ঢাকা বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

দায়িত্ব থেকে সরে যাচ্ছে সাইফ পাওয়ারটেক

দায়িত্ব থেকে সরে যাচ্ছে সাইফ পাওয়ারটেক

চট্টগ্রাম বন্দরের আলোচিত নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব থেকে সরে যাচ্ছে সাইফ পাওয়ারটেক। আগামী ৬ জুলাই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে বন্দরের চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে আর চুক্তি নবায়ন করবে না বন্দর কর্তৃপক্ষ। আপাতত বন্দর কর্তৃপক্ষের হাতেই থাকছে এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব। জানা গেছে, সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনায় আপাতত নিজেদের তত্ত্বাবধানে এই টার্মিনাল পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এরইমধ্যে টার্মিনাল বুঝে নেওয়ার প্রাথমিক কাজ শুরু করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ৭ জুলাই থেকে এনসিটি টার্মিনাল পরিচালনা করবে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এরমধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি সময় ধরে রাজত্ব করা সাইফ পাওয়ারটেকের বিদায়ঘণ্টা বাজছে।

বন্দরের কর্মকর্তারা জানান, এনসিটির বিষয়ে ১৮ জুন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে টার্মিনালটি বন্দর কর্তৃক নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালনার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। যেহেতু নতুন করে দরপত্রের মাধ্যমে এনসিটি পরিচালনার জন্য বেসরকারি অপারেটর নিয়োগ একটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই আমদানি-রপ্তানি নিরবচ্ছিন্ন রাখতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের চিফ পারসোনেল অফিসার ও মুখপাত্র নাসির উদ্দিন বলেন, মন্ত্রণালয়ে সিদ্ধান্তের পর টার্মিনাল পরিচালনা করতে ব্যয় নির্বাহের অনুমতির জন্য চিঠি পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে আর্থিক অনুমতি পেলে চূড়ান্ত কাজ শুরু হবে। প্রাথমিকভাবে বন্দরের মেকানিক্যাল এবং ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা সাইফ পাওয়ারটেক থেকে কাজ বুঝে নেওয়া শুরু করেছেন। এর আগে এনসিটি বিদেশিদের হাতে না দেওয়ার দাবিতে বিভিন্ন পক্ষ সরব হয়। তবে তাদের দাবির আড়ালে সাইফ পাওয়ারটেককে রক্ষা করতেই এই আন্দোলন চালিয়েছে বলে অভিযোগ অনেকের। সাইফ পাওয়ারটেক ২০০৫ সালে যাত্রা শুরু করে বন্দরের যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ কাজের মাধ্যমে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠানটি বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিংসহ নানা খাতে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। সরকারের উচ্চ মহলের সিদ্ধান্তে বন্দর কর্তৃপক্ষ টেন্ডার না দিয়েই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে বছরের পর বছর চুক্তি নবায়ন করে। আবার কোনো সময় টেন্ডার হলেও নীতিমালায় এমন সব শর্ত দেওয়া হয়, যাতে সাইফ পাওয়ারটেক ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার মো. রুহুল আমিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের। এই ঘনিষ্ঠতাই ছিল তার প্রধান সম্পদ। এর মাধ্যমে তিনি কেবল বন্দর নয়, দেশের আরও অনেক বড় সরকারি প্রকল্পে প্রবেশাধিকার পান।

চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনালে বিদেশি অপারেটর নিয়োগের যে প্রক্রিয়া আগের আওয়ামী লীগ সরকার শুরু করেছিল, তা এখনও অব্যাহত রয়েছে। সরকার-টু-সরকার (জি-টু-জি) ভিত্তিক এ ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে তখন একজন লেনদেন পরামর্শকও নিয়োগ করা হয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও সেই প্রক্রিয়া এগিয়ে নিচ্ছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরে সফরকালে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনূস বিদেশি অপারেটর নিয়োগের পরিকল্পনার বিষয়টি আবারও উল্লেখ করেন। বন্দরে তার সফরের সময় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের জানান, সরকার সেপ্টেম্বরের মধ্যেই ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তিতে পৌঁছাতে চায়। নতুন মেরিং টার্মিনালে বিদেশি অপারেটর নিয়োগের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, শ্রমিক সংগঠন ও অন্যান্য মহল থেকে তীব্র বিরোধিতা দেখা দিয়েছে। এসব সংগঠন প্রায় প্রতিদিনই বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছে। তাদের দাবি দেশীয় অর্থায়নে নির্মিত এবং স্থানীয় অপারেটরের পরিচালনায় থাকা এই টার্মিনাল বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। তারা সরকারের কাছে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার দাবি জানাচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক সদস্য (এডমিন অ্যান্ড প্ল্যানিং) হাদি হোসেন বাবুল জানান, চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম পরিচালনায় নতুন চুক্তি হওয়ার আগে অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য পূর্বের অপারেটরের মেয়াদ বৃদ্ধির ঘটনা আগেও ঘটেছে। এই টর্মিনালে বিদেশি অপারেটর নিয়োগ প্রক্রিয়া এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এই সময়ে নতুন কাউকে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব নয়। তাই বর্তমান অপারেটরের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো ছাড়া বিকল্প অন্য কিছু নেই।

বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বর্তমানে সাইফ পাওয়ারটেক ছাড়া এনসিটির কার্যক্রম নির্বিঘ্ন রাখতে অন্য কোনো উপযুক্ত বিকল্প নেই। নতুন অপারেটর নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান অপারেটরের মাধ্যমে কার্যক্রম চালানোই সবচেয়ে যৌক্তিক। ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব ৪ হাজার কোটি টাকার অর্থায়নে নতুন মেরিং কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের এই টার্মিনালে পাঁচটি বার্থ রয়েছে, যেখানে সর্বোচ্চ ২০০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। টার্মিনালে আরো রয়েছে ৭০০টি রিফার প্লাগসহ ২,৯২,২৮৭ বর্গমিটার কন্টেইনার স্টোরেজ ইয়ার্ড। নতুন মেরিং টার্মিনালের বার্ষিক কনটেইনার হ্যান্ডলিং ক্ষমতা ১১ লাখ টিইইউ (টুয়েন্টি-ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট), যদিও বর্তমানে সেখানে বছরে ১৩ লাখ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা হচ্ছে। এই টার্মিনাল থেকে চট্টগ্রাম বন্দর বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে। দেশের মোট আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৫৫ শতাংশ পণ্য এই টার্মিনালের মাধ্যমে পরিবহন করা হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত