ঢাকা সোমবার, ১৯ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

তুষার বনে ভিন্ন মানুষ

আলম শাইন
তুষার বনে ভিন্ন মানুষ

নিকোলাস উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ‘মন্দ বলনি, তবে যতটা জানি ওখানে তেমন কোনো আবাসন ব্যবস্থা নেই। আমরা সঙ্গে তাঁবু নিয়ে যাচ্ছি। সমস্যা হলে একরাত কাটিয়ে ইয়াকুটস্কে ফিরে আসব। আর একজন গাইডও আমাদের সঙ্গে থাকবে, তার সাহায্যও নিতেই পারব। চিন্তা করো না, প্রাকৃতিক পরিবেশে টিকে থাকার জন্য যা যা দরকার সবই সঙ্গে থাকবে। আমার বিশ্বাস কোনো সমস্যা হবে না।’

উপাল একটু চিন্তিত মুখে বলল, ‘সমস্যা না হলেই ভালো। সবকিছু দু-একদিনের মধ্যেই ব্যবস্থা করো।’ বন্ধুর আশ্বাসে নিকোলাস আনন্দিত হলো, ‘অবশ্যই সব ব্যবস্থা করে ফেলব, তুমি আমার উপর সবকিছু ছেড়ে দাও। আমরা বিমানেই যাব; দীর্ঘ পথ বিমানে ছাড়া যাওয়াও সম্ভব নয়। ট্রেনে গেলে অনেক সময় লাগবে।’ নিকোলাস ডি সিলভা আগে কখনও এতটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে যায়নি। সাধারণত ইয়াকুটস্কের কাজ সেরেই মস্কো ফিরে যায়। কিন্তু এবারের ভ্রমণের পেছনে তার অন্য একটা উদ্দেশ্য রয়েছে, যা সে উপালের কাছে গোপন রেখেছে। সে জানে উপাল সেনানায়েকে অতটা চতুর নয়, তবে খুব সৎ এবং নির্লোভ মানুষ। তাই উপালকে ওসব বললে সে হয়তো রাজি হবে না, বরং চটে যেতে পারে। তাই নিকোলাস ডি সিলভা মনে মনে ঠিক করল, বৈকাল হ্রদে পৌঁছানোর পর সুযোগ বুঝে নিজের পরিকল্পনার কথা জানাবে।

উপাল সেনানায়েকে মানুষ হিসেবে মন্দ নয়। সে কখনোই অযথা তর্কে জড়াতে পছন্দ করে না, তাই নিকোলাসের সঙ্গে কোনো রকম দ্বন্দ্বে যেতে চায়নি। তবে রত্ন পাথরের ব্যবসা তার একদমই পছন্দ নয়। ভাগ্য পরিবর্তনের লোভ দেখিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতে তার বিবেকে বাধা দেয়। তবুও কাজটা ছেড়ে দিতে পারছে না, কারণ এটি শ্রীলঙ্কার বনেদিদের ব্যবসা।

উপাল ১০ বছর আগে মস্কো এসেছিল। তখন সে একটি নামকরা বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করত। কয়েক বছরের মধ্যেই ভালো অর্থ উপার্জন করে মস্কোতে একটি বড়সড় রত্ন পাথরের দোকান দিয়েছে সে। এরপর ব্যবসাটা বেশ দ্রুত জমে ওঠে। ফলে পরিবার নিয়ে মস্কোতে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ হয় তারও। নিকোলাসের সঙ্গে উপালের বন্ধুত্বের সূত্রপাত স্টোনের দোকানে যাতায়াতের সুবাদে। তারপর থেকে তারা একসঙ্গে পথচলা শুরু করে, একে অপরের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হয়ে ওঠে। উপাল যেহেতু অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়, তাই নিকোলাসের সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও গভীর হয়। তারা একে অপরের আনন্দময় ভ্রমণের সহযাত্রী হয়ে ওঠে। আর সময় পেলেই একসঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে। যেমন আজও তারা যাত্রা করেছে ইয়াকুটস্ক শহরের উদ্দেশে। মূলত তাদের এই ভ্রমণের উদ্দেশ্য দুটি; ব্যবসা এবং দুর্গমে ঘুরে বেড়ানো।

তিন. পাইন বনের পাশ কেটে তীর গতিতে ছুটছে ট্রেন। সোপান অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মস্কোর বাইরে এই প্রথম এসেছে সে। বিস্তীর্ণ তৃণভূমি, সুঁচালো পাইন গাছের মাথায় শিমুল তুলার মতো তুষারের বিস্তৃতি দেখে ভীষণ আনন্দিত হলো সোপান। যেন চোখের সামনে ভাসছে মর্ত্যলোকের স্বর্গ। মস্কোতে প্রতিনিয়ত তুষারপাত দেখলেও বিস্তীর্ণ বনভূমি কিংবা বিস্তীর্ণ মাঠপ্রান্তর নজরে পড়েনি আর। ভ্রমণের শেষের দিকে এসে বিরক্তিটাও কেটে গেছে। দারুণ এক অনুভূতি কাজ করছে তার ভেতর। মন আনচান করছে হ্রদ পাড়ে পা রাখতে। স্বপ্নের বৈকালের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, বিষয়টা ভাবতেও শিহরণ জেগে উঠল সোপানের। গালিবও তদ্রুপ, আনন্দে গুন গুনিয়ে গান গাইতে লাগল।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই ট্রেন বৈকাল স্টেশন পৌঁছে যাবে। ধীরে ধীরে ট্রেনের গতি স্লো হয়ে এলো। যাত্রীরা ঝটপট ব্যাগ গুছিয়ে তৈরি হয়ে গেল ট্রেন থেকে নামতে। গবেষকেরাও বসে নেই, কেবিন ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। অরিন্দম বাগচিও তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তিন-চারদিন গবেষকদের সঙ্গে দারুণ সময় কাটিয়েছে সে। এখন দুজন নেমে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই বেচারির মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। বিদায় দিতে গিয়ে বিষণ্ণতায় ভুগতে লাগল অরিন্দম বাগচি। সেই কষ্টে বেচারি মুখটা ফিরিয়ে রাখল অন্যদিকে। সমব্যথায় ব্যথিত হলো গবেষকেরাও। ট্রেন ঝাঁকি দিয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে গেল। অন্যান্য যাত্রীদের সঙ্গে ঝটপট গবেষকেরাও ট্রেন থেকে নিচে নামল। স্টেশনে পা রাখতেই দুজন আনন্দের জোয়ারে ভাসতে লাগল। এ কোথায় এসেছে তারা! শ্বেত-শুভ্র তুষারে ঢেকে আছে সমস্ত এলাকাটা। হোটেল-মোটেল বা শপিংমলের সাইনবোর্ডও ঠিকমত নজরে পড়ছে না; এতটাই ঘন তুষারাবৃত হয়ে আছে স্টেশন। স্টেশনে দাঁড়াতেই নজরে পড়ল একটা তীর চিহ্নের উপর। ইংরেজি অদ্যাক্ষরে লেখা আছে ‘লেক বাইকাল’। যা বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে ‘বৈকাল হ্রদ’ নামে পরিচিত। আনন্দে আত্মহারা দুজন। কয়েক কদম অগ্রসর হতেই সামনে পড়ল কাঙ্খিত বৈকাল হ্রদ। হ্রদের বুকে নীলাভ সাদা বরফের আস্তরে মোড়ানো। অদ্ভুত এক সুন্দর। তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রইল দুজন। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারছে না কিছুতেই। নিস্তব্ধ হ্রদ এলাকা। সুনশান নীরবতার মাঝেও হ্রদের বুক চিরে দু-তিনটা জিপ গাড়ি শাঁ শাঁ বেগে ছুটোছুটি করছে। সম্ভবত মৌসুমের শুরুতে আসা গুটিকয়েক পর্যটক নিয়ে যাতায়াত করছে গাড়িগুলো। স্টেশন ছাড়া আশপাশে আর তেমন কোন জনমানবের যাতায়াত নেই, নেই তেমন কোনো পর্যটকদের আনাগোনাও। ঋতুর হিসেবে বসন্তের শুরু হলেও এখনও হ্রদের বরফ গলতে শুরু করেনি। মূলত মে মাসের শেষ থেকে তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে এ অঞ্চলের, তখন ধীরে ধীরে হ্রদের স্বচ্ছ জল নজরে পড়বে। অনাবিল এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে বিশ্বের নানান দেশের পর্যটক হ্রদ পাড়ে হাজির হয় তখন। সেসময় হ্রদ পাড় ব্যস্ত এলাকায় পরিণত হয়। বেড়ে যায় লোকজনের কর্মচঞ্চলতাও। বিশেষ করে মৎস্যজীবীদের আনাগোনা আর জলচর পাখিদের কাকলিতে এলাকাটা মুখরিত হয়ে পড়ে। এ অঞ্চলের মৎস্যজীবীদের অধিকাংশই ‘বুরিয়াত’ সম্প্রদায়ের আদিবাসী। মৎস্যসম্পদ আহরণের মাধ্যমেই এরা জীবিকা নির্বাহ করে। তাই মৌসুমে সমস্ত হ্রদ এলাকা কোলাহলপূর্ণ থাকে। অথচ এমন কোলাহলপূর্ণ পর্যটন এলাকাটা এখন জনমানব শূন্য; মনে হচ্ছে নীরব নিস্তব্ধ এক ভৌতিকপ্রান্তর। নিস্তব্ধতার মধ্যেও বেশ লাগছে বৈকালের স্ফটিকশুভ্র চেহারাটা। হ্রদের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে গবেষকেরা সেখানে একাগ্রচিত্তে দাঁড়িয়ে রইল। হ্রদ ছেড়ে হোটেলে উঠতে ইচ্ছে করছে না তাদের।

গবেষকদের এবারের গন্তব্য বৈকাল পর্বতমালার গহিনে। যেখানে বাস করে ‘সয়ত’ সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা। মূলত সয়তিরা ‘ওকিন্সকি’ বিভাগের ‘ওকা’ অঞ্চলে বসবাস করে। কিছু ‘সয়ত’ বাস করে বৈকাল পর্বতমালার মালভূমিতে; প্রাকৃতিক পরিবেশে। সমগ্র রাশিয়াজুড়ে তাদের সংখ্যা একেবারেই কম; হাতেগোনা। যতটা জানা গেছে সংখ্যায় তারা চার হাজারের বেশি নয়। একেবারে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি বলতে যা বুঝায় সয়তিরা সেটাই। গবেষকেরা থিসিসের জন্য ওখানকার সয়তিদের বেছে নিয়েছে। তাই তারা ‘বুরিয়াতিয়া’ প্রজাতন্ত্রের বৈকাল স্টেশনে নেমেছে। এখান থেকে গন্তব্যে পৌঁছতে খানিকটা সুবিধা হবে। চলবে...

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত