ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ৮ কার্তিক ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

তুষারবনে ভিন্ন মানুষ

আলম শাইন
তুষারবনে ভিন্ন মানুষ

নিকোলাস ডি সিলভা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘গাড়ি ছাড়ার আগে চেক করনি কেন!’ ‘করেছি। সবই তো ঠিকঠাক ছিল, হঠাৎ কেন এমন হলো বুঝতে পারছি না। কোথাও বরফ জমেছে কী না কে জানে।’ উপাল সেনানায়েকে রেগে বলল, ‘রওনা দেওয়ার আগে ভালোভাবে চেক করে নেওয়া উচিত ছিল তোমার।’ আন্দ্রে বলল, ‘ভোরেও তো দেখলাম ইঞ্জিনটা ঠিকঠাক ছিল। তোমরা চিন্তা করো না, নেমে দেখছি। সব ঠিক হয়ে যাবে আশা করি; আমি ইঞ্জিনের টুকিটাকি কাজ জানি।’

উপাল সেনানায়েকে বলল, ‘দ্রুত চেষ্টা করো, ইঞ্জিনে বড় ধরনের সমস্যা হলে বিপদে পড়ে যাবো। আশপাশে কিন্তু থাকার ব্যবস্থা নেই।’ নিকোলাস ডি সিলভা ফিসফিস করে বলল, ‘চালকের সঙ্গে ঠান্ডা মাথায় কথা বলো, তাকে ক্ষেপালে সমস্যা হবে; খামোখা রাস্তায় ফেলে রাখবে।’ উপাল সেনানায়েকে বলল, ‘আমার মনে হয় সে পথ হারিয়ে ফেলেছে। না হলে এই দীর্ঘ সময়ে কোনো না কোনো যানবাহন নজরে পড়তো আমাদের। তাছাড়া এই রাস্তাটা কিন্তু পিচঢালা না; ভুলে অন্য কোন রাস্তায় এসেছে বোধহয়; চালক আমাদেরকে সেটা গোপন করেছে। বাজে একটা পথ ধরে গাড়ি চালিয়ে ইঞ্জিনটাকে বসিয়ে দিয়েছে। ইঞ্জিনটা চালু না হলে কী যে বিপদে পড়তে হবে, তা কি বুঝতে পেরেছ?’

নিকোলাস বলল, ‘তোমার কথায় যুক্তি আছে। তুন্দ্রায় যাওয়ার রাস্তা পিচঢালা হওয়ারই কথা, ওদিকে নিয়মিত অভিযাত্রীরা যাতায়াত করেন। অথচ সে কী না পাইন বনের ভেতর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিচ্ছে। আমার মনে হয় ঘণ্টা তিনেক আগেই সে ভুল পথে ঢুকেছে। আমরা যেখানে নেমে ফটোশুট করতে চেয়েছি, ওখানেই ভুলটা করেছে। তিন রাস্তা তিন দিকে গেছে, সে গাড়িটা সোজা রাস্তা ধরে চালিয়ে পাইন বনে ঢুকে পড়েছে। আসলে বাম দিকের রাস্তাটাই ছিল তুন্দ্রার রাস্তা। তুষারে ঢেকে থাকায় তীর চিহ্নটা কেউ খেয়াল করতে পারেনি। এখন শান্ত হও, পরিস্থিতি বুঝে পরে যা বলার বলব।’

পাঁচ ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে প্রায় ৫০০ মিটার উপরে উঠতে সক্ষম হয়েছে তিনজন। পর্বতের এদিক ততটা খাড়া নয়, খুব বেশি পরিশ্রম করতে হয়নি উপরে উঠতে; সময়ও লাগেনি তেমন একটা। ওজনদার ব্যাগ ব্যাগেজ সঙ্গে না থাকলে আরও উপরে উঠতে পারতো। আবার প্রতিকূল পরিবেশও তাদের পথচলা কিছুটা থামিয়ে দিয়েছে। বলা যায় হঠাৎ করেই পার্বত্য এলাকার পরিবেশ সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। স্নো ফল বেড়ে গেছে। স্নো তত ভারি নয়, পাতলা। জ্যাকেটের উপর পড়তেই তা গড়িয়ে নিচে পড়ছে। গায়ে তুষারকণা না লাগলেও ঠান্ডায় হাড়শুদ্ধ জমে যাচ্ছে। মোটা মোটা জামা-কাপড় পরা না থাকলে এতক্ষণে জমে বরফ হয়ে যেত। তাপমাত্রা এখন শূন্যের নিচে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রাকৃতিক পরিবেশে এই তাপমাত্রা গবেষকদের জন্য মারাত্মক হুমকি। লনিয়ার জন্য অতটা হুমকি নয়। সে শূন্যের নিচে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা অনায়াসে মোকাবিলা করতে অভ্যস্ত। তাপমাত্রা মাইনাস পঁচিশের নিচে নেমে গেলে লনিয়াও বেকাদায় পড়ে যাবে। তবে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তাপমাত্রা আর তেমন নিচে নামে না, এটাই ভালো সংবাদ। জুলাই থেকে মূলত গ্রীষ্মের শুরু, তখন ক্রমশ তাপমাত্রার পারদ চড়াও হতে থাকবে। আগস্টের পর থেকে চিত্র আবার ভিন্ন, ধীরে ধীরে সাইবেরিয়াতে শীত ঝাঁকিয়ে বসে।

শীতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এলাকার জীববৈচিত্র্যেও পরিবর্তন আসে। খাদ্যের সন্ধানে পাখিরা দেশান্তরিত হতে শুরু করে। বাংলাদেশসহ উষ্ণতর জলবায়ুর দেশগুলোতে পাড়ি জমায় বিভিন্ন জাতের হাঁস। অন্যদিকে তীব্র ঠান্ডার কারণে অনেক প্রাণী টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত হয়। কেউ কেউ অনুকূল পরিবেশে আশ্রয় নেয়, আবার অনেকে ঠান্ডার প্রকোপে প্রাণ হারায়। শুধু প্রাণিকুলই নয়, মানুষের অবস্থাও নাজুক হয়ে পড়ে। প্রবল শীতে ফ্রস্টবাইটের শিকার হয়ে অনেকেই মৃত্যুবরণ করে। খাদ্য সংকটেও পড়ে অসংখ্য মানুষ। বিশেষ করে সাইবেরিয়ান যাযাবর জাতিরা ভয়ঙ্কর শীতের কবলে পড়ে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায়। এসব দিক বিবেচনা করেই গবেষকরা এপ্রিল মাসটাকে অভিযানের জন্য উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নিয়েছে। এটা এমনই এক সময়, যখন শীতের প্রকোপ কিছুটা কম, অথচ গ্রীষ্মের উষ্ণতাও তেমন নেই।

মুহূর্তেই পর্বতমালার পরিবেশটা তুষারাচ্ছন্ন হয়ে গেল, সমস্ত এলাকায় ধোঁয়াশায় ভরে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন পর্বতের চূড়ায় মেঘের দল ওড়াউড়ি করছে। বিশ-পঁচিশ ফুট দূরত্বের কিছুও স্পষ্ট নজরে পড়ছে না। এদিকে সূর্যাস্তের সময়ও হয়ে এসেছে। যদিও সূর্যের দেখা নেই, তবে ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে দেড় ঘণ্টার মধ্যেই আঁধার নেমে আসবে। বাধ্য হয়ে তাই লনিয়া যাত্রাবিরতির পরামর্শ দিল। অবাক করার মতো হলো, অনেকটা পথ অতিক্রম করলেও কোনো জনমানব কিংবা পশু-পাখিরও সাক্ষাত মিলেনি এখনও। সোপান মনে মনে চিন্তিত; ভয়ও পাচ্ছে সে। কোথায় এসে পৌঁছাল তারা! একেতো হিমশীতল পরিবেশ, তার ওপর রাত কাটাতে হবে তাঁবু খাটিয়ে। অভিযাত্রীদের মতো প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থান নিয়েই ঠান্ডা মোকাবিলা করতে হবে। বিষয়টা অভিযাত্রীদের জন্য যতটা সহজ, তাদের জন্য ততটাই কঠিন। কারণ গবেষকদের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই; আজই প্রথম। এখন লনিয়ার ওপর নির্ভর করছে প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে থাকার বিষয়টা। এমতাবস্থায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দুজনেই তাকাল লনিয়ার চোখের দিকে। কিছু বলার দরকার হয়নি, সহযাত্রীদের মুখ দেখেই লনিয়া বুঝে ফেলেছে এই মুহূর্তে তার কী করণীয়। অহেতুক শলাপরামর্শ করে সময় নষ্ট করতে চায় না সে। কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে বলল, ‘এখনই তাঁবু খাটাতে হবে, আর দেরি করা যাবে না। তোমরা আমাকে সাহায্য করো।’ সোপান বলল, ‘আমাদের কী কী কাজ করতে হবে, অথবা কীভাবে সাহায্য করতে পারি তা পরিষ্কার করে বলো।’

ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব-৮) চলবে...

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত