প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার এক নিভৃত পল্লি কালাইউরা। জংলী গাছগাছালিতে ভরপুর পুরো গ্রাম। সুনসান নীরবতা গ্রামজুড়ে। সবুজের সমারোহ চারপাশে। পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকে সকাল-সন্ধ্যা। সবুজে ছাওয়া এই গ্রামে প্রাচীন আমলে নির্মিত হয়েছে অপূর্ব সুন্দর ছোট্ট একটি মসজিদ। ‘এক ডিমের মসজিদ’ নামে পরিচিত সবার কাছে। অনেকে ডাকেন ‘গায়েবি মসজিদ’ বলে। মসজিদের চারপাশটা সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। রয়েছে ছোট্ট একটি গেট। গেটের দুই পাশের পিলারে চমৎকার কারুকার্য। মসজিদের বেসমেন্ট সিমেন্ট আর সুরকি দিয়ে বাঁধাই করা।
ছোট্ট এই মসজিদের চূড়ায় বিশালাকৃতির গম্বুজও রয়েছে একটি। গম্বুজের চূড়ায় দৃষ্টিনন্দন পদ্ম ও কলসের মোটিফ দেখা যায়। নিচের দিকে গম্বুজের ব্যাস ৭ ফুট ৪ ইঞ্চি। গম্বুজটি অর্ধ গোলাকার। সমতল থেকে গম্বুজের শীর্ষবিন্দুর উচ্চতা ৩.২৭ মিটার। চারপাশে রয়েছে ছোট্ট ছোট্ট চারটি মিনার। এগুলোকে কর্ণার টাওয়ার বা বুরুজ বলা হয়। মিনারগুলো ছাদ ভেদ করে সোজা ওপরের দিকে উঠে গেছে। সবগুলোর চূড়ায় রয়েছে চমৎকার কলস এবং ফুলকুঁড়ির নকশা। মিনারের অগ্রভাগে ৩টি কার্নিস এবং ওপরের কলার থোড়ের মতো কারুকাজ রয়েছে।
পশ্চিমের দেয়ালে বাইরে মাঝ বরাবর রয়েছে একটা চারকাণাকৃতির মেহরাব। এটি ভূমি থেকে সোজা ওপরের ছাদের সঙ্গে মিশে গেছে। ছোট্ট হলেও মসজিদটির পরতে পরতে লেগে আছে আভিজাত্যের ছাপ। অপূর্ব কারুকার্যশোভিত মসজিদের দেয়াল পোড়ামাটি দিয়ে নির্মিত। দেয়ালের আস্তরণ খসে পড়ছে আজকাল। কালো শ্যাওলা জমে আছে পুরো দেয়ালে। ভেতরটা বেশ সুন্দর। ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন ফ্লোর। জায়গা একেবারেই সামান্য। সামনের মেহরাবে ইমাম দাঁড়ালে পেছনে মুক্তাদিদের একটি মাত্র সারি। তাতে কেবল সাতজন মুসল্লি দাঁড়াতে পারেন। মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত আজান হয়। জামাতও হয় নিয়মিত। গ্রামবাসী নামাজের জন্য এ মসজিদটিই ব্যবহার করেন।
পৃথিবীতে ছোট এরকম মসজিদের নিদর্শন আরও আছে; কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেগুলো ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। তাই নামাজ পড়ার উপযোগী বিশ্বের ক্ষুদ্রতম মসজিদ হিসেবে এটাকেই বিবেচনা করেন স্থানীয় জনগণ। মসজিদের বাইরের দিকে উত্তর-দক্ষিণে দেয়ালের দৈর্ঘ্য ৩.৮৪ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে চওড়া ২.৯৫ মিটার। বাইরে মসজিদের মূল ঘর থেকে উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে একটি দেয়াল আছে।
মূল ঘর থেকে দেয়ালটি দক্ষিণ দিকে ২.৮৮ মিটার, পশ্চিম দিকে ১.৩৪ মিটার এবং উত্তর দিকে ১.৩৪ মিটার দূরে অবস্থিত।
পশ্চিম দিকে দেয়ালের দৈর্ঘ্য ৮.৮৪ মিটার। দেয়ালের উচ্চতা ০.৭১ মিটার এবং পুরো দেয়ালের মধ্যে ৯টি মিনারাকৃতি দৃষ্টিনন্দন খুটি আছে। প্রত্যেকটি খুটির উচ্চতা ১.০৫ মিটার। খুটিগুলোর ওপরে দৃষ্টিনন্দন মোটিফও রয়েছে। মসজিদের পূর্বদিকে খোলা বারান্দার মতো একটি স্থাপনা ছিল, যেটি কিছুটা সংস্কার করা হয়েছে নামাজিদের স্থান সংকুলানের জন্য। বাইরের দেয়ালের পশ্চিমে লাগোয়াভাবে রয়েছে দুটো কবরস্থানের ধ্বংসাবশেষ। গ্রামবাসীর মতে, বেশ কয়েক বছর আগে এখানে সুন্দর কারুকার্যখচিত সীমানা প্রাচীর ছিল।
মসজিদের চারদিকে বর্ধিত সাদাসিধে কিছু কার্নিশ আছে।
দেয়ালের ওপরে কার্নিশের নিচে দেয়ালের পুরুত্বের চেয়ে খানিকটা বড় কোণাকৃতি ভিম চারপাশে দেখা যায়। এতেও কোন বিশেষ কারুকার্য নেই। মসজিদটির পরতে পরতে আভিজাত্যের ছাপ দৃশ্যমান। উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম দেয়ালে ত্রিকোণাকৃতি দুটো জানালা আছে। আলো ও বাতাস চলাচলের জন্য এগুলো তৈরি করা হয়েছে। জানালাগুলোর মধ্যভাগের উচ্চতা ০.৬০ মিটার, মধ্যভাগের প্রশস্ততা ০.৩৭ মিটার এবং প্রত্যেকটিতে আড়াআড়ি ১০টি ছিদ্র আছে। মেহরাবের উচ্চতা ১.৫৭ মিটার এবং প্রস্থ ০.৪৫ মিটার। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালের উপরিভাগে দুটি সেগমেন্টাল খিলান আছে এবং এগুলোর প্রত্যেকটির দৈর্ঘ্য ১.৮০ মিটার ও পুরত্ব ০.৪০ মিটার। এগুলোকে গম্বুজের ওজন বহনের জন্য তৈরি করা হয়েছে। মসজিদে প্রবেশের জন্য রয়েছে শুধু একটি প্রবেশপথ। তা এতটাই নিচু যে এবং মাথা ঝুঁকে প্রবেশ করতে হয়। দরজার উচ্চতা ১.৫০ মিটার এবং ০.৬০ মিটার। মসজিদের মেঝে গ্রামবাসী বর্তমানে টাইলস বসিয়েছেন।
সৌরবিদ্যুৎতের সাহায্যে ভেতরে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আজান দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে মাইকের।
এলাকার লোকজন মসজিদের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই বলতে পারেন না। স্থাপত্য কিংবা ইতিহাসের কোনো বইয়েও এর কোনো ইতিহাস উল্ল্যেখ নেই। বাংলার মুসলিম স্থাপত্যকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। সুলতানি স্থাপত্য ও মুঘল স্থাপত্য। লাখনাবতী রাজ্যের প্রতিষ্ঠা (১২০৪ হতে ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত) নির্মিত মসজিদ ও অন্যান্য ইমারতকে সুলতানি স্থাপত্য বলা হয় আর ১৫৭৭ থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত স্থাপত্যকে মুঘল স্থাপত্য বলা হয়। এই দুই সম্রাজ্যের স্থাপত্যগুলো উপাদান ও উপকরণ একই হওয়া সত্ত্বেও নির্মাণগত কিছু পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বৈশিষ্ট্য বিচারে মসজিদটি কোন আমলে নির্মিত, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। স্থাপত্যশৈলীর বর্ণনা নিশ্চিত যে, মসজিদটি মুঘল আমলের নিদর্শন। আগেই বলা হয়েছে, মসজিদটির অবস্থান গোয়াইনঘাট উপজেলার পিয়াইন নদীর অনতিদূরে কালাইউরা গ্রামে।
১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এ অঞ্চলটি জৈন্তিয়া রাজ্যের অন্তভুর্ক্ত ছিল। অর্থাৎ স্বাধীন জৈন্তিয়া রাজ্যের সর্বশেষ সীমার মধ্যে অঞ্চলটির অবস্থান। কিন্তু সিলেটের ইতিহাস রচয়িতাদের মধ্যে প্রায় সবার মত হচ্ছে, জৈন্তিয়া রাজ্য কখনো মুসলমানদের দ্বারা বিজিত হয়নি । তবে রাজা দ্বিতীয় বড় গোসইয়ের রাজত্বকালে (১৭৩১ থেকে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ) তার ভাগ্নে এবং প্রধান সেনাপতি ফতেহ খাঁর পরিকল্পনা, নির্দেশনা ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে জৈন্তিয়া রাজ্যে ইসলামের প্রচার ঘটে। ঢাকা ও মুর্শিদাবাদের লব্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে তিনি নতুন রাজবাড়ি নির্মাণ করেন। এ নির্মাণ কাজে প্রথম ইটের ব্যবহার করা হয় এবং তার হাত ধরেই জৈন্তা রাজ্যে প্রথম মোঘল স্থাপত্যের প্রচলন ঘটে। পরে তিনি প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে মারা যান। কিন্তু তার এত স্বল্প সময়ে নিজপাটের দূরবর্তী একটি স্থানে এরকম একটি মসজিদ নির্মাণ প্রায় অসম্ভব।
অপরদিকে গোয়াইনঘাট ও মালনিয়াং রাজ্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৩২৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মসজিদ সংলগ্ন পুরো এলাকাটি বিহার সুবাহর অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ সময় বিহারের সুবেদার ছিলেন ইব্রাহিম খাঁ, যার মাজারটি মসজিদ হতে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। মসজিদটি ১৩২৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৬২৫ খ্রিষ্টাব্দের কোনো এক সময়ে নির্মিত হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। সম্ভবত ইব্রাহিম খাঁ সুবেদার থাকা অবস্থায় মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে। কারণ, এরকম ব্যয়বহুল একটি মসজিদ সাধারণ মানুষের দ্বারা নির্মাণ করা সম্ভব নয়। সার্বিক বিচারে মসজিদটি প্রায় ৪০০ বছর পুরনো বলে ধরে নেওয়া যায়।
বর্তমানে পৃথিবীতে নামাজ আদায়ে সক্ষম সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম মসজিদ হিসেবে একেই বিবেচনা করা হয়। বগুড়া জেলার আদমদিঘী উপজেলার সান্তাহার পৌরসভার তারাপুরে যে ছোট্ট একটি মসজিদ রয়েছে, তা অত্যন্ত ছোট হলেও এখন পরিত্যক্ত। ভারতের হায়দারাবাদের কিসান বাগের ‘জিন মসজিদকে’ অনেকে পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম মসজিদ বলে দাবি করেন। তবে তার দৈর্ঘ্য ১০০ বর্গমিটার। অন্যদিকে এক ডিমের মসজিদের দৈর্ঘ্য ৩.০৯ মিটার (১০ ফুট ২ ইঞ্চি) এবং প্রস্থ ২.০৮ মিটার (৬ ফুট ১০ ইঞ্চি)। সে হিসেবে পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম মসজিদ বলে কথিত মসজিদগুলোর চেয়েও আলোচ্য এক ডিমের মসজিদের অনেক ছোট। তাছাড়া সেসব মসজিদগুলো ধ্বংস হয়ে পরিত্যক্ত হয়ে আছে। সুতরাং পৃথিবীর মধ্যে প্রায় ৪০০ বছর পুরোনো, যাতে বর্তমানেও নামাজ পড়া হয়, সে মসজিদটি হচ্ছে ‘এক ডিমের মসজিদ’।