চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার বঙ্গোপসাগরের মোহনায় ৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ‘দ্বিতীয় সুন্দর বন’ খ্যাত উপকূলীয় বন উজাড়ের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে প্রকৃতি প্রাণীকুলে। উপজেলার পাঁচ লক্ষাধিক জনসংখ্যা নিয়ে ১৬টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভার মধ্যে সাতটি ইউনিয়ন উপকূলীয় এলাকায় অবস্থিত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলবাসীকে রক্ষার জন্য ৮০’র দশকে উপকূলজুড়ে বনায়ন গড়ে তোলে সরকার। সেই উপকূলীয় বনাঞ্চল ধ্বংস করে ‘জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠায় বন্য প্রাণী কমে গেছে উল্লেখযোগ্য হারে। তবে নতুন করে উপকূলীয় বনাঞ্চল গড়তে সুফল প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৪১ লাখ চারার বাগান সৃজন করা হয়েছে বলে দাবি করেন উপকূলীয় রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল গফুর মোল্লা। মিরসরাই উপকূলীয় বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ‘জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ গড়তে মিরসরাই উপজেলার সাহেরখালী, ইছাখালী ও মঘাদিয়া ইউনিয়নের উপকূলীয় অঞ্চলের ২২ হাজার ৩৩৫ একর বনাঞ্চল নিয়ে নেয় বেজা কর্তৃপক্ষ। এসব বনাঞ্চলে গেওড়া, বাইন কেওড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ছিল। বনাঞ্চলে ছিল হরিণ, শিয়াল, মেছোবাঘ, লজ্জাবতি বানর, বেজি, সাপসহ বিভিন্ন ধরনের বন্য প্রাণী। শীত, বসন্ত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা সব মৌসুমে সুদৃশ্য বনাঞ্চলে অবাধে বিচরণ করেছে নানা প্রজাতির পশু-পাখি। কিন্তু ‘জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠায় উপকূলীয় বনগুলোর সিংহভাগ ধ্বংস করায় বন্য প্রাণীগুলো কমে গেছে। বিশেষ করে হরিণের সংখ্যা কমেছে উল্লেখ্যযোগ্য হারে। উপকূলীয় এসব বনে প্রায় ১০-১২ হাজার হরিণ ছিল। কিন্তু বর্তমানে এর ৮০ শতাংশ কমে গেছে। ২০২২-২০২৪ সালে উপকূলীয় বনাঞ্চল থেকে ৪টি মৃত ও ৪টি আহত হরিণ উদ্ধার করা হয়। এগুলোর মধ্যে ২০২২ সালের ৪ মার্চ সাহেরখালী ইউনিয়নের মঘাদিয়া ঘোনা এলাকার উপকূলীয় বেঁড়িবাধের উপর থেকে দুইটি মরা হরিণ উদ্ধার করা হয়। হরিণগুলোর শরীরের আঘাতের চিহœ ছিল। বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ধারণা সড়ক পারাপার হওয়ার সময় হরিণ দুইটি আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা গেছে। ২০২৩ সালের ১২ মে জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের পুলিশ ক্যাম্পের পাশ থেকে আরও একটি মৃত হরিণ উদ্ধার করে উপকূলীয় বন বিভাগ। মঘাদিয়া ইউনিয়নের উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ ইব্রাহীম বলেন, আগে উপকূলীয় বনাঞ্চলে অসংখ্য হরিণ দেখা যেত। কিন্তু জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে উপকূলীয় বনাঞ্চল ধ্বংস করায় হরিণগুলো আশপাশে উপজেলা সূবর্ণচর ও হাতিয়ায় চলে গেছে। তবে মাঝে মধ্যে মৃত কিংবা আহত অবস্থায় কয়েকটি হরিণ স্থানীয়রা উদ্ধার করে বন বিভাগকে খবর দেয়। এদিকে জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে নেয়া ২২ হাজার ৩৩৫ একর উপকূলীয় বনাঞ্চলের মধ্যে ৪ হাজার ১০৪ একর বনাঞ্চল ফেরত দিতে ২০২৪ সালে চিঠি লিখেছে বন মন্ত্রণালয়। ওই বনাঞ্চলে কেওড়া, গেওড়া ও বাইনসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রয়েছে। বনাঞ্চলটি ফেরত পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদি বন বিভাগ। বেজা সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে গভর্নিং বোর্ডের সভায় মিরসরাইয়ে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০১৬ সালে অর্থনৈতিক অঞ্চলটি উদ্বোধন করা হয়। বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকা সন্দ্বীপ চ্যানেলের পাশে প্রায় ১৩৭ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা হচ্ছে এই জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। বেজার মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুণ্ড ও ফেনীর সোনাগাজী উপজেলাজুড়ে এই শিল্পনগরের আয়তন ৩৩ হাজার ৮০৫ একর। এর ৪১ শতাংশ বা ১৪ হাজার একরে শুধু শিল্পকারখানা হবে। বাকি ৫৯ শতাংশ এলাকার মধ্যে আছে খোলা জায়গা, বনায়ন, বন্দর সুবিধা, আবাসন, স্বাস্থ্য, প্রশিক্ষণ ও বিনোদন কেন্দ্র। সেখানে জমি বরাদ্দের জন্য ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে আবেদন নেওয়া শুরু করে বেজা। ২০১৮ সালের ২৪ জানুয়ারি মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের বেপজা ইকোনমিক জোন প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়। ২০২২ সালের মার্চ মাসে ৪টি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরু করে। বর্তমানে প্রায় ২০টির অধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণকাজ শুরু করেছে। এটি পুরোপুরি প্রতিষ্ঠান হলে প্রায় ১৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে বেজার কর্মকর্তারা জানান। অন্যদিকে উপকূলীয় এলাকা রক্ষায় সুফল প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৪১ লাখ বিভিন্ন প্রজাতির চারার বাগান সৃজন করা হয়েছে বলে জানান উপকূলীয় বন বিভাগ। এগুলোর মধ্যে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বামনসুন্দর ও মঘাদিয়া বিটের আওতায় ১০০ হেক্টর ম্যানগ্রোভ বাগান সৃজন করা হয়। ওই দুই বিটে জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে নির্মিত সুপার ডাইকের বাইরে ৩ নম্বর সড়কের বসুন্ধরা সাইট অফিসের দক্ষিণ পাশে ৩০ হেক্টর ও অর্থনৈতিক অঞ্চলের ১ নম্বর ব্রিজের পাশে ৭০ হেক্টর জমি নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে ৫০০ বেডের বীজতলা তৈরি করে বীজ বপন করা হয়েছিল। ওই বছরের মার্চ থেকে শুরু করে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রোপণকৃত বীজতলার চারাগুলো উত্তোলন করে সাড়ে ৪ লাখ চারা রোপণ করা হয়েছে। প্রতি হেক্টরে ৪ হাজার ৪৪৪টি কেওড়া, বাইন ও গেওড়া প্রজাতির চারা রোপণ করা হয়। এদের মধ্যে মঘাদিয়া বিটের ৩০ হেক্টর জায়গায় ১ লাখ ৩৩ হাজার ৩২০টি ও বামানসুন্দর বিটের ৭০ হেক্টর জায়গায় ৩ লাখ ১১ হাজার ৮০টি চারা রোপণ করা হয়েছে। এভাবে বিভিন্ন অর্থবছরে প্রায় ৪১ লাখ চারা রোপণ করা হয় বলে জানান উপকূলীয় বন বিভাগ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিরসরাই উপকূলীয় রেঞ্চ কর্মকর্তা আব্দুল গফুর মোল্লা বলেন, মিরসরাইয়ে অবস্থিত জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য ২২ হাজার ৩৩৫ একর উপকূলীয় বনাঞ্চল নির্ধারণ করা হয়। ওইসব বনে কেওড়া, গেওড়া বাইনসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ছিল। ছিল বিভিন্ন প্রজাতির বন্য প্রাণী। তবে হরিণের সংখ্যা ছিল বেশি। এগুলোর মধ্যে আমরা ৪ হাজার ১০৪ একর বনাঞ্চল ফেরত পেতে আবেদন করেছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে উপকূলীয় বনাঞ্চলে প্রায় ১০-১২ হাজার হরিণ ছিল। বর্তমানে উপকূলীয় বনাঞ্চলের ৮০ শতাংশ হরিণ হারিয়ে গেছে। জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও উপকূল রক্ষায় আমরা সুফল প্রকল্পের আওতায় নতুন করে ৪১ লাখ চারা রোপণের মাধ্যমে ম্যানগ্রোভ বাগান করা সৃষ্টি করছি।