ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

দুখু মিয়ার আলাভোলা জীবন

রায়হান উল্লাহ
দুখু মিয়ার আলাভোলা জীবন

কাজী নজরুল ইসলাম; বাংলাদেশের জাতীয় কবি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’ এবং আধুনিক বাংলা গানের জগতে ‘বুলবুল’ নামে খ্যাত। অবিভক্ত বাংলার সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব তিনি। বিশ্ব সাহিত্যের বিস্ময়কর প্রতিভা নজরুল। মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্যিক জীবনে তার সৃষ্টির প্রাচুর্য অভাবনীয়। এক হাতে তার বাঁশের বাঁশরি আর এক হাতে রণতূর্য ছিল। নজরুল দ্রোহ, মানবতা, প্রেম, তারুণ্য ও পুনর্জাগরণের কবি। তার ছিল বিচিত্র জীবন। তিনি একাধারে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সংগীত রচয়িতা, সংগীত শিল্পী, সংগীত পরিচালক, অভিনেতা, সাংবাদিক ও স্বাধীনতা সংগ্রামী। বর্ণিল ও বর্ণাঢ্য সাহিত্য জীবনের মতো তার ব্যক্তিগত জীবনও তেমন। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। কিন্তু বাকি পরিচয় থেকে তাকে মুছে ফেলার কোনো অবকাশ নেই।

বাংলা সাহিত্যে নজরুল নতুনত্বের স্রষ্টা। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষাভাষী-নির্বিশেষে সব মানুষের সমান অধিকারের জন্য নজরুল কথা বলেছেন। সারা দুনিয়ার নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর তিনি। নজরুলের দুর্ভাগ্য যে তার কোনো সুযোগ্য সহযোগী ছিলেন না। অনুরাগী ছিলেন অগণিত। তার পরিবারেও কেউ ছিলেন না, যিনি তাকে নিয়ে গবেষণা করবেন, গবেষকদের প্রয়োজনীয় উপকরণ দিয়ে সহায়তা করবেন। নজরুলের মতো আত্মভোলা ও অবৈষয়িক মানুষ এই গ্রহে খুব বেশি জন্মাননি। তাই তার জীবন সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। বলা চলে স্বাধীন বাংলায় নজরুল চর্চার প্রাসঙ্গিকতা বেড়েছে। তিনি বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতি ও রাজনীতির কেন্দ্রীয় চরিত্র। নজরুল একইসঙ্গে প্রেমিক ও বিপ্লবী। ছোটবেলা থেকেই দুঃখের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন; তাই তার নাম দুখু মিয়া। তার জীবন শুরু হয়েছিল এক মিশ্র পরিবেশে। ২৪ মে ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। মাত্র নয় বছরে বাবা কাজী ফকির আহমদকে হারান নজরুল। বাবা ছিলেন মসজিদের ইমাম ও মাজারের খাদেম। পিতার মৃত্যুর পর পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তার শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হয়। মাত্র ১০ বছর বয়সে তাকে জীবিকা অর্জনের পথে হাঁটতে হয়। শুরুতেই নজরুলের অসামান্য প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন নজরুল। একইসঙ্গে কবরের সেবক ও মজদিদের মুয়াজ্জীন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ফলে নজরুল অল্প বয়সেই ইসলামের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান। পরবর্তী সময়ে এসব তার সাহিত্যকর্মে প্রভাব ফেলে। মক্তব, মসজিদ ও মাজারের কাজে নজরুল বেশিদিন ছিলেন না। লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বালক নজরুল কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমাণ নাট্যদল লেটোর দলে যোগ দেন। এখানেও তার চাচা কাজী বজলে করিমের প্রভাব ছিল। তিনি চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের ওস্তাদ ছিলেন। আরবি, ফার্সি ও উর্দূ ভাষায় তার দখল ছিল। বলা চলে লেটো দলেই নজরুলের সাহিত্যচর্চার শুরু। এই দলে তিনি অভিনয় করতেন, নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন। ১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্রজীবনে ফিরে আসেন। এই ছাত্রজীবন শুরুর দ্বিতীয় স্কুল মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুল যা পরবর্তী সময়ে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন নামে পরিচিতি লাভ করে। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন কুমুদরঞ্জন মল্লিক যিনি সেকালের বিখ্যাত কবি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার সান্নিধ্যও নজরুলের প্রেরণার একটি উৎস।

কী বিচিত্র জীবন নজরুলের! সেখানেও তিনি বেশিদিন পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। আর্থিক সমস্যার কারণে তাকে আবার কর্মজীবনে প্রবেশ করতে হয়। বিভিন্ন কাজে যোগ দেওয়ার পর আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন নজরুল। দোকানে কাজের ফাঁকে নজরুল কবিতাণ্ডছড়া রচনা করতেন। ওই অঞ্চলের দারোগা রফিজউল্লাহ নজরুলের প্রতিভার পরিচয় পেয়ে ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে তাকে ময়মনসিংহের ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিকে নজরুল মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষা না দিয়ে সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। তিনি সেনাবহিনীতে ছিলেন আড়াই বছর। এই সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিক করপোরাল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। রেজিমেন্টের পাঞ্জাবি মৌলবীর কাছে নজরুল ফার্সি ভাষা শিখেন। বলা চলে নজরুলের সাহিত্যচর্চার হাতেখড়ি করাচি সেনানিবাসে। ওই সময় তার হাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও ফার্সি কবি হাফিজের কিছু বই আসে। সৈনিক থাকাকালে নজরুল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। ১৯২০ সালে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়া হয়। নজরুল সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন। শুরু হয় নজরুলের সাংবাদিক জীবন। নজরুল ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। এখান থেকেই নজরুলের সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়। প্রকাশিত অনেক লেখা প্রশংসিত হয়। কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার মোসলেম ভারত পত্রিকায় নজরুলের প্রকাশিত দুটি কবিতার প্রশংসা করে প্রবন্ধ লেখেন। এভাবেই অনেক বিদগ্ধ সাহিত্যিক-কবির সঙ্গে নজরুলের পরিচয় ঘটে। (চলবে...)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত