ঢাকা রোববার, ০৬ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

পবিত্র হজ পালনের নিয়ম

পবিত্র হজ পালনের নিয়ম

হজ ইসলামের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। হজ মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতির বিশ্ব সম্মেলন, সর্বজনীন ইবাদত। আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের মধ্যে যারা সামর্থ্যবান তাদের ওপর হজ ফরজ করেছেন।

পবিত্র কোরআনে বর্ণিত, ‘প্রত্যেক সামর্থবান মানুষের ওপর আল্লাহর জন্য বায়তুল্লাহর হজ করা অবশ্য কর্তব্য।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৯৭)

মৌলিক ইবাদত তিন ধরনের হয়ে থাকে। এক. শারীরিক, যেমন- নামাজ, রোজা। দুই. আর্থিক, যেমন- জাকাত,

ফিতরা। তিন. শারীরিক ও আর্থিক, যেমন- হজ, ওমরাহ । হজে শারীরিক পরিশ্রম যেমন হয় তেমনি আর্থিক ত্যাগ স্বীকারও করতে হয়। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা হজকে অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ করেছেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘কবুল হজের পুরস্কার হলো জান্নাত।’ (বুখারি, হাদিস : ১৭৭৩) আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হয়, সর্বোত্তম আমল কোনটি? তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ও তার রাসুলের ওপর ইমান আনা।’ পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো, এরপর কোনটি? তিনি বললেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা।’ পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, ‘হজে মাবরুর করা।’ (অর্থাৎ কবুল হয়েছে এমন হজ)। (বুখারি, হাদিস : ১৪২৯)

তামাত্তু হজ আদায়ের পদ্ধতি : হজ তিন প্রকার। তামাত্তু, কিরান ও ইফরাদ। বাংলাদেশ থেকে যারা পবিত্র হজে গমন করেন, তারা সাধারণত তামাত্তু হজ আদায় করে থাকেন। তামাত্তু হজকারীগণ প্রথমে উমরা করেন। এরপর মক্কায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। তারপর হজের নির্দিষ্ট দিনগুলোতে নতুন ইহরাম বেঁধে হজ করেন ৮ জিলহজের আগেই তাদের ওমরাহ পালন করতে হবে। তারপর ৮ জিলহজ থেকে হজের কাজগুলো সম্পন্ন করতে হবে।

যারা হজ বা উমরার জন্য বাইরে থেকে মক্কা শরিফ প্রবেশ করবেন তাদেরকে প্রবেশের অনেক আগে নির্দিষ্ট স্থান থেকে ইহরাম বাঁধতে হবে। বিভিন্ন অঞ্চলের লোকদের জন্য এসব স্থান বা মিকাত আল্লাহর রাসূল নির্দিষ্ট করে বলে দিয়েছেন। কাজেই মিকাত অতিক্রমের আগেই ওমরাহর নিয়তে ইহরাম বাঁধা ফরজ। অর্থাৎ সেলাইবিহীন দুটি সাদা কাপড় পরিধান করে দুই রাকআত নফল নামাজ আদায় করে শুধু ওমরাহর নিয়ত করবেন এবং মুখে তালবিয়া পড়বেন: ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা, ওয়ান্নি’মাতা লাকা ওয়ালমুলক, লা শারিকা লাকা।’ (বুখারি : ১৪৪৮)। ইহরাম অবস্থায় পায়ের পাতার উপর দিক খোলা আছে এমন জুতা বা সেন্ডেল পরতে হবে।

মক্কা শরিফ পৌঁছার পর লাগেজপত্র যথাস্থানে রেখে ওজুর সঙ্গে বাইতুল্লাহ শরিফ তাওয়াফ করা ফরজ। এ তাওয়াফ এবং যেসব তাওয়াফের পর ‘সাঈ’ করা হয়, সেসব তাওয়াফের সময় দুটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। এক. ‘ইজতিবা’, অর্থাৎ ডান হাতের বগলের নিচ থেকে ইহরামের কাপড় বাম কাঁধের উপর রাখা মুস্তাহাব। দুই. প্রথম তিন চক্করের সময় ‘রমল’ করা; অর্থাৎ পুরুষরা দ্রুতগতিতে বীরত্বের ভঙ্গিতে চলা সুন্নাত। তাওয়াফ শেষে সম্ভব হলে মাকামে ইব্রাহিমের পেছনে, নতুবা হারাম শরিফের যে কোনো স্থানে (মাকরুহ সময় ছাড়া) দুই রাকআত নামাজ পড়া ওয়াজিব। তারপর সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মাঝখানে সাতবার ‘সাঈ’ করা ওয়াজিব।

অতপর পুরুষদের মাথা মুণ্ডানো বা পুরো মাথা ছাঁটানো আর মহিলাদের চুলের এক ইঞ্চি পরিমাণ কেটে ফেলা ওয়াজিব। এতেই ওমরাহ সমাপ্ত হয়ে যায়। তারপর ইহরাম খুলে যাবতীয় কাজ স্বাভাবিকভাবে করা যাবে।

৮ জিলহজ তারিখে করণীয় : তামাত্তু হজকারীদের ৮ জিলহজ হারামের সীমার ভেতরে যে কোনো স্থান থেকে তথা নিজ বাসা, ঘর, হারাম শরিফ থেকে হজের নিয়তে পুনরায় ইহরাম বেঁধে জোহরের আগে মিনায় পৌঁছতে হবে। ৮ তারিখ জোহর থেকে ৯ তারিখ ফজর পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মিনায় আদায় করা সুন্নাত। তবে প্রচণ্ড ভিড় এড়ানোর জন্য মুয়াল্লিমগণ আগের রাতে নিয়ে যেতে চাইলে সুন্নাত পালনের জন্য বসে থাকা উচিত নয়। তাতে ফরজে ত্রুটি হওয়ার আশঙ্কা আছে।

৯ জিলহজ হজের মূল পর্ব : জিলহজের ৯

তারিখ সূর্যোদয়ের কিছুক্ষণ পর মিনা থেকে আরাফার দিকে যাত্রা করতে হয়। জিলহজের ৯ তারিখ সূর্য হেলার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফায় অবস্থান করা ফরজ। স্মরণ রাখতে হবে যে আরাফার সঠিক সীমানায় পৌঁছতে ভুল করলে হজ আদায় হবে না।

মুজদালিফায় রাত যাপন : সূর্যাস্তের পর মাগরিব না পড়েই মুজদালিফার উদ্দেশে রওনা হতে হবে। মাগরিবের ওয়াক্ত চলে গেলেও, রাত গভীর হলেও মুজদালিফায় পৌঁছার পরেই মাগরিব ও এশার নামাজ একত্রে পড়তে হবে। কেননা মুজদালিফায় পৌঁছে মাগরিব ও এশা এক আজান ও দুই ইকামতে একসঙ্গে আদায় করা ওয়াজিব।

১০ জিলহজ যেসব করণীয় : জিলহজের ১০ তারিখ সুবহে সাদিকের পর কিছুসময় মুজদালিফায় অবস্থান করে সূর্যোদয়ের পরপর মিনার উদ্দেশে যাত্রা করবে। মিনায় পৌঁছে কেবল বড় জামারায় (শয়তানকে) সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব। ১০ তারিখ সুবহে সাদিকের পর থেকে পরদিন সুবহে সাদিকের পূর্ব পর্যন্ত যেকোনো সময় এই কঙ্কর নিক্ষেপ করা যাবে। যদি এই সময়ের মধ্যে কঙ্কর নিক্ষেপ করা না হয়, তবে দম দিতে হবে। এটি সূর্যাস্তের আগে করতে পারলে ভালো।

১০ জিলহজ কঙ্কর মারার পরই দমে শোকর বা দমে তামাত্তু- যাকে হজের কোরবানি বলা হয়, নিশ্চিত পন্থায় তা আদায় করা ওয়াজিব। কোরবানির পরেই মাথা হলক করা ওয়াজিব। তবে চুল ছোটও করা যাবে। মনে রাখতে হবে, হাদি বা কোরবানির পশু অন্যকে দিয়ে জবাই করানো হলে জবাইয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া জরুরি।

কোরবানির পর মাথা মুণ্ডানো বা ছাঁটানোর পর ইহরাম খুলে সবকিছুই স্বাভাবিকভাবে করতে পারবেন, এমনকি স্বাভাবিক কাপড় পরেও তাওয়াফে জিয়ারত করা যাবে। তবে তাওয়াফে জিয়ারতের আগে স্বামী-স্ত্রী মিলন বৈধ হবে না।

কঙ্কর মারা, কোরবানি করা ও চুল কাটার মধ্যে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা ওয়াজিব, ব্যতিক্রম হলে ‘দম’ দিতে হবে। তাওয়াফে জিয়ারত বা হজের ফরজ তাওয়াফ করে সাফা-মারওয়া ‘সাঈ’ করা ওয়াজিব। ১০ তারিখ দিবাগত রাত মিনায় যাপন করা সুন্নাত।

জিলহজের ১১-১২ ও ১৩ তারিখ করণীয় : ১১, ১২ তারিখে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় জামারায় উভয় দিন সাতটি করে ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব। ছোট জামারা থেকে শুরু করে বড় জামারায় তা শেষ করবে। সূর্য হেলার পর থেকে পরদিন সুবহে সাদিকের আগ পর্যন্ত যে কোনো সময় এই কঙ্কর নিক্ষেপ করা যাবে। সূর্যাস্তের আগে সম্ভব হলে ভালো।

১৩ তারিখ সূর্য হেলার পর কঙ্কর নিক্ষেপ করে মিনা ত্যাগ করা সুন্নাত। তবে কেউ যদি ১২ তারিখে চলে আসতে চান, তাহলে ওই দিন সূর্য হেলার পর থেকে পরদিন সুবহে সাদিকের আগ পর্যন্ত যেকোনো সময় পাথর মেরে চলে আসতে পারবেন। কিন্তু যদি কেউ ১৩ জিলহজ সুবহে সাদিকের পর মিনায় অবস্থান করেন, তাহলে তাঁর জন্য ১৩ তারিখেও কঙ্কর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব। অন্যথায় ‘দম’ দিতে হবে। ১২ তারিখের পর একজন হাজী সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন।

তারপর মিনা থেকে মক্কা এসে বিদায়ী তাওয়াফ করা ওয়াজিব। তবে হজ শেষে যেকোনো নফল তাওয়াফই বিদায়ী তাওয়াফে পরিণত হয়ে যায়। মহিলাদের মাসিক এর কারণে বিদায়ী তাওয়াফ করতে না পারলে কোনো ক্ষতি নেই; ‘দম’ দিতে হয় না।

মিনার দিনগুলোতে মিনায়ই রাত যাপন করা সুন্নাত : পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, যারা কাবা ঘরে পৌঁছার সামর্থ্য রাখে, তাদের উপর আল্লাহর জন্য এ ঘরের হজ করা ফরজ। আর কেউ তা পালন করতে অস্বীকার করলে করুক তাতে আল্লাহর কিছু আসবে যাবে না। আল্লাহ সমস্ত জগতবাসী হতে অমুখাপেক্ষী। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ৯৭)

আয়াতটিতে হজ ফরজ হওয়ার ঘোষণা রয়েছে। এদিকেও ইঙ্গিত রয়েছে যে, হজ শুধু সামর্র্থ্যবান লোকদের উপরই ফরজ। আয়াতের শেষ অংশে ইরশাদ হয়েছে, হজ করার শক্তি-সামর্থ্য থাকার পরও অনেকে হজ করে না, তাদের এই অন্যায় আচরণে আল্লাহ পাকের কোনো ক্ষতি হয় না। আল্লাহ তো মুখাপেক্ষিতার দোষ থেকে মুক্ত, চির অমুখাপেক্ষী।

হজ পালন করলে আল্লাহ তায়ালা আখেরাতে ক্ষমা ও জান্নাত দান করবেন।

এক হাদিসে বলা হয়েছে, হজ বা ওমরাহে গমনকারীরা হলেন আল্লাহ তায়ালার বিশেষ মেহমান, তাদের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন, ক্ষমা প্রার্থনা করলে ক্ষমা করে দেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৯২৪)

আরেক হাদিসে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি হজ পালন করবে, আর তাতে অভদ্র-অশ্লীল আচরণ থেকে এবং আল্লাহ তায়ালার অবাধ্যতা ও নাফরমানী থেকে বিরত থাকবে, সে ব্যক্তি হজ থেকে এমন নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসবে, জন্মের সময় একটি শিশু যেমন নিষ্পাপ অবস্থায় জন্ম গ্রহণ করে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৫২১)

আরেক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, যে হজ নিষ্ঠার সঙ্গে যথানিয়মে আদায় করা হয় এবং যাতে কোনো প্রকার অনাচার যুক্ত হয় না, সেই ‘হজ মাবরুরের’ যথাযোগ্য পুরস্কার জান্নাত ছাড়া অন্য কিছুই হতে পারে না। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৭৭৩)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত