন আর মনে নেই। তবে এটা মনে আছে ১৯৭৭ সাল হবে। তখনও স্কুলের গণ্ডি পার হতে পারিনি। স্কুলের দেয়াল টপকানোর দ্বারপ্রান্তে আর কি। সে সময় আমাদের শহুরে মহল্লায় একটা ক্লাব ছিল। ক্লাবে নিয়মিত অনুষ্ঠান হতো। অনুষ্ঠানগুলো নাটক, কবিতাপাঠ, সাহিত্যালোচনা, দেয়ালিকা, ম্যাগাজিন বের করা ইত্যাদি। তখন ঐ বয়সে আমার লেখালেখি নিয়ে তেমন শোধ-বোধ হয়ে ওঠেনি। গান-বাজনা আর নাটকের দৃশ্যগুলো দেখে আনন্দ পেতাম।

আব্বা-আম্মাসহ পরিবারের সবাইকে নিয়ে সেসব অনুষ্ঠানে যেতেন। আমি ভীষণভাবে উপভোগ করতাম। ক্লাবে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন জাতীয় দিবসগুলোতে দেয়াল পত্রিকা বের করা হতো, মাঝেমধ্যে সাহিত্য পত্রিকা। দেয়ালিকায় সুন্দর হাতের লেখা আর নানান রঙের আল্পনায় ভরে থাকত গল্প-ছড়া-কবিতা আর নানা ধরনের কৌতুকে। বিষয়টা আমাকে আকৃষ্ট করতো। এক ধরনের শিহরণ জাগাতো মনের গহিন কোণে।

মহল্লার এসব দেয়ালিকা দেখে আমি একবার স্কুলে দেয়াল পত্রিকা বের করার উদ্যোগ নেই। স্কুলে পাড়ার ক্লাবের অনুকরণ করে আমিও সেই রকম দেয়াল পত্রিকা বের করতাম। বড় একটা ড্রইং সিটে নান্দনিক আবহে প্রথমে আলপনা আঁকা হতো। তারপর যার হাতের লেখা সুন্দর সে আমাদের গল্প, কবিতা, ছড়া, কৌতুক লিখে দিলে তা দেয়ালে টাঙানো হতো। তারপর দেখতে দেখতে স্কুলের দেয়াল তো পার হলাম। এবার কলেজের বারান্দায় ঘোরাঘুরি। কলেজ জীবনে এসেও দেয়ালিকা পিছু ছাড়লো না। এখানেও সেই দেয়ালিকা বের করবার আকাঙ্ক্ষা জেকে বসলো। যেই কথা সেই কাজ। তিন চারজন বন্ধু মিলে আমার সম্পাদনায় দেয়াল পত্রিকা বের করে কলেজের বারান্দায় দর্শনীয় স্থানে প্রদর্শন করা হলো। সে সময় কলেজেও এধরনের দেয়াল পত্রিকার বেশ কদর ছিল। আমরা লিখতাম। আমাদের লেখা দেয়ালের গায়ে দেয়ালিকা হয়ে লেপ্টে থাকতো। বারবার ঘুরে ঘুরে এসে নিজের লেখাটা পড়তাম। কী যে আনন্দ পেতাম তা বোঝানো যাবে না। তারপর যত দিন যেতে লাগলো তত লেখালেখিতে একটু একটু করে হাত পাকাতে লাগলাম। এবার দেয়ালিকা নয় লেটার প্রেসে ছাপার হরফে পত্রিকা বের করা। সেটাও হলো। তারপর সে সময় তো হাতে গোনা কয়েকটা দৈনিক। এখনকার মতো এতো দৈনিকের রমরমা বাহারী কাগজ ছিল না।

থাকি উত্তরাঞ্চলের ছোট্ট একটা থানার মফস্বল শহরে। এই শহরের আলো-বাতাস, মানুষের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা, সিনেমা দেখা আর লেখার ঝোকটা থেকেই গেল। কিন্তু কেন? এতো কিছুর ভেতর লেখার ঝোকটা কেনইবা চাউর হয়ে উঠলো। বুঝিনি, বুঝতে পারিনি। কিসের যেন একটা মোহ ছিল। কিসের যেন একটা টান ছিল। নতুন লেখার জন্য কেন যেন একটা টান টান উত্তেজনা বিরাজ করতো। লিখতে পারলে মনের ভেতর একটা আনন্দময় প্রশান্তির সুবাতাস বয়ে যেত। বরঞ্চ না লিখলেই খারাপ লাগতো। এই ভালোলাগা, প্রশান্তি পাওয়া, উত্তেজনা প্রশমিত করা, আর খারাপলাগা এই যে বোধের রকমফের, এটাই মনে হয় আমাকে কোনো এক ঐন্দ্রজালিক জাদুবলে লিখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

কেন যেন মনে হয় চারপাশের অবহেলিত মানুষের বঞ্চনার শিকার হওয়া, বেদনাহত মানুষের কথা না লিখে থাকতে পারি না। যা দেখি, যা অনুভবে আসে, যা চেতনায় আঘাত করে, তাই লিখতে উদ্যত হই। লেখাটা কে পড়লো, কে পড়লো না, কিংবা আদৌও এর কোনো সাহিত্যমূল্য পেল কি না, তা কখনও ভাবিনি, এখনো তা ভাবনায় আসে না। মফস্বলে থেকে দৈনিকের সাহিত্য পাতায় লেখা পাঠাতাম। ঢাকার পত্রিকাগুলো খুব একটা লেখা ছাপতো না। লেখা ছাপা হতো দিনাজপুর, বগুড়া, খুলনার কাগজে। খুলনার দৈনিক প্রবাহে প্রচুর লিখেছি। পরে ‘দৈনিক প্রবাহ’র উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি হিসেবে সংবাদদাতার কাজও করেছি।

কখন যে যৌবনের প্রারম্ভে কোনো এক কিশোরীর পায়ের ঘুঙুরের শব্দে কবিতার পঙ্ক্তি নাজিল হয়েছে! আবার পথের পাশে বুভুক্ষু মানুষের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে, কিংবা মানুষের না পাওয়ার বেদনায় তড়িতাহত হয়ে ভাবনায় লেখার খোরাক তৈরি হয়েছে। হয়তো তখনই মনের অজান্তেই কবিতার পঙ্ক্তি নাজিল হয়েছে। আমাকে দিয়ে- পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তি সাজিয়ে নিয়েছে। নিজের অজান্তে কখন যে লেখা হয়ে গেছে তা টেরই পাইনি। সেসব লেখা আবার ছাপার হরফেই বের হয়েছে, এখনও হচ্ছে।

কালের কলস থেকে / কবিতার নিখোঁজ শব্দগুলো/ পথহারা পাখির ঝরা পালক/ হয়ে ফেরি করে যত্রতত্র/ প্রিয়জনেষু খুঁজে বেড়া/ চিরচেনা ধূসর মুখ কবিতার লিরিকে/ বিন্দু বিন্দু শিশির জমে/ নিজেকে নিজের কাছে লুকিয়ে রাখি

নৈঃশব্দ্যের রাত্রিদিন। [ফেরারি, নৈঃশব্দ্যের রাত্রিদিন]।

আমি ফেরারি হয়েছি, প্রিয় মানুষের কাছে, ফেরারি হয়েছি নিজের কাছে নিজেই। তাই আমি লিখে জানান দিতে চাই পথহারা পাখির ঝরাপালক হয়ে চিরচেনা ধূসর একটি মুখ খুঁজে ফিরছি। আমি তার সন্ধানে জন্ম জন্মান্তর হাঁটছি, হাঁটছি অনন্তকাল- সুতিগাঙের পাড় থেকে পদ্মার পাড় ধরে। আমার এই অনন্ত পথচলাই লেখার প্রেরণা, আমার এই অনন্ত পথচলাই আমাকে তাড়িত করে; আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়। আমি কি লিখবো তা সেই অপার মায়াময় ঐশ্বরিক ইঙ্গিতে নাজিল হয়। আমি ইচ্ছে করলেই লিখতে পারি না। লেখা হয়ে ওঠে না।

লিখছি পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে। সব বিষয়কেই ধারণ করবার চেষ্টা করে যাচ্ছি। শিশুদের নিয়েও অল্প লিখেছি। আমার একটা শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ আছে। লিখছি গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, সাহিত্য আলোচনা, বই-পত্রিকা রিভিউ। এসবই লিখে থাকি। জানি না, কতটুকু লিখতে পেরেছি। চেষ্টা আর ভেতরের তাগিদ। ভেতরের তাগিদ! হ্যাঁ, ভেতরের তাগিদ থেকেই কেউ আমাকে দিয়ে তার কথাগুলো লিখিয়ে নেয়। আমি অপার হয়ে তার লেখায় সায় দেই, লিখে যাই। কোনো নির্দিষ্টবিষয় ছকে বেঁধে লেখা যায় না, লিখতে চাইলেও তা সেই সরল রেলপথের মতো এগিয়ে চলে না। কোথাও কোথাও যেন তার পথ পিচ্ছিলতায় ভ্রষ্ট হয়ে পথ ঘুরে অন্য পথে হাঁটা দেয়। আমি আমার লেখায় বিন্দু বিন্দু করে শিশির জমাই। শিশিরে মুক্তো জমে। ঘাসের ডগায় সেই মুক্তোর প্রতিবিম্বে আমি আমার ফেলে আসা অতীত খুঁজে পাই। খুঁজে পাই বেদনায় হাতড়ানো প্রেয়সীর সোনালি আঁচল। আমাকে সেই নতুন পথের দিশা বাতলে দেয়। এগিয়ে চলবার স্পৃহা যোগায়, সামনে চলার অনুপ্রেরণা দেয়।

কবিতায় সব কথা সমানভাবে বলা যায় না। তাই গল্পে বলতে হয়। আমি আমার গল্পে যাপিত জীবনের কথাই বলতে চাই। মানুষের লুকানো বেদনার কথকতা ইথার থেকে কুড়িয়ে আনি। ইথারে কুড়িয়ে আনা পঙ্ক্তি দিয়ে যেমন কবিতার বাসর সাজাই, ঠিক তেমনি গল্পে মাটি আর মানুষের সোদা গন্ধ ফেরি করি। আমি এখনও আমার সেই লেখাটি লিখতে পারিনি। সেই লেখাটির সন্ধানে যোগীর ন্যায় ধ্যানমগ্ন থাকি। কবে আসবে? কবে দেখা মিলবে তার সাথে। আমার ভেতরেই সে বসত করে- তাকে ধরবার উদগ্রীব আকাঙ্ক্ষা আমাকে কুঁরে কুঁরে খায়। তাকে পাওয়া হয় না। একদিন হয়তো হবে, যেদিন আমার লেখা একটি কবিতার পঙ্ক্তি মানুষের মুখে মুখে ফেরি করে বেড়াবে, রাজপথের দেয়ালের আয়নায় মোটা মোটা হরফে লেখা হবে; সেদিনই আমার লেখার সার্থকতা খুঁজে পাব। আমি সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় ধ্যানমগ্ন থাকি।

যা লেখার চেষ্টা করি, তা মানুষকে নিয়েই। তার সুখ, দুঃখ বেদনার তলানিতে জমে থাকা পলিমাটিকে কুড়িয়ে এনে মানুষের কাছে পৌঁছে দেই। মানুষ সেখান থেকে কিছু যদি সংগ্রহ করতে পারলো তো পারলো, না পারলে আমার করার কিছুই নেই। আমার ঢোল আমি পিটিয়ে যাই আপন মনে- আমি মানুষকে একটি গল্প শোনাতে চেয়েছি/

আমার স্বপ্নের গল্প- যা মানুষকে মুক্তির পথ দেখায়/ তা কেউ শুনেছে কেউ শোনেনি।/ তাতে ঈশ্বরের কিছুই ক্ষতি হয়নি/ ক্ষতি হয়নি পথের ধারে ভবঘুরের/ কিংবা শহরের নামকরা সুন্দরী রমণীর / বিকানো দেহের। কঠিন বাস্তবের জোয়ালে যে বালক রেখেছে কাঁধ / তাকে আমি ভাই ডেকে নিয়েছি বুকে, /

যে শ্রমিক হারিয়েছে পথ- তার হাতে দিয়েছি মুক্তির পতাকা।

আমি শুধু আমার স্বপ্নের গল্পের কথা বলতে চেয়েছি- মানুষকে ভালোবাসার কথা বলতে চেয়েছি/ কেউ শুনেছে কেউ শোনেনি।

[একটি স্বপ্নের গল্প বলতে চেয়েছি, কুড়িয়ে পাওয়া পঙ্ক্তি]

আমি যে স্বপ্ন দেখি, আমার লেখালেখিতে সেই স্বপ্নের কথাই বলবার চেষ্টা করি। মানুষকে ভালোবাসার কথা বলি, তাকে জাগিয়ে তুলবার কথা বলি। আমার এ ঢোল পিটানো রাজনীতিবিদদের মতো নয়। আমার ঢোল পিটানো ভোঁতা চেতনাকে শান দেওয়া। হতাশার সাগরে ডুবে থাকা নাবিককে পথের দিশা বাতলে দেওয়া। শ্রমজীবী মানুষের হাতে মুক্তির পতাকা তুলে দিতে চাই। সেই অমোঘ মুক্তির বাণী আমাকে তাড়িত করে, সাহস যোগায়- মানুষের কাছে পেয়েছি যে বাণী/ তাই দিয়ে রচি গান/ মানুষের মাঝে ঢেলে দিয়ে যাব মানুষের দেওয়া প্রাণ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত