আল্লাহতায়ালা সুরা কাহাফে গুহাবাসীর ঘটনা বর্ণনা করেছেন, যা আসহাবে কাহাফ নামে পরিচিত। এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ কিছু বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রদান করেছেন, যা আমাদের শরীর সুস্থ রাখার জন্য এবং পরিবেশ বিশুদ্ধ রাখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ বলেন, ‘যখন কয়েকজন যুবক একটি গুহায় আশ্রয় নিল। অতঃপর তারা বলল, হে আমাদের পালনকর্তা, তুমি আমাদের নিজের পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ দান করো এবং আমাদের কার্যাদি সঠিকভাবে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করে দাও।’ (সুরা কাহাফ : ১০)। তিনি আরও বলেন, ‘অতঃপর আমরা তাদের ওই গুহায় বহু বছর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন রাখলাম।’ (সুরা কাহাফ : ১১)।
গভীর ঘুমের সময় চোখণ্ডকানও ঘুমিয়ে থাকে। কানের তো কথাই নেই। অনেক সময় হাজার ডাকাডাকিতেও ঘুম ভাঙে না, যাকে বলে বেঘোরে ঘুম। তাহলে বিজ্ঞানীরা কেন এক কান জেগে থাকার কথা বললেন? এটা এলো কোথা থেকে? আসলে বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় দেখেছেন যে, নতুন বা অপরিচিত জায়গায় সহজে ঘুম আসে না। সামান্য শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। পরীক্ষায় দেখা গেছে, এ সময় ডান কান জেগে থাকে।
অপরিচিত পরিবেশে মস্তিষ্কের বাম পাশের কিছু অংশ জেগে পাহারা দেয়, অন্য পাশ গভীর ঘুমে অচেতন থাকে। (কারেন্ট বায়োলজি ৯ মে ২০১৮)। এ থেকে আমরা সহজে বুঝতে পারি, কোথাও বেড়াতে গিয়ে নতুন কোনো জায়গায় রাতে ঘুমে কেন কিছুটা অস্বস্তিবোধ হয়।
বিজ্ঞানীরা সিলপ ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখেছেন, গভীর ঘুমের সময় মানুষের মস্তিষ্কের বাম পাশের নার্ভ সেল নেটওয়ার্ক ডান পাশের নেটওয়ার্কের তুলনায় ঘুম পাড়ানোর কাজে কম ভূমিকা রাখে।
নতুন জায়গায় ঘুমের প্রথম রাতে মস্তিষ্কের বাম পাশ সামান্য শব্দেই বেশি প্রতিক্রিয়া দেখায়। বাম পাশে শব্দতরঙ্গ ডান কান দিয়ে ঢোকে। ডান কানের শব্দে সহজে ঘুম ভেঙে যায়। তাই বলা যেতে পারে, নতুন জায়গায় ঘুমানোর সময় ডান কান জেগে থাকে!
নিরাপদ পরিবেশ না থাকলে গভীর ঘুম আসবে কেন? পরিচিত পরিবেশেও কিন্তু সামান্য শব্দে ঘুম ভেঙে যেতে পারে, যদি সেই শব্দ বিপদের সংকেত হয়। আর গুহা হলো- এমন একটি জায়গা যেখানে যেকোনো মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারে। গুহায় পশু-পাখি, সাপের আক্রমণের ভয় রয়েছে। যেহেতু স্থানটি অপরিচিত তাই সেখানে গুহাবাসীদের কান পাহারা দেওয়ার জন্য জেগে থাকবে। হয়তোবা এই কারণেই আল্লাহতায়ালা আসহাবে কাহাফের কান বন্ধ করে দিয়েছিলেন যাতে তারা ঘুমানোর সময় তাদের নিরাপত্তার জন্য, পাহারা দেওয়ার মধ্যে কান জেগে থাকতে না পারে। আল্লাহ বলেন, ‘(অতঃপর আল্লাহ তাদের প্রতি ইলহাম করেন,) যখন তোমরা পৃথক হলে স্বজাতি থেকে এবং আল্লাহকে ছেড়ে যাদের তারা উপাসনা করে তাদের থেকে, তখন তোমরা আশ্রয় গ্রহণ কর গিরিগুহায়, যেখানে তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য তার অনুগ্রহ প্রসারিত করবেন এবং তোমাদের জন্য কল্যাণের ব্যবস্থা করবেন। আর তুমি সূর্যকে দেখবে, যখন তা উদিত হয়, তখন তাদের গুহার ডান দিকে হেলে অতিক্রম করে এবং যখন তা অস্ত যায়, তখন বাম পার্শ্ব দিয়ে অতিক্রম করে, এমতাবস্থায় তারা ভেতরের প্রশস্ত স্থানে অবস্থান করে। এটা আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন। আল্লাহ যাকে সুপথ প্রদর্শন করেন, সেই-ই সুপথপ্রাপ্ত হয়। আর তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তুমি তার জন্য কোন সুপথ প্রদর্শনকারী অভিভাবক পাবে না।’ (সুরা কাহাফ : ১৬-১৭)। সূর্য যখন উদিত হয় তখন সূর্যালোক ভূমির সমান্তরালে থাকে এবং তখন সূর্যালোক গুহার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। সূর্য যত ওপরে উঠতে থাকে সূর্যালোক তত গুহা থেকে বের হয়ে আসতে থাকে। অর্থাৎ সূর্যালোক গুহাবাসীর ডানদিকে হেলে পড়ে। আবার যখন সূর্য মাথার ওপর থেকে পশ্চিম দিকে হেলে পড়ে তখন তাদেরকে বামদিকে রেখে অস্ত যায়।
যখন কোনো জায়গায় সূর্যালোক অনুপস্থিত থাকে, তখন ওই জায়গায় ছত্রাক জন্মানোর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ খুঁজে পায়। আর গুহার ভেতরে সাধারণত আর্দ্রতা বেশি থাকে। ফলে এর অভ্যন্তরে স্যাঁতস্যাঁতে অবস্থা তৈরি হয়। এই ধরনের পরিবেশে ছত্রাক খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
সূর্যালোক প্রাকৃতিক বায়ু চলাচল স্বাভাবিক রাখে। ফলে অভ্যন্তরীণ বায়ুর গুণমান উন্নত করতে পারে। যখন সূর্যালোক একটি ঘরে প্রবেশ করে, তখন সেখানে আর্দ্রতা কমাতে, ছত্রাক বৃদ্ধি রোধ করতে এবং বায়ু সঞ্চালন বাড়িয়ে বাতাসকে তাজা করতে সাহায্য করে। উপরন্তু সূর্যালোকের দুর্গন্ধ এবং বায়ুবাহিত ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করার একটি প্রাকৃতিক ক্ষমতা রয়েছে, যা আরও সতেজ পরিবেশ তৈরিতে অবদান রাখে।
সূর্যালোক মানবদেহের বিবিধ উপকার সাধন করে। সূর্যালোকের রক্তচাপের ওপর প্রভাবসহ মানবদেহে বেশ কিছু ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে।
গুহার মধ্যে যদি সূর্যালোক প্রবেশ না করত তবে গুহাবাসীদের কাছে গুহার বায়ূ দূষিত হয়ে যেত, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ তৈরি হতো। ফলে ছত্রাক জন্মাতো- যা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক হতো। এছাড়া গুহার মধ্যে সূর্যালোককে এমনভাবে প্রবেশ করানো হয়েছে যাতে প্রখর রৌদ্রতাপ গুহাবাসীর শরীরের ক্ষতি করতে না পারে।
আল্লাহ বলেন, ‘তুমি তাদের মনে করবে জাগ্রত। অথচ তারা নিদ্রিত। আর আমরা তাদেরকে ডাইনে ও বামে পার্শ্ব পরিবর্তন করে দিতাম। এমতাবস্থায় তাদের কুকুরটি সম্মুখের দু’পা প্রসারিত করে (মাথা উঁচু করে) গুহা মুখে উপবিষ্ট থাকত। যদি তুমি উঁকি মেরে তাদের দেখতে, তাহলে তুমি পেছন ফিরে পালাতে ও তাদের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়তে।’ (সুরা কাহাফ : ১৮)।
ঘুমের মধ্যে ডান এবং বাম কাঁধের মধ্যে পর্যায়ক্রমে অবস্থান পরিবর্তন করা বিভিন্ন কারণে উপকারী হতে পারে। যেমন :
প্রেসার ডিস্ট্রিবিউশন : পার্শ্ব বদলানো চাপ বিতরণে সাহায্য করে এবং এক কাঁধ বা জয়েন্টে দীর্ঘস্থায়ী চাপ প্রতিরোধ করে। এটি শরীরের নির্দিষ্ট অংশে অস্বস্তি বা ব্যথা হওয়ার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
রক্ত সঞ্চালন : অবস্থান পরিবর্তন স্বাস্থ্যকর রক্ত সঞ্চালন বজায় রাখে। এটি রক্তকে আরও অবাধে প্রবাহিত করার সুযোগ তৈরি করে শরীরের নির্দিষ্ট অংশে কঠোরতা এবং অসারতা প্রতিরোধ করে। পার্শ্ব পরিবর্তনের ফলে শরীরে স্বাভাবিক রক্ত চলাচল বজায় থাকে এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে।
শ্বাসযন্ত্রের স্বাস্থ্য : নাক ডাকার প্রবণতা বা সিলপ অ্যাপনিয়ায় (এটি এক ধরনের রোগ যার লক্ষণ হলো, জোরে নাক ডাকা, হঠাৎ জেগে ওঠার সঙ্গে দম বন্ধ হওয়া বা হাঁপাতে থাকা এবং দিনের বেলা অতিরিক্ত ঘুম হওয়া) ভুগছেন এমন ব্যক্তিদের জন্য অবস্থান পরিবর্তন করা শ্বাসনালীর উন্মুক্ততাকে প্রভাবিত করে। পার্শ্ব পরিবর্তন করে ঘুমানো, নাক ডাকা কমাতে এবং শ্বাস-প্রশ্বাস উন্নত করতে সাহায্য করে।
মেরুদণ্ডের প্রান্তিককরণ : মেরুদণ্ডের অবস্থান যথাযথ রাখতে ঘুমানোর সময় পার্শ্ব পরিবর্তন জরুরি।
হজমের প্রশান্তি : অবস্থান পরিবর্তন হজমের প্রশান্তিতে সাহায্য করে, বিশেষত যারা অ্যাসিড রিফ্লাক্সের সঙ্গে কাজ করে তাদের জন্য। কিছু লোক তাদের বাম দিকে ঘুমিয়ে স্বস্তি খুঁজে পায়, যা পেটের অ্যাসিডকে খাদ্যনালীতে প্রবাহিত হতে বাধা দিতে সাহায্য করতে পারে।
আল্লাহ বলেন, ‘আর আমরা তাদের এমনভাবে (সুস্থহালে) জাগ্রত করালাম (যেভাবে তাদের ঘুমিয়ে দিয়েছিলাম), যাতে তারা পরস্পরে জিজ্ঞাসাবাদ করে। (যেমন) তাদের একজন বলল, কতদিন এভাবে ছিলে? তারা বলল, একদিন বা তার কিছু অংশ। আরেকজন বলল, তোমাদের প্রতিপালকই ভালো জানেন কতকাল তোমরা এভাবে ছিলে। এখন তোমাদের একজনকে তোমাদের এই মুদ্রাসহ নগরে প্রেরণ কর যেন সে দেখে কোন খাদ্য উত্তম। অতঃপর তা থেকে যেন তোমাদের জন্য কিছু খাদ্য কিনে নিয়ে আসে। আর সে যেন নম্রতার সঙ্গে কাজ করে এবং তোমাদের সম্পর্কে কাউকে কিছু বুঝতে না দেয়।’ (সুরা কাহাফ : ১৯)। গুহাবাসীদের একজন ভেজালমুক্ত খাবার নিয়ে আসার জন্য অন্যজনকে পরামর্শ দিল। যেহেতু গুহাবাসীরা অনেক বছর অভুক্ত ছিল তাই তাদের দেহের কিডনি, লিভার, ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃদান্ত্র ইত্যাদি তাদের নিজস্ব কর্ম করতে পারেনি। খালি পেটে ভেজাল খাদ্য খাওয়া বিভিন্ন কারণে আদর্শ নয়। খালি পেটে ভেজাল খাবার খেলে নানা ধরনের অসুখ-বিসুখ ও জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। অন্যদিকে খালি পেটে তাজা খাবার খেলে কিছু উপকার পাওয়া যেতে পারে। তাজা খাবার, যেমন ফল এবং সবজি, ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের মতো প্রয়োজনীয় পুষ্টিতে সমৃদ্ধ। তাজা স্বাস্থ্যকর খাবার দিয়ে একজন মানুষ দিন শুরু করলে তা শক্তির একটি স্বাস্থ্যকর উৎস প্রদান করে এবং সামগ্রিক খাদ্যের জন্য একটি ইতিবাচক টোন সেট করে। এটি ভালো হাইড্রেশনে অবদান রাখে এবং সর্বোত্তমভাবে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি দিয়ে শরীরকে সমর্থন করে। গুহাবাসীরা অনেকদিন খালি পেটে থাকার কারণে তাদের জন্য তাজা ভেজালমুক্ত খাবার প্রয়োজন ছিল, যা তাদের দুর্বল দেহে ত্বরিত শক্তির সঞ্চার করবে। এখানে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় হলো, সবসময় তাজা খাবার খাওয়ার চেষ্টা করা এবং ভেজালযুক্ত খাবার পরিহার করা। বিশেষ করে সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ করা।