টিপিন হাতে নিয়ে টগরের পাশে বসল জবা
আরে না কিছুই হয়নি। যা তো।
মাথা নিচু করে জবাব দিল টগর। কিছু একটা তো হয়েছে। জবা ও টগর দুই বন্ধু।
দুজনের মধ্যে খুব মিল।
আজ না তোর জন্মদিন। জন্মদিনের কথা বলতে জবার দু চোখে জল ঝরে পড়ল।
আগে জন্মদিনের দিনটা ছিল ওর সবচেয়ে প্রিয় দিন।
জানিস টগর এই দিনে বাবা, মা, দাদু, চাচ্চু, মামা, খালা, কাজিনরা সবাই একসাথে হয়ে সেলিব্রেট করত; কিন্তু আজ আর সেই সময় নেই। মায়ের মৃত্যুর পর তার জীবন অবিশ্বাস্যভাবে পরিবর্তন হয়ে গেছে।
মামা, খালা, ফোন দিয়ে উইস করছে সকালে গিপট ও পাঠিয়েছেন।
গিপটটা খুলেও এখনো দেখা হলো না।
টগর-আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে আমি আসবো তোর বাসায়। খুশি? জবা হেসে বলল, ঠিক আছে। তাই হবে, দেরি করবি না কিন্তু আজ বিকালের মধ্যেই চলে আসবেই।
আজকে তোর জন্মদিন। আজ তোকে বাদামের লাল হালুয়া খাওয়াবো, জবা বলিস কী?
তা খেতে কেমন। টগর হেব্বি,
একবার খেয়ে দ্যাখনা।
দুজনেই মজা করে লাল হালুয়া খেলো।
কিছুক্ষণ পর- জবা বলল জানিস আমার অনেক কাজ
হোমওয়ার্ক শেষ করতে হবে এবং বিভিন্ন বিষয়ের নোট করতে হবে।
সন্ধ্যা নেমে গেছে। কোচিং শেষ হলো।
হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি। টগর ও জবা বেশ কিছুক্ষণ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে তাদের মায়ের গল্প করে,
বর্ষাকাল আসলে জানিস মায়ের কথা বড্ড মনে হয়।
বর্ষাকালে মা একেবারেই ইশকুলে যেতে দিতেন না। ইশকুলে না গেলে আমার কিছুই ভালোই লাগে না।
মা-জানে, বৃষ্টিতে আমি ভিজি।
মাকে কি করে বুঝাই, বৃষ্টিতে একটু ভিজলে তেমন কিছু হয় না।
মায়ের খুব ভয়, আমার যদি আবার কোন অসুখ বিসুখ হয়।
সেদিনের কথা, ইশকুলে যাবার সময় আমাকে মা’ একদিন রাগ করে গাড়ি ভাড়া দেয়নি। মা মনে করছে সেদিন আমি আর ইশকুলে যাবো না।
মা তো কাজে ব্যস্ত সে সুযোগে আমি ইশকুলের পথ ধরে হাটা শুরু করলাম। হঠাৎ করে ঝুম বৃষ্টি। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া সত্যি কষ্টকর। এমন সময় এক অচেনা চাচা আমার মাথায় ছাতা ধরে বলেন, এই যে খুকী তোমার নাম কী? বৃষ্টিতে ভিজে ইশকুলে যাচ্ছ ক্যান?
তোমার তো শরীর খারাপ হতে পারে। আমি ভালো মন্দ কিছু বললাম না। আমি তো জানি। আমি ইচ্ছে করে বৃষ্টিতে ভিজি। চাচা ইশকুলের নাম জানতে চাইলো। আমি এবারো চুপ করে রইলাম। তিনি একটা রিকসা ডেকে আমাকেও বসতে বলে,
আমি চুপচাপ তার পাশে বসলাম।
যেতে যেতে মাঝ পথে ভাবলাম। আমি কি কাজটা ঠিক করেছি। অচেনা একজন লোকের সাথে রিকসাতে বসলাম। যদি লোকটা ছেলেধরা হয়।
যাক, আমার ভেতরে অনেক সাহস। আমি তো আর ভীতু না। ইশকুলে না নিয়ে অন্যপথে নিলে লাফ দেব গাড়ি থেকে মনে মনে ভেবে রাখি।
টগর- হেসে বলে, আরে বাহ্ তুকে যতটা বোকা ভাবতাম তা কিন্তু না।
জবা, টগর হাসবি না।
টগর, তারপর হলো কী?
জবা- লোকটা দেখি চন্দপুরা রাস্তার দিকে যাচ্ছে। আমার ইশকুলের নাম আবারও জানতে চাইলো? এবার উত্তর দিলাম। আমি যে ইশকুলে পড়তাম সেটা চট্টগ্রাম কলেজের পাশে, সরকারি ইশকুল। ইশকুলের সামনে আমাকে নামিয়ে দিলেন তিনি। তখন আমি ওই চাচাকে ধন্যবাদ জানাবার ভাষা হারিয়ে ফেলি। আমি তার চলে যাওয়ার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম।
এদিকে মা তো ভীষণ চিন্তিত। আমি কই? ইশকুল থেকে এসে মাকে সবটা খুলে বলি।
মা বলে পৃথিবীতে এখনো অনেক ভালো মানুষ আছে ‘মা’
টগর- তোর মা ঠিকেই বলেছেন?
জানিস রোজ রাতে মা ‘ আমাকে এবং ভাইদেরকে নিজ হাতে দুধ গরম করে খেতে দিতো?
কোন কাজের মেয়ে বা অন্য কারো হাতে দিতো না। মায়ের নিজ হাতে গ্লাস ভরে দুধ নিয়ে আসে আমাদের রুমে। মায়ের জন্য আর বড়ো হতে পারলাম না মনে হতো।
একদিন মা পৃথিবী ছেড়ে চলে যান আমাদের ছেড়ে।
মা নেই। সেটা ভাবতেই ছোট্ট বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠে। মা...আগের মতো উঁকি দিয়ে দেখে না আমার রুমে, আমি কি পড়ছি না পড়ছি। কি খাচ্ছি, খাচ্ছি না।
খুব চঞ্চলা পাখির ডানার মতো উড়ে বেড়াতাম সারাদিন। সবুজ কচি ঘাসগুলো ছুতাম। প্রকৃতির বুকে এক মুটো স্বপ্ন এঁকে দিতাম। মেঘের লুকোচুরির সাথে উড়ে যেতাম মনের স্বপ্নের ডগায় হেসে, মা নেই এখন কিচ্ছুই ভালোলাগে না।
ভাবতে থাকি জীবনটা এতো ছোট কেন? আরো কিছুদিন মাকে কাছে পেতাম।
মায়ের মৃত্যুর পর সে সবুজ ছায়াঘেরা বিশাল চারতলা বাড়িটি চোখের পলকে যেন থমকে গেল।
ঝিমধরা প্রাণহীন একটি প্রাসাদ। অথচ এখানে জীবনের আনন্দের সব কোলাহল ঝালাই করে নিতাম।
আগের মতো আর আড্ডা জমে না।
সবাই যে যার মতো। জীনবনটা কেমন থমকে গেছে। খুব দেখতে ইচ্ছে হয় মাকে। কখনো কখনো মায়ের সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা মায়াভরা মুখটা চোখের সম্মুখে ভেসে উঠে।
মাকে খুব বলতে ইচ্ছে করে, মা ও মা তুমি কি দ্যাখতে পাও, ওই দূর আকাশ থেকে? দ্যাখ,
তোমার সে দূরন্ত কিশোরী মেয়েটি এখন আর ছুটে না, সবুজ মাঠে, উদাস দুপুরের দস্যিপনা, গল্প বলা, মেঘলা আকাশ, বৃষ্টিতে ভিজে বৃষ্টির ছন্দে মনের আনন্দে নাচ, গান, বিকালের ছাদে, হাসনাহেনার মাতাল করা গন্ধ, পেয়ারা পেঁপের আমলকি কিংবা আমের মজাদার সব ভর্তা। উধাও হয়েছে মনের সকল ইচ্ছা। তোমার দস্যি মেয়েটা আজ কতো নিরব।
মায়ের চাঁদমুখটা সামনে ভাসে। শূন্যতা, অনিঃশেষ অন্তর্দাহ। মায়ের রুমে গেলে অবরুদ্ধ ক্রন্দন আর বুকের মাঝে শোক। মনে হয় এই বুঝি বিছানায় শুয়ে আছেন ‘মা’।
মায়ের দেহের মিষ্টি ঘ্রাণ কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে আমাকে।
মাকে আকাশের ঠিকানায় জানিয়ে দিলাম, মা তুমি পরী হতে পারো না,
যখন মন চায় আমার কাছে একটু উড়ে আসতে। তুমি নীল আকাশের তারা হলে কেন? চুপচাপ বসে কি সব দেখছো। রাত ক্রমশ গভীর হলে ওই আকাশের তাঁরার মাঝে খুঁজে ফিরি আমার প্রিয় মাকে।
জবার কথা শুনে টগরের দুচোখ ভিজে গেল।
জবার মনে এতো কষ্ট।
টগর, জবা আজ তুকে নিয়ে আমার মায়ের কাছে যাব, যাবি তুর ভালো লাগবে।
জবা, টগরের সাথে তাদের বাড়ি গেল।
টগরের মা জবাকে বুকে জড়িয়ে ধরে জবা তুমুল
আনন্দে ছলছল করে উঠল চোখ।