ঢাকা রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

২০০ বছরের সাক্ষী ফকির বাড়ি জামে মসজিদ

২০০ বছরের সাক্ষী ফকির বাড়ি জামে মসজিদ

টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার কচুয়া গ্রামের দেওয়ান বাড়িতে দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্থাপত্যকলার এক অপূর্ব নিদর্শন ফকির বাড়ি জামে মসজিদ। প্রায় দুইশ বছর আগে মোঘল আমলের শেষ দিকে নির্মিত এই মসজিদ আজও স্ব-মহিমায় টিকে আছে, যেন অতীতের এক জীবন্ত ইতিহাস।

স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, দেওয়ান পরিবারের পূর্বপুরুষ শাহ সুফি মোহাম্মদ গোমর আলী দেওয়ান ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে মসজিদটি নির্মাণ করেন। তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ ও সমাজসেবী মানুষ। তার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে কচুয়া গ্রামের দেওয়ান পরিবার। মৃত্যুর পর তিনি পার্শ্ববর্তী বাসাইল উপজেলার করটিয়া পাড়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত হন। মসজিদটি নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে ইট, চুনাপাথর ও সুরকি। যা মোঘল স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য বহন করে। প্রায় ৫০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৩০ ফুট প্রস্থের এই মসজিদের প্রতিটি দেয়াল প্রায় ৪০ ইঞ্চি পুরু।

মসজিদটির রয়েছে পাঁচটি দরজা, প্রতিটি দরজার নকশায় সূক্ষ্ম কারুকাজের ছোঁয়া। ভেতরে ও বাইরে খোদাই করা নানা নকশা এবং ফুলপাতার অলংকরণ স্থাপনাটিকে আরও মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে। মসজিদের ছাদে ছোট বড় মিলে রয়েছে মোট আটটি গম্বুজ, যা দেখতে একেবারেই অনন্য।

প্রবীণ মুসল্লিরা জানান, মসজিদের নির্মাণে কোথাও কোনো লোহা বা রড ব্যবহার করা হয়নি। তবুও দেড় শতাব্দীর বেশি সময় পার হলেও এর গঠন আজও অটুট। চারপাশে রয়েছে প্রায় পাঁচ একর ওয়াকফ জমি। পাশে রয়েছে বিশাল এক পুকুর, যার পানিতে এখনও গ্রামের মানুষ অজু ও গোসল করেন। পুকুরের চারপাশে নানা প্রজাতির গাছপালা, যা মসজিদ এলাকায় সৃষ্টি করেছে মনোরম পরিবেশ। মসজিদের পাশেই রয়েছে একটি প্রাচীন কবরস্থান। এখানে শায়িত আছেন মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা শাহ সুফি মোহাম্মদ গোমর আলী দেওয়ানের বংশধরেরা। দক্ষিণ পাশে রয়েছে একটি বৃহৎ ঈদগাহ মাঠ, যেখানে প্রতি ঈদে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মুসল্লি একত্র হয়ে নামাজ আদায় করেন। মসজিদে নিয়মিত ওয়াক্তের নামাজে শতাধিক মুসল্লি অংশ নেন, আর জুমা বা বিশেষ ধর্মীয় দিবসে ভিড় হয় আরও বেশি। মসজিদের ভেতরে একসঙ্গে প্রায় তিনশ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। প্রতিদিন সকালে মসজিদে শিশুদের কোরআন শিক্ষা দেওয়া হয়। স্থানীয় পেশ ইমাম আইন উদ্দিন নিয়মিত এই শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তিনি বলেন, এমন একটি ঐতিহাসিক মসজিদের ইমামতি করতে পারা আমার জন্য পরম সৌভাগ্যের বিষয়। প্রতিদিন অর্ধ-শতাধিক শিশু এখানে কুরআন শিক্ষা নিচ্ছে। এটিই আমাদের জন্য বড় অর্জন। দেওয়ান পরিবারের ছয় থেকে সাত প্রজন্ম ধরে এই মসজিদে নামাজ আদায় করে আসছেন তারা। বংশক্রমিক ধারায় মসজিদটির বর্তমান মুতাওয়াল্লি মাহমুদা হাবীব। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান হাবিবুর রহমানের স্ত্রী। হাবিবুর রহমান ছিলেন মসজিদের সর্বশেষ মুতাওয়াল্লি। তিনি মারা যাওয়ার পর তার স্ত্রী দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি আরও জানান, প্রায় দুই শত বছর আগে নির্মিত এই মসজিদটি এখনও অক্ষত রয়েছে। তখন সখীপুরে কোনো নির্মাণ শ্রমিক বা প্রকৌশলী পাওয়া যেত না। তাই ধারণা করা যায়, এটি মোঘল আমলের শেষ দিকের স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন।

গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস আলী সিকদার বলেন, এই মসজিদ আমাদের পূর্বপুরুষদের স্মৃতি বহন করছে। সখীপুরের সমসাময়িক আর কোনো মসজিদ আমি দেখিনি। এটি আমাদের গৌরব। প্রবীণ মুসল্লি হালিম সিকদার জানান, আমি ছোটবেলা থেকেই এই মসজিদে নামাজ পড়ে আসছি। শুনেছি, এর বয়স দুই শত বছরেরও বেশি।

স্থানীয় তরুণ মাহাদী হাসান জানান, প্রতি শুক্রবার আশপাশের বিভিন্ন উপজেলা থেকে বহু মানুষ এই মসজিদে নামাজ পড়তে আসেন। এর ব্যতিক্রমী সৌন্দর্য ও শান্ত পরিবেশ অনেককে আকৃষ্ট করে।

গত শুক্রবার জুমার নামাজে অংশ নিতে আসা তামিম নামের এক যুবক বলেন, আমি ইউটিউবে মসজিদটির ভিডিও দেখে বন্ধুদের সঙ্গে এখানে এসেছি। পরিবেশটা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। প্রায় দুই শতাব্দী পেরিয়ে আজও দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ফকির বাড়ি মসজিদ শুধু একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়; এটি টাঙ্গাইল সখীপুরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্থাপত্যকলার এক জীবন্ত দলিল।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত